অনলাইন ডেস্ক : নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্যের কারণে আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশি আমেরিকানদের সম্ভাবনা শুরুতেই হোঁচট খাচ্ছে। নিউজার্সির ঐতিহ্যবাহী নগরী প্যাটারসনে কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশি কমিউনিটির মানুষের ভিত্তি গড়ে উঠেছে। দিনে দিনে নগরীর রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের শক্ত অবস্থান দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল।
এরই মধ্যে বাংলাদেশিদের ঐক্য বিনষ্ট করতে দীর্ঘদিন ধরে লেগে থাকা অন্যান্য গোষ্ঠীর মদদ যেমন রয়েছে, তেমনি নানা কারণে নিজেদের অনৈক্য নগ্নভাবে প্রকাশ হতে শুরু করেছে।
প্যাটারসন সিটি কাউন্সিলের নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশি দুই প্রার্থীর বিরোধ নিয়ে সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। সুযোগ নিচ্ছে অন্যরা।
ভোট জালিয়াতির অভিযোগে নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের প্যাটারসন সিটি নির্বাচন আবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশি দুই প্রার্থীর একে অন্যের অভিযোগে ভোট গণনা হয়েছে তিনবার। প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশির বসবাস প্যাটারসন সিটিতে। বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে গত কয়েক বছর ধরে বেশ পরিচিত পেয়েছে শহরটি।
গত ১৯ মে অনুষ্ঠিত সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের প্যাটারসনের দুই নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলম্যান শাহীন খালিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রার্থী হন আরেক বাংলাদেশি আমেরিকান মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান। ভোট গণনা শেষে শাহীনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তিনি পান ১ হাজার ৭২৯ ভোট। অন্যদিকে তাঁর প্রতিদ্বন্দী মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান পান ১ হাজার ৭২১ ভোট। নির্বাচন কমিশনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে আবারও ভোট গণনার আবেদন জানান আক্তারুজ্জামান। দ্বিতীয়বারের গণনায় আক্তারুজ্জামানের ভোট বেড়ে যায়। তবে শাহীন খালিক এগিয়ে থাকেন তিন ভোটে।
এরপর আবারও গণনার অনুরোধ জানালে তৃতীয় দফায় দুজনের সমান ভোট হয়। এমন পরিস্থিতিতে ভোট নিয়ে নির্বাচন কমিশন সংশয়ে পড়ে যায়। নিউজার্সি স্টেট অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে ভোট নিয়ে প্রতারণা, ভোট ডাকাতি ও ভোট গণনার ফলাফল নিয়ে কারচুপির মামলা করা হয়। এই মামলার তদন্ত শুরু হয় ২৫ জুন। শাহীন খালিকের বড় ভাই সেলিম খালিক ও তার সমর্থক আবু রেজিয়েনসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে ভোট জালিয়াতির। তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এমন খবর যখন আমেরিকান গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
প্যাটারসন নগরী ঘুরে ও বাংলাদেশি আমেরিকানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই প্রার্থীর এমন বিরোধে তারা বিরক্ত। যারা কমিউনিটিতে সক্রিয় আছেন, তারাও বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। সাধারণ ভোটারদের সচেতন অংশ মনে করেন, এসবই করা হচ্ছে তৃতীয় পক্ষ থেকে। যারা চায় না বাংলাদেশিরা ঐক্যবদ্ধ হোক, তারাই এসবে ইন্ধন দিচ্ছে। বাংলাদেশিরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে অন্যদের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হবে—এমন আশঙ্কায় রাজনৈতিক খেলা খেলছে প্যাটারসনের রাজনীতির তৃতীয় শক্তিশালী একটি পক্ষ। এই পক্ষের পুতুল হয়েই বাংলাদেশিরা একে অন্যকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা করছেন বলে মনে করেন বাংলাদেশি আমেরিকান আমেনা বেগম।
তবে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ, নির্বাচনের নতুন তারিখ—এসব বিষয়ে কথা হয় শাহীন খালিকের বড় ভাই সেলিম খালিকের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আক্তারুজ্জামান সত্য–মিথ্যার মিশ্রণে একটি ভিডিও বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে। প্যাটারসন সিটি মেয়র আন্দ্রে সাইয়ারের সহযোগিতায় অভিযোগে করে, আমি একটি বাসা থেকে এক বা একাদিক ভোট সংগ্রহ করে কাউন্টি অফিসে জমা করি। অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। এমনকি আমেরিকান গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন বাংলা পত্রিকায় গ্রেপ্তারের খবরটি প্রকাশিত হয়, যা মোটেই সত্য নয়।
সেলিম বলেন, বাসা থেকে আমি কোন ভোট যখন সংগ্রহ করিনি, ‘সেখানে ক্যারিয়ার অংশ পূরণ করার প্রশ্নই আসে না। যেখানে পুরো বিষয়টিই মিথ্যা, সেখানে আমি গ্রেপ্তার হই কি করে? আমি কখনো গ্রেপ্তার হইনি এবং তার কোন সত্যতাও নেই। মিথ্যা গ্রেপ্তারের অপপ্রচার চালিয়ে আমাকে এবং আমার ছোট ভাই শাহিন খালিকের নির্বাচনী টিমকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নাজেহাল করার হীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আক্তারুজ্জামান।’
সেলিম খালিক বলেন, গত ১২ জুন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আক্তারুজ্জামানের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন বাসা থেকে ভোট সংগ্রহের ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ স্থানীয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খতিয়ে দেখছে। সে সব বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে এবং শাহিন খালিকের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে এবং আবু রেজওয়ানসহ শাহিনের নির্বাচনী টিমকে নাজেহাল করতে উঠে পড়ে লেগেছে তিনি।’
শাহিন খালিক তার কাউন্সিলের মেয়াদ থাকা অবস্থায় বাংলাদেশি কমিউনিটিসহ সব কমিউনিটির জন্য অনেক কাজ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে, প্যাটারসন সিটির পাবলিক স্কুলের মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য হালাল খাবারের ব্যবস্থা, প্যাটারসন সিটির ব্যস্ততম সড়ক বাংলাদেশ বুলেভার্ড হিসেবে নামকরণ এবং প্যাটারসন সিটির সব মসজিদে মাইকে আজানের ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া অন্যান্য কমিউনিটির উন্নয়নে গৃহীত নানা কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সেলিম খালিক অভিযোগ করেন, প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী আক্তারুজ্জামান ঈর্ষান্বিত হয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। সাধারণ ভোটারসহ প্যাটারসনবাসীর কাছে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে আসছে। ভোটের মাধ্যমে এর জবাব দিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে প্যাটারসনবাসী।
শাহিন খালিক নিজেও বলেন, কমিউনিটির কাজে তিনি হঠাৎ করে নামেননি। প্যাটারসনে বাংলাদেশিসহ সব কমিউনিটির লোকজন তাঁর কাজকর্ম সম্পর্কে জানেন। কারও প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই। তবে ষড়যন্ত্র করে, অন্যদের মদদে বাংলাদেশি আমেরিকানদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পরিণাম ভালো হবে না।
আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এসব নিয়ে মুখে সততার কথা বললে হবে না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু হয়েছে। যাদের নামে অভিযোগ এসেছে, তারাই বলতে পারবেন, প্রকৃত ঘটনা কী। এসব বিষয়ে তিনি মোটেই সংশ্লিষ্ট নন এবং কোন ইন্ধনেও নেই।