ফরিদ আহমেদ : ১৯০৮ সালের ঘটনা। ভিলেনডর্ফ নামের অস্ট্রিয়ার একটা ছোট্ট গ্রামে প্রত্নতাত্তি¡ক খননকার্য চলছে। উদ্দেশ্য ছিলো পুরাতন প্রস্তরযুগের নানা ধরনের নমুনা আবিষ্কার করা। ওই খননকাজের সময়ে একজন শ্রমিক লাইমস্টোনের তৈরি একটা ভাস্কর্য খুঁজে পায়। সাড়ে চার ইঞ্চি লম্বা একটা নারীর ভাস্কর্য ছিলো সেটা। পঁচিশ বা তিরিশ হাজার বছর আগে কোনো একজন শিল্পী তাঁর মনের মাধুর্য, সৃষ্টিশীলতা আর সৌন্দর্য-প্রিয়তা দিয়ে সৃষ্টি করেছিলো এটাকে।
ভাস্কর্যটির সৌন্দর্যের কারণে এর নামকরণ করা হয় ভেনাস অব ভিলেনডর্ফ। গ্রীক সৌন্দর্য দেবী ভেনাসের নামে নামকরণ করা হয়। এই নামে ভাস্কর্যটি বিখ্যাত হয়ে যায়। যদিও অনেকেই ভাস্কর্যটির ভেনাস নাম দেবার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে এই ভাস্কর্যটি যখন শিল্পীর হাতে মূর্ত হয়েছে তখন ভেনাসের জন্মও হয়নি। ভেনাসের জন্ম বললেও আসলে ভুল হবে। কারণ, ভেনাস কোনো প্রকৃত মানুষ বা দেবী নয়। এটা গ্রীক রূপকথা মাত্র। ওই সময়ের গ্রীকবাসীরা বিশ্বাস করতো যে ভেনাস নামে তাদের একজন অনিন্দ্যসুন্দরী দেবী আছে।
সৌন্দর্যের কারণে যে ভাস্কর্যটিকে ভেনাস নামকরণ করা হয়েছে, সেটা এখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে মোটেও কোনো সৌন্দর্যময়ী নারী নয়। এটি মূলত একজন পৃথুলা নারীর উদোম মূর্তি। এই নারীর রয়েছে স্ফীত স্তনযুগল, সুবিস্তৃত নিতম্ব এবং মেদবহুল চওড়া কোমর। এমন একজন নারী এখনকার এই জিরো ফিগারের যুগে কোনোক্রমেই সৌন্দর্যময়ী কেউ হবে না সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, ওই সময়ে সৌন্দর্যময়ী ছিলো। এর কারণ হচ্ছে, পুরাতন প্রস্তর যুগের আরও অনেক ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোও এই ভেনাস অব ভিলেনডর্ফের মতোই। একজন শিল্পী যদি একটা মাত্র ভাস্কর্য তৈরি করতো তবে, এটাকে ব্যতিক্রম হিসাবে গণ্য করা হতো। তবে, যখন একই ধরনের ভাস্কর্য আরও আবিষ্কৃত হয়, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে যে সেই সময়ের শিল্পীরা এই রকম নারীদেহকেই সৌন্দর্যের ধারক হিসাবে বিবেচনা করতো।
পুরাতন প্রস্তর যুগের নারীরা কি তাহলে এমন পৃথুলা দেহের অধিকারী ছিলো? খুব সম্ভবত না। বরং এর উল্টোটা হবার সম্ভাবনাই বেশি। ওটা ছিলো শিকার সংগ্রাহক যুগ। কৃষি যুগ আসতে তখনও বহু সময় বাকি। খাবার মজুত করার ব্যবস্থা তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। মানুষ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে খাবার খোঁজে বের হতো। সারাদিন ধরে যা খেতে পারতো, খেয়ে ফিরে আসতো নিজেদের ডেরাতে। পরদিন আবার শুরু হতো একই রুটিন। খাবার সংগ্রহ করে সেটা সংরক্ষণ করতে না পারার এই যুগে মানুষ যেটা করতো, সেটা হচ্ছে মিষ্টি জাতীয় খাবার পেলে গোগ্রাসে গিলে আসতো। না গিলে আসা ছাড়া উপায়ও ছিলো না। এ বিষয়ে নোয়া হারারি তাঁর ‘আনস্টপেবল আস’ বইতে লিখেছেন, “ধরুন, একদল প্রস্তর যুগের সংগ্রহকারী খাবার খুঁজতে গিয়ে মিষ্টি পাকা ডুমুরে ভরা একটি ডুমুর গাছের কাছে গেলো। কিছু মানুষ মাত্র কয়েকটি ডুমুর খেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বললো, “আমাদের জন্য এটাই যথেষ্ট। আমরা আমাদের শরীর নিয়ে সচেতন।” অন্যান্যরা এই কথাগুলোও বলতে পারলো না। কারণ তাদের মুখ ভর্তি তখন ডুমুরে। ডুমুর খেতে খেতে পেটকে প্রায় ফাটিয়ে ফেলেছে তারা। পরের দিন, সবাই আবার সেই গাছের কাছে ফিরে এলো মিষ্টি ডুমুরের লোভে। কিন্তু কোনো ডুমুর অবশিষ্ট ছিলো না। কারণ, এর মাঝে একদল বেবুন গাছটিকে খুঁজে পেয়েছে এবং সব ডুমুর তারা খেয়ে ফেলেছে। মানুষদের মধ্যে যারা প্রচুর ডুমুর খেয়েছিল তাদের পেট তখনও কিছুটা ভরা ছিলো। কিন্তু যারা শরীর সচেতনতার কারণে মাত্র কয়েকটা করে খেয়েছিল, তাদের এখন ক্ষুধার্ত থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
মিষ্টি জাতীয় খাবার আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর, এটা জানার পরেও যে মিষ্টি দেখলেই আমাদের অদম্য লোভ জাগে, সেটা এই অতীত ইতিহাস থেকে এসেছে। ওই সময় কোন দিন মিষ্টি খাবার জুটবে, আর কোন দিন জুটবে না, সেটা আমাদের পূর্বপুরুষরা জানতো না। ফলে, মিষ্টি জাতীয় কোনো খাবার তাদের সামনে এলেই তারা গোগ্রাসে গিলে নিতো। মিষ্টির প্রতি তাদের সেই আকর্ষণ এখনও আমরা আমাদের ডিএনএতে বহন করে নিয়ে চলেছি।
শিকারি-সংগ্রাহক যুগে খাবারের এই অপ্রাচুর্যের সময়ে নারীরা যে মেদবহুল ছিলো না, সেটা বলাই বাহুল্য। সেটা ছিলো না বলেই ওই যুগে স্বাস্থ্যবতী নারীদের আলাদা গুরুত্ব ছিলো। শরীরের মেদকে ধরা হতো স্বাস্থ্য এবং উর্বরতার প্রতীক হিসাবে। স্বাস্থ্যবতী নারীদের প্রতি এই প্রীতির মনোভাব দীর্ঘকাল পর্যন্ত পুরুষদের মধ্যে রয়ে গিয়েছে।
মজার বিষয় হচ্ছে বর্তমান পাশ্চাত্যে এই ধারণাটা কেউ গ্রহণ করতে রাজি হবে না। স্বাস্থ্যবতী নারীদের এখানে কোনভাবে সৌন্দর্যের প্রতীক হিসাবে দেখা হয় না। রেনি জেলওয়েগারকে ভোগ ম্যাগাজিনের কভার পেজ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো সামান্য কয়েক পাউন্ড ওজন বাড়ার কারণে। অনেক এয়ারলাইন তাদের এয়ারহোস্টেজদের ওজন বাড়ার কারণে ফায়ার করেছে এমন রেকর্ডও রয়েছে। সিমোন দ্য বোভোয়ার যেমন বলেছেন, কোনো পুরুষই একজন পৃথুলা নারীকে ভালবাসবে না।
সিমোন দ্য বোভোয়ারের এই ধারণা পাশ্চাত্যের জন্য হয়তো কিছুটা সত্যি, তবে সামগ্রিকভাবে সত্যি না। আমাদের দেশের বাংলা চলচ্চিত্রে একসময় স্থূলদেহী নায়িকারা দাপটের সাথে হলের পর্দা কাঁপিয়েছে। অঞ্জু ঘোষ থেকে শুরু করে ময়ূরী, মুনমুন, এঁরা সব এই কাতারে পড়েন। অনেকেই হয়তো বলবেন যে এদেরকে দেখতে রিকশাওয়ালারা যেতো, আমরা যেতাম না। এটা সত্যি কথা। ময়ূরী, মুনমুনদের দেখার জন্য একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষ হলে যেতো। এদের নাচ দেখে সিটি বাজাতো। যে শ্রেণী এই মেদবহুল নায়িকাদের পছন্দ করতো, তাদের সমাজের নারীদের দিকে তাকান। দেখবেন, তারা প্রায় সবাই মেদবিহীন, অপুষ্টিতে ভোগা নারী। ফলে, ওই সমাজের পুরুষদের কাছে মেদবহুল নারীই সৌন্দর্যের প্রতীক, কামনা-বাসনার বিষয়।
নাইজার অঞ্চলের কালাবারি গোত্রের কথাই ধরা যাক। এই সমাজে স্থূল শরীরের নারীদের সৌন্দর্যময়ী নারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সমাজের এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে মানুষের জীবনের কর্মকাণ্ডে। কিশোরী মেয়েদের মোটাতাজাকরণের এক বিশাল কর্মযজ্ঞ হয় এখানে।
বয়ঃসন্ধিক্ষণে পা দেবার সাথে সাথেই প্রতিটা মেয়েকে বাড়ি থেক দূরে স্থাপিত একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। এর নাম হচ্ছে মোটাতাজাকরণ ঘর। এখানে নেবার পরে এদের আলাদা করে যত্ন নেওয়া শুরু হয়। যতœ বলতে মূলত শর্করা এবং স্নেহজাতীয় খাবার গেলানো হয় মেয়েদেরকে। তাদের কোনো শারীরিক কর্মকাণ্ড করতে দেওয়া হয় না। শুয়ে বসে থাকা লাগে। এর সাথে আর যেটা করা হয় সেটা হচ্ছে সমাজের আকাঙ্ক্ষিত সৌন্দর্য এবং এটিকেট সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া। কিশোরী মেয়েদের সৌন্দর্যের পথে এই যাত্রাটা পরিচালিত হয় বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ নারীদের তত্ত¡াবধানে।
সৌন্দর্যের এই সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ধারণা থাকলে, শিকারি-সংগ্রাহক সময়ের প্রস্তর যুগের শিল্পীদের সৌন্দর্যবোধ সম্পর্কে ধারণা করা সহজ। সহজেই বুঝতে পারা যায় তাদের চোখে তাই ভেনাস আসলে কেমন হবে। ভেনাস অব ভিলেনডর্ফ তাই ব্যতিক্রম কিছু না। পঁচিশ-তিরিশ হাজার বছর আগে নারী দেহের সৌন্দর্যকে আমাদের পূর্ব-পুরুষরা যেভাবে দেখতে চাইতো, এই ভাস্কর্য বা ভাস্কর্যগুলোর মাধ্যমে সেটাই ফুটে উঠেছে।