জান্নাত-এ-ফেরদৌসী : জাতি বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি ছাড়া আটাত্তরটি জাতির বসবাস এই দেশে। এদের জনসংখ্যা বর্তমানে ত্রিশ লাখের বেশি। এদের বেশির ভাগেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি আর জীবনবোধ। বাংলাদেশের স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (RDC) এর সাধারণ সম্পাদক এবং সঙ্গীত শিল্পী ও গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী দেড় যুগের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে। বাংলাদেশের পঞ্চাশটি জাতি নিয়ে তাঁর গবেষণালব্ধ লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকদের জন্য।

সাত.

বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিপুরা অন্যতম। বাংলাদেশে পার্বত্য চট্রগ্রাম, চট্রগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, ফরিদপুর ও ঢাকা জেলায় লক্ষাধিকের উপর ত্রিপুরা স্মরণাতীত কাল থেকে বসবাস করে আসছেন।

পরিবার ও উত্তরাধিকার : ত্রিপুরা সমাজব্যবস্থায় পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থা বিদ্যমান। পরিবারে মাতার স্থান দ্বিতীয়। পরিবারে পিতার সিদ্ধান্ত সবাই মেনে নেয়। পিতার অনুপস্থিতিতে পরিবারের বড় ছেলে কর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্পত্তির বিভাজনে দেখা যায়, পিতার সম্পত্তি লাভ করেন পুত্রগণ এবং মায়ের সম্পত্তি পান কন্যাগণ।

সমাজ ব্যবস্থা : ত্রিপুরা সমাজ ব্যবস্থা অন্যান্য আদিবাসীর মতই সুদৃঢ়। তারা রাজাকে সবার উর্ধ্বে স্থান দেন। তবে স্থানীয় বিচার ব্যবস্থা, অনুষ্ঠানাদিসহ গোত্রের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার জন্য একজন সমাজ প্রধান বা বিচারপতিকে নির্বাচন করা হয়। সকল ক্ষেত্রে সমাজ প্রধান এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

ধর্ম পালন : ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার অনুষ্ঠানাদি পালন করেন। তারা সনাতন ধর্মের অনুসারী। তবে কিছু লোক খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। ত্রিপুরারা ১৪ জন দেবদেবীর পূজা করেন। তাদের প্রধান দেবতা হচ্ছে শিব এবং দেবীদের মধ্যে রয়েছে মহাকালী। ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার চতুর্দশ দেবমন্দির পৃথিবীখ্যাত। তারা মাইলংমা, সাতবোন বুড়িরক, মাতাই কতর, খুঁই জংমা কালিপূঁজাসহ প্রভৃতি দেবদেবীর পূজা করেন।

পোশাক পরিচ্ছেদ : ত্রিপুরা পুরুষেরা নিজেদের তাঁতে বোনা গামছা এবং ধূতি পরিধান করেন। তারা মাথায় সাদা কাপড়ও পরেন। বয়নশিল্পে ত্রিপুরা রমণীদের স্থান সবার উপরে। নারীরা লালের উপর কালো রঙের বর্ডারের রিনাই পরিধান করেন। তারা শরীরের উপরের অংশে রিসা পরিধান করেন। রিনাই ও রিসা ত্রিপুরা রমণীদের জাতীয় পোশাক।

নৃত্যরত ত্রিপুরা তরুণীগণ

উৎসব অনুষ্ঠান : ত্রিপুরাদের প্রধান জাতীয় উৎসব বৈসু উৎসব ত্রিপুরাব্দের তাললাং মাসের ৩০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। বৈসু উৎসবের তিনটি তাৎপযের্র প্রথমটি, তাললাং মাসের (শকাব্দের চৈত্র) ৩০ তারিখে রাষ্ট্রীয়ভাবে ত্রিপুরাব্দ বর্ষপঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়েছিল। দ্বিতীয়টি, বিষুসংক্রান্তি লগ্নে দিনরাত্রি সমান হয় এবং এদিন অতিশয় পূণ্যময় দিন। তৃতীয়ত, বৈসু উৎসব দিনগুলিতে গরিয়া (কর্ম ও প্রেমের দেবতা) নৃত্য উৎসব হয়। উদ্দিপনা ও শক্তি সঞ্চয় করার জন্য এগুলো পালন করা হয়। সিমতুং নৃত্য খুবই হৃদয়গ্রাহী, আবেগময় এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি প্রয়াত পিতৃপুরুষদের স্মরণে পরলৌকিক মঙ্গল কামনায় হয়ে থাকে। অবিবাহিত ত্রিপুরা নারীরা সমতুং পূজার মাধ্যমে শ্রী ও সৌন্দর্য কামনা করে ¯্রােতবাহী নদীতে মাঙ্গলিক প্রদীপ ভাসিয়ে দেন। বৈসু উৎসব কেবলমাত্র বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ সর্বস্ব নয় এর সাথে লোকাচার ও ধর্মীয় অনুভূতিও সম্পৃক্ত রয়েছে। তিনদিন ধরে চালিত অনুষ্ঠানে পুরোনো বছরের শেষ দু’দিন যথাক্রমে ২৯ চৈত্র হারিবৈসু, ৩০ চৈত্র বিসুমা এবং পহেলা বৈশাখ ‘বিসিকাতাল’ এ তিন নামে নামাঙ্কিত হয়। হারিবৈসু এ পর্বকে মূলত জীবজগত ও প্রকৃতিপুঞ্জের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন পর্ব বলা হয়। তিন দিনের ‘হারিবৈসুর’ উৎসবে গবাদি পশুপাখির সেবা পরিচর্যা, উন্নতমানের খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ এবং চন্দন পানি দিয়ে গবাদি পশুদের স্নান করানো হয়। পুষ্পমালা পরিয়ে দিয়ে, ধূপ দীপ জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো হয় এবং অতীতের সমস্ত প্রকার অপরাধমূলক কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। এ দিনে নিম-আ¤্র পল্লব, দুর্বা ও পুষ্প দিয়ে ঘরদোর সাজানো হয়। ত্রিপুরা ‘তন্ত্রসার’ শাস্ত্রে নিম, আ¤্র, ডুমুর, বট ও অশ্বত্থ বৃক্ষের পল্লবকে শান্তির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দুর্বাকে অমরত্বের প্রতীক, পুষ্পকে ভক্তির প্রতীক এবং পান-সুপারি দ্রব্যকে কল্যাণের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হারি বৈসুর দিনে ত্রিপুরা জনগণ সৃষ্টিকর্তার প্রীতিকামনা করে সকাল বেলা নদীর ঘাটে কাদামাটিও বালুর বেদী তৈরি করে থাকে। ‘খুমকামুং’ পূজার মাধ্যমে ত্রিপুরা জনজীবনে একটি হৃদয়গ্রাহী নৃত্যানুষ্ঠান প্রচলিত রয়েছে। এ দিনের সন্ধ্যাকালে ত্রিপুরা জনগণ প্রয়াতদের আত্মার শান্তি, সদগতি এবং প্রেমের স্বার্থকর্তা কামনা করে মাঙ্গলিক প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেন। এর নাম ‘সিমতুং’ পূজা। কোনো স্রোতম্বিনী ত্রিপুরী যুবক-যুবতী, কিশোর-কিশোরীগণ পবিত্র কাপড় পরিধান করে তাদের অভিষ্ট কামনার কথা সংকল্প করে, কলা পাতা কিংবা কাঁঠাল পাতার ঠোঙ্গা বানিয়ে তাতে তৈলের প্রদীপ জ্বালিয়ে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়। প্রদীপ ভাসানোর সময় ঢোলের বোলে বাজানো হয় ধীর লয়ে কার্ফা। আবেগে আপ্লুত হয় মানুষের মন। শত সহস্র প্রজ্জ্বলিত মাঙ্গলিক প্রদীপ নদীতে ভাসানোর ফলে এ সময় নদীর সান্ধ্যকালীন রূপ হয়ে উঠে অপরূপ। এদিনে গৃহিণীরা অতিথিদের জন্য মদ তৈরি করেন। বিত্তশালীরা দান করেন, যাতে গরিব লোকেরা উৎসব ভাল মতো পালন করতে পারেন। এ দিনে গড়িয়া পূজা (কৃষিপূজা) ও নৃত্যের যাত্রা শুরু হয়। বাঁশ ও বেত শিল্প ও খেলাধুলা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। যারা গরিব, যাদের অতিথি আপ্যায়ন করার মতো সামর্থ্য নেই তারা হারি বৈসুর দিনে অতিথিদের জন্য স্রোতবাহী নদী থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করেন। বিসুমার দিনে জল সংগ্রহ করা দোষণীয়।

বিসুমা এ পর্বকে সংযম ও ত্যাগের পর্ব বলা হয়। এই বিশেষ দিনে বিভিন্ন নিয়ম পালন করা হয়: কায়িক পরিশ্রম না করা, মিথ্যা কথা না বলা, তামসিক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা, কোনো কিছু ছেদন করে না, মাটি না কোপানো, বাঁশ তরুলতা ছেদন না করা প্রাণী শিকার না করা ইত্যাদি। দৈহিক, মানসিক ও সামগ্রিকভাবে মঙ্গলের জন্য এ দিনে উপাসনা করা হয়। নিরামিষ ভোজের আয়োজন করা হয় সাথে ‘পাচন’ তরকারি। পাচন তরকারির অপরিহার্য সবজিগুলির মধ্যে রয়েছে- শিমুল ফুল, একজাতীয় উদ্ভিদ তারা, কার্টুস, বনআলু, বেতের কচিডগা, ডুমুরফল, কলাগাছের কচি বাকল, কলাথোর, বন্যবেগুন, ‘ব্রিং’ গাছের শিকড়, চালতা, খগ্রং, কলমা, ওল, থাইপাক ফল, শুকনা মুলা, কচি কাঁঠাল, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টিআলু, সিমেরবীচি, পেঁপে, সজিনা, কাঁচকলা, মটর, দেশীআলু, কপি, বরবটি, মুগডাল, সরিয়া বাটাসহ যাবতীয় মৌসুমী সবজি। পাচন তরকারিতে কাঁচাহলুদ ও কাঁচামরিচ ব্যবহার করা হয়। কোনো প্রকার প্রাণীজ উপাদান ব্যবহার করা হয় না। ত্রিপুরীদের এ বিশ্বাস বদ্ধমূল যে, বিসিকাতাল অর্থাৎ শুভ নববর্ষের দিনে কেউ খালি মুখে ফিরে গেলে সারা বছরের জন্য গৃহস্থের অমঙ্গল হয়। তাই এ দিনে দিবা-রাত্রি ঘরের দরজা খোলা থাকে। এরা স্বাধীনচেতা, ক‚টনীতিপরায়ণ, শান্তিপ্রিয় ও অতিশয় অতিথিপরায়ণ। খাবারের মধ্যে মাংস ও মদ প্রিয় এবং পশু শিকারে খুব পটু।

কের উৎসব: কের শব্দের অর্থ হয় গণ্ডি বা বেষ্টনী দেওয়া। প্রতি বছর ত্রিপুরাব্দের তালতুক মাসের (শকাব্দের শ্রাবণ) কৃষ্ণপক্ষের প্রথম সংগ্রং ও চবা (শনি ও মঙ্গল) দিনে কের পূজা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সমস্ত প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী এবং শক্রর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্যে কের পূজা উৎসব হয়ে থাকে। এটি একটি সার্বজনীন বারোয়ারী পূজা উৎসব। এছাড়াও, গোমতী পূজা উৎসব, সিবরাইপূজা উৎসব, খার্চীপূজা উৎসব, হাবা উৎসব, রাজপুণ্যাহ উৎসব, চুমলাই উৎসব ইত্যাদি হয়ে থাকে।

বিবাহ ব্যবস্থা :
ত্রিপুরা সমাজে ছেলে-মেয়েরা স্থায়ী বন্ধনের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এই সমাজে প্রেম করে বিয়ে হয়। তারা যদি পালিয়ে বিয়ে করেন পরবর্তীতে অভিভাবকদের সম্মতিতে বিয়ে মেনে নেয়ার সংস্কৃতি ত্রিপুরা সমাজে রয়েছে।

খাবার ও পানীয় : মাছ, মাংস, দুধ, শাক সবজি, ডাল, কচি বাঁশ ইত্যাদি খাবার হিসেবে গ্রহণ করেন। মাংস হিসেবে শকুরের মাংস খুব প্রিয়। পারিবারিক অনুষ্ঠানে সবাই মিলে মদ খাওয়ার রীতিও প্রচলিত আছে।

অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া : মৃত ব্যক্তিকে ঘরের বাইরে রাখা হয় এবং মৃতের শিয়রে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়। মৃত্যুর পরদিন শশ্মানে নিয়ে দাহ করা হয় এবং একমাস পরে ছাইভস্ম মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়।

তথ্যসূত্র : মেসবাহ কামাল, জাহিদুল ইসলাম, সুগত চাকমা সম্পাদিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৭।
খুরশীদ আলম সাগর, বাংলাদেশের আদিবাসীদের কথা, পত্রপুট, ঢাকা, ২০০৮।
Chattapadhyaya. Annapurna. The People and Culture of Bengal: A Studz in Origins Vol I, Farma Klm Private Limited, Kalkata, 2002.
ছবি: ইণ্টারনেট