জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।
পঁচিশ.
বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতি হচ্ছে ভূমিজ। তারা নিজেরা মনে করেন তাদের পূর্বপুরুষদের প্রচুর ভূমি ছিল, তাই তাদের ভূমিজ বলা হয়। বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের রাজশাহীতে এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার চা-বাগানে তাদের বসবাস। ১৯৬০ দশকের মাঝামাঝিতে রাজশাহীর দারশায় সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে অন্যান্য আদিবাসীর সঙ্গে ব্যাপক সংখ্যক ভূমিজরা দেশান্তরী হওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলে ভূমিজের সংখ্যা এখন হাতে গোনা; তবে বৃহত্তর সিলেটের চা-বাগানে তারা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বসবাস করেন। চা-বাগানে ভূমিজদের পাশাপাশি বাস করেন সাঁওতাল ছাড়াও খাড়িয়া, গোয়ালা, বাউড়ী, বানাই, বোনাজ, রাজভড়সহ বিভিন্ন জাতির মানুষ।
পরিবারের ধরন : ভূমিজ পরিবার পিতৃসূত্রীয়। অর্থাৎ সম্পত্তি ও বংশ-নাম পিতৃধারায় হয়, পিতা থেকে পুত্রে বর্তায়। পরিবারে সব ক্ষমতা স্বামীর হাতে অথবা বয়স্ক পুরুষের হাতে থাকে। ভূমিজরা সাধারণত যৌথ বা বর্ধিত পরিবারে বসবাস করেন। একান্নবর্তী পরিবারে একাধিক ভাই-বোন, বাবা-মা পাশাপাশি বসবাস করেন। একক পরিবার খুব একটা দেখা যায় না।
জীবিকা: পরিবারে স্বামী ও স্ত্রী উভয়েই কাজ করেন। নারী রা সংসারের বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি বাগানে কাজ করেন। তবে এই সমাজের পুরুষরা কৃষিকাজ করেন নারীরা করেন না।
ধর্ম : ভূমিজরা প্রকৃতি পূজারী ছিলেন। কালক্রমে এবং সময়ের পরিক্রমায় হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানের প্রভাবে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় আচারগুলি এখন বিলুপ্ত প্রায়। বর্তমানে ভূমিজরা নিজেদেরকে সনাতন ধর্মাবলম্বী বলে মনে করেন। তারা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করেন। তাদের প্রধান ধমীয় উৎসব হচ্ছে দুর্গা পূজা। তাদের প্রধান দেবদেবী হল: ল²ী, কালী, শনি প্রভৃতি। তাদের পূজা-পার্বণে পৌরহিত্য করেন হিন্দু ব্রাহ্মণ। ভূমিজরা শুধুমাত্র তাদের ঐতিহ্যবাহী দেবদেবীদের পূজার সময়ই তাদের নিজেদের পুরোহিতকে আমন্ত্রণ জানান। সেই পুরোহিতকে তারা ‘লাভা’ নামে অভিহিত করেন। কালি পূজায় তারা ঝুমুর সংগীতের আয়োজন করেন।
সামর্থ্যানুযায়ী তারা প্রয়াগ, কাশী, গয়া প্রভৃতি তীর্থস্থানে যেতে চান। দেবদেবীর উপাসনার পাশাপাশি তারা তাদের আদি ধর্মবিশ্বাসের কিছু কিছু ঐতিহ্যকেও লালন করে চলেছেন। পূর্বে তারা বরম দেওতা, ধরম দেওতা, সিংবোঙ্গা, জাহুবোড়া প্রভৃতি দেবতার পূজা করতেন। ভূমিজরা তাদের গ্রামদেবতাকে অভিহিত করেন বরম দেওতা নামে। গ্রামদেবতার দায়িত্ব হচ্ছে গ্রামের নিরাপত্তা রক্ষা করা। ভূমিজদের অন্যতম প্রধান দেবতা সিংবোঙ্গা এবং ধরম দেওতা, যাদের কাজ হচ্ছে সৃষ্টিকুলকে রক্ষা করা এবং মানুষের কল্যাণ সাধন করা। দেবতাদের পূজায় পাঁঠা এবং মোরগ উৎসর্গ করতে হয়। এসবের পাশাপাশি তারা নামযজ্ঞ ও হরিনাম সংকীর্তন-এর আয়োজন করেন। রোগব্যাধি নিরাময়ের ক্ষেত্রেও হরিনাম সংকীর্তনের প্রচলন রয়েছে। রোগীর পাশে সমবেত হয়ে রামায়ন-মহাভারত পাঠ করতেও দেখা যায়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে পুরুষরা ধুতি-পাঞ্জাবী ও মেয়েরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরেন। ধর্মীয় বিশ্বাস ভূমিজদের মধ্যে প্রবল।
বিবাহ : এ সমাজে বাবা-মার পছন্দ অনুযায়ী সন্তানদের বিয়ে হয়ে থাকে। একই গোত্রে বিয়ে হয় না। আগে বাল্যবিবাহের প্রচলন থাকলেও এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। এ সমাজে ছেলেদের বিয়ের বয়স ২০-৩০ এবং মেয়েদের ষোল বছরের অধিক হলেই অভিভাবকরা তাদের সন্তানরা বিবাহযোগ্য হয়েছে বলে মনে করেন এবং এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আত্মীয়ের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়, ঘটক ডাকা হয় না। বিয়ের তিনদিন আগে ছেলে-মেয়েকে হলুদ লাগানো হয়। এ সময় মেয়ের জন্য সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ এবং রুপা বা সোনার কানের দুল, নাকফুল, টিকলি, চুড়ি ইত্যাদি পাঠানো হয়। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার শুরুতে পূর্বপুরুষের মঙ্গল কামনায় এবং তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের শুভ কামনায় আদ্যশ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে। এ সমাজে কোন যৌতুক প্রথার বিধান নেই। তবে, বিধবা বিবাহের প্রচলন না থাকলেও এখন হচ্ছে।
শ্রেণিকক্ষে ভূমিজ শিশুরা
সামাজিক উৎসব : পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের পালনের রীতি তাদের অন্যতম জনপ্রিয় ও সামাজিক উৎসব। এদিন সারা গ্রাম ঘুরে হরিনাম সংকীর্তন করা হয়। নতুন ফসল তোলা উপলক্ষে নবান্ন উৎসব পালিত হয়। পৌষ সংক্রান্তিতে ভূমিজরা টুসু পর্ব পালন করেন। পৌষ-পার্বণ উপলক্ষে মেয়েরা টুসু গান পরিবেশন করেন। এই উৎসবে তারা বিভিন্ন ধরনের নকশী পিঠা তৈরি ক’রে পাড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে একসঙ্গে বসে খান। ভাদ্রমাসে তারা কারাম উৎসব পালন করেন। কারাম উৎসবে আবালবৃদ্ধবণিতা সবাই মিলে কয়েকদিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী নাচগান পরিবেশন করেন। এ উৎসবে তরুণ-তরুণীদের মন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারও ঘটে। উৎসবাদিতে হাড়িয়ার প্রচলন আছে।
আসবাবপত্র : ভূমিজদের গৃহে তেমন আসবারপত্র নেই। কিছুটা স্বচ্ছল পরিবারে চৌকি, খাট, লেপ, তোষক, বালিশ, বিছানার চাদর, চেয়ার, টেবিল, টেবিল ক্লথ ইত্যাদির ব্যবহার আছে। দরিদ্র পরিবারে বসার জন্য মাদুর, টুল ও পিঁড়ির ব্যবহার আছে। প্লেট, থাল, বদনা, লোটা, হাঁড়ি-পাতিল তারা ব্যবহার করেন। এইগুলো সাধারণত পিতল, কাঁসা, এলুমিনিয়াম, স্টিল ও কাঁচের তৈরি। মাটির বাসন নেই। পিতল ও কাসার ব্যবহারও ইদানিং কমে যাচ্ছে।
খাদ্য : ভূমিজদের প্রধান খাদ্য হচ্ছে মাছ ও ভাত। ভূমিজরা মৃত পশুর মাংস খান না, গরুর মাংস তাদের নিকট নিষিদ্ধ। ভাতের সঙ্গে তারা নানাবিধ শাক-সবজি, ডিম, ডাল প্রভৃতি আহার করেন। সব ধরনের ডাল যেমন মুগ, মশুর, অড়হর, বুটের ডাল তাদের নিকট প্রিয়। তবে অড়হরের ডাল প্রাত্যহিক খাবারের মধ্যে থাকে। শাক-সবজির মধ্যে ঢেঁকী শাক তাদের নিকট প্রিয়। বিভিন্ন জাতের বন্য-আলুও তাদের প্রিয় খাদ্য। দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্যাদিও তারা বেশ পছন্দ করেন। নিয়মিত চা পান করেন। পান-সুপারী তাদের খুব পছন্দের। মাঝে মাঝে হাড়িয়া পান করেন। পুরুষরা প্রায় সবাই পান করেন, তবে নারীদের মধ্যে হাঁড়িয়ার ব্যবহার কম।
লোক-সংস্কৃতি ও চর্চা : ভূমিজদের সামাজিক উৎসবাদিতে নাচ ও গানের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। তারা তাদের এসব ঐতিহ্যবাহী নৃত্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অংশগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই তারা মা-বাবার কাছ থেকেই নাচতে ও গাইতে শিখেন। বিভিন্ন উৎসবে নারী-পুরুষ সকলে মিলে নৃত্যসহযোগে তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী লোকগাঁথা পরিবেশন করেন। বাদ্য যন্ত্রের মধ্যে তারা ঢোল, কাসি, খোল, করতাল, বাঁশি ইত্যাদি ব্যবহার করেন। খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারেন এমন বংশীবাদক ভূমিজদের মধ্যে রয়েছে।
মৃত্যু : ভূমিজরা মৃতদেহকে দাহ করেন। ছয় মাসের কমবয়সী ছেলেমেয়েদের তারা কবরস্থ করেন। মৃতদেহটিকে ¯œান করানোর পর নতুন কাপড় পরিয়ে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের রীতি অনুযায়ী প্রচলিত ধর্মীয় সংকীর্তন গাইতে গাইতে শ্মশানে নিয়ে যান। খোল-করতাল সহযোগে হরিনাম সংকীর্তন-এর মাধ্যমে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের আবির্ভাব ঘটে থাকে। হিন্দু ব্রাহ্মণের উপস্থিতিতে মৃতদেহটিকে চিতায় ওঠানো হলে, মৃত ব্যক্তির বড়ছেলে অথবা ছোট ছেলে মুখাগ্নি করেন এবং চিতা জালিয়ে দেন এবং সে সময় মন্ত্রও পড়া হয়ে থাকে। মৃতব্যক্তির পরিবারের সবাই এবং নিকটাত্মীয়রা এগারোদিন অশৌচ পালন করেন। অশৌচাবস্থা চলাকালে মৃতব্যক্তির ছেলেদের বিভিন্ন ধরনের নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়, যেমন: খালি পায়ে থাকেন, মাটিতে ঘুমান, কুআসনে বসেন। রোদে বা বৃষ্টিতে তখন ছাতা ব্যবহার করা যায় না। লবণ ও মসলা ছাড়া সিদ্ধ হবিষ্যান্ন গ্রহণ করতে হয়। মৃত্যুর এগারো দিন পর মৃতব্যক্তির আত্মার শান্তি লাভের জন্য পারলৌকিক ক্রিয়া বা শ্রাদ্ধকর্ম সম্পন্ন করা হয় এবং এ উপলক্ষে ব্রাহ্মণদের ডেকে খাওয়ানো হয়। ভোজনের পর ব্রাহ্মণদের অনুমতি নিয়েই মৃতব্যক্তির পুত্ররা স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসেন এবং স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ শুরু করেন। মৃতদেহ চিতায় দাহ করার পরে সেখান থেকে পুড়ে না যাওয়া কিছু অস্থি সংগ্রহ করে মৃতব্যক্তির ছেলেরা বাঁশের চোঙ্গায় ভরে শ্মশানের কাছাকাছি তুলসী গাছের নিচে কয়েকদিনের জন্য পুঁতে রাখেন এবং মনে করেন পরে সুযোগ মতো তীর্থক্ষেত্রে গঙ্গায় অথবা নদীতে বিসর্জন দেয়া যাবে। যদি এটি করা না যায় তাহলে ভূমিজরা তাদের পূর্বপুরুষদের পিণ্ড কাছাকাছি যে কোনো নদীতীরে তর্পণ করেন।
তথ্যসূত্র :
জান্নাত-এ-ফেরদৌসি, বৃতি সুন্দর গাইন ‘ভূমিজ’ প্রকাশিত হয়েছে মেসবাহ কামাল সম্পাদিত বাংলাদেশের আদিবাসী এথনোগ্রাফীয় গবেষণা (তৃতীয় খণ্ড), উৎস প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০
Chattapadhyaya. Annapurna. The People and Culture of Bengal: A Study in Origins Vol I, Farma Klm Private Limited, Kalkata, 2002. ছবি: ইণ্টারনেট