আবু এন. এম. ওয়াহিদ : যাঁর কথা দিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই তিনি একজন মিসরীয় অধ্যাপক, নারী অর্থনীতিবিদ। তাঁর নাম, ড. সামার আল্ মুফ্তি। ১৯৮৮-৮৯ সালে অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসার পদে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন ইস্টার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে। আমি তখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। শিকতায় প্রতিটি জব ইন্টারভিউতে তিন-চারটি পর্ব থাকে। তারমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হলো সেমিনার প্রেজেন্টেশন। ইন্টারভিউর দিন বাছাইকমিটি, ডিপার্টমেন্টের হেড, কলেজের ডিন এবং সকল ফ্যাকাল্টির সাথে আলাদা আলাদা সাাতের পর শেষপর্বে বিকেল বেলা সেমিনার রুমের পডিয়ামে গিয়ে দাঁড়ালেন ড. ম্ফ্ুিত। শ্রোতা-দর্শকদের গ্যালারিতে বসলাম আমরা ডিপার্টমেন্টের সব শিক। তাঁর সেমিনারের টাইটেলটি কী ছিল তা মনে পড়ছে না, তবে এটুকু মনে আছে ড. মুফতির পুরো বক্তব্য জুড়ে ছিল নারী-পুরুষের বিবাহিত জীবনের সুখদুঃখের কাহিনি। আরো ছিল তাক লাগানো কিছু পরিসংখ্যানের ছড়াছড়ি এবং গভীর বিশ্লেষণ।

ড. মুফতি তাঁর গবেষণার ফলাফল বলতে গিয়ে বলেছিলেন, পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, গড়ে বিবাহিত পুরুষ অবিবাহিত পুরুষের চেয়ে বেশিদিন বাঁচে, কিন্তু নারীর বেলা তাঁর গবেষণার ফল ঠিক উল্টো। অর্থাৎ নারী বিয়ে করলে তার আয়ু কমে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে – বিবাহিত নারী অবিবাহিত নারীর চেয়ে কম দিন বাঁচে। নিজে নারী হয়ে ড. ম্ফ্ুিত তাঁর উপস্থাপনার এক পর্যায়ে বেশ আবেগমাখা কন্ঠে বলেছিলেন, ‘ম্যান প্রফিটস ফ্রম মেরেজ, হোয়াইল উয়োম্যান সাফারস ফ্রম ইট’। অন্যভাবে বলতে গেলে, ‘পুরুষ বিয়েতে লাভবান হয় এবং নারী হয় তিগ্রস্ত’। কথাটা আমি প্রথমবারের মতো শোনে অবাক হয়েছিলাম! আমার মনে তখনই প্রশ্ন জেগেছিল, কেন এমন হবে? অনেক ঘাঁটাঘাঁটির পর আজো সে প্রশ্নের উত্তর পাইনি।

বিষয়টি আমাকে আবার নতুন করে ভাবিয়ে তুললো এই সেদিন, যেদিন এ বিষয়ে ‘উইএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ড রিপোর্ট’-এর জনৈক প্রতিবেদক ‘ফিলিপ মোয়েলার’-এর লেখাটা পড়ছিলাম। মোয়েলার সামার আল মুফ্তির ২৩ বছরের পুরনো প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে বিবাহিত জীবনের দুখদুঃখ নিয়ে ছেপেছেন এক সুন্দর সংবাদভাষ্য। এখানে মোয়েলার ভিন্ন সুরে বলছেন অন্য কথা। তাঁর কথার সমর্থনে তিনি আমেরিকার বড় বড় সমাজবিজ্ঞানীদের যুক্তি এবং তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেছেন। সব মিলিয়ে মোয়েলারের কথাগুলোও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এবার দেখা যাক, তিনি এবং তাঁর পছন্দের বিজ্ঞানীরা বিয়ে নিয়ে কী বলছেন কিংবা নতুন কিছু বলছেন কি না যা আমরা কেউ জানি না।

মোয়েলারের লেখার শিরোনাম হচ্ছে, ‘বিয়ে করে মানুষ কেন সুখী হয়’? উপ-শিরোনামে তিনি সংক্ষেপে বলছেন, স্বামী-স্ত্রীর অন্তরঙ্গতা, পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতা এবং দৈনন্দিন কাজ ভাগাভাগি করে নেওয়ার কারণে দু’জনেই মোটামুটি সমানভাবেই সুখী হয় এবং এতে দু’জনেরই আয়ু বেড়ে যায়। শুরুতে মোয়েলার বলছেন, পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছে যাদের মা-বাবা, ছেলেমেয়ে, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। তাদের কাছে বিয়েই একমাত্র সম্পর্ক এবং স্পাউসই (ইংরেজিতে স্পাউস বলতে স্বামী স্ত্রী উভয়কেই বোঝায়) তাদের একমাত্র অন্তরঙ্গ সঙ্গী। এ রকম মানুষের জন্য বিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন – বলতে গেলে একমাত্র অবলম্বন। আর তারা জীবনে যেটুকু সুখশান্তি পায় তার পুরোটারই বিয়ে এবং বিবাহিতজীবন থেকে উৎসারিত। মোয়েলার তাঁর নিবন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ওয়েক ফরেন্ট ইউনিভার্সিটি’-র সমাজতত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ‘রবিন সাইমন’-এর উদ্ধৃৃতি দিয়েছেন। রবিন সাইমন বলছেন, ‘শরীর ও মনের সুস্থতার সকল সূচকেই দেখা যায়, বিবাহিত নারী-পুরুষ অবিবাহিতদের থেকে এগিয়ে আছে। তারা বেশিদিন বাঁচেও। সাইমনের গবেষণায় আরেকটি তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যায়, অসুস্থ হলেও বিবাহিত নারী-পুরুষ অবিবাহিতদের চেয়ে তাড়াতাড়ি সেরে ওঠে।

মানসিক এবং আবেগজনীত ব্যাপার ছাড়াও বিয়ের কতগুলো বৈষয়িক সুবিধা আছে যা ইউরোপ আমেরিকায় মানুষ হরহামেশা ভোগ করে থাকে। বাংলাদেশে আজকাল সেগুলো কতটা প্রযোজ্য তা আমি সঠিক জানি না, তবে পাশ্চাত্য দেশে বিবাহিত নারী-পুরুষ রাষ্ট ও সরকার থেকে কয়েকটি বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকে। প্রথমতঃ স্পাউসদেরকে রাষ্ট্র সম্পত্তিতে সমান আইনী অধিকার, হেলথ ইনস্যুর‌্যান্স এবং ফেডার‌্যাল ও স্টেট ইনকাম ট্যাক্সে বেশ কিছু সুবিধা দিয়ে থাকে, যা থেকে অবিবাহিতরা বঞ্চিত হয়ে আছে। দ্বিতীয়তঃ বৈবাহিক বন্ধনের কারণে সমাজে স্পাউসদের যে সামাজিক মানমর্যাদা থাকে অবিবাহিতরা কিংবা বিবাহবিচ্ছেদকারীরা সেই মর্যাদা পায় না।

তৃতীয়তঃ অন্তরঙ্গতার কারণে, স্পাউসরা নিজেদের মধ্যে দুঃখ ভাগ করে নেয়, তাই সেটা অনেকাংশে কমে যায়, আবার আনন্দ উপভোগের সময় যেহেতু তারা একসঙ্গে ফুর্তি করে থাকে তাই সেটা আবার বেড়ে যায় বহুগুণে। এতে দেখা যায়, অবিবাহিতের তুলনায় বিবাহিতদের জীবন একটা উইন-উইন সিসিুয়েশনের মধ্যে অবস্থান করে। এতে তাদের উভয়েরই মন ও শরীর সুস্থ থাকে। চতুর্থতঃ সমাজে বসবাসকারী নারী-পুরুষ হিসেবে আপন পরিবারের বাইরে দু’জন স্পাউসেরই পৃথক পৃথক দুটো আর্থ-সামাজিক বলয় থাকা স্বাভাবিক। কারণ দু’জনেরই শেকড় পরিবারের ও নিজেদের বাইরেও বিস্তৃত থাকে। সেখান থেকেও তারা দু’জনই দুজনের জন্য বাড়তি বৈষয়িক এবং ইমোশনাল সুবিধা আদায় করে থাকে। এতে দু’জনেরই সামাজিক সম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পায়, আরো জোরদার হয়। এ জন্য জীবনে তাদের স্ট্রেস-টেনশন কমে, অধিক নিরাপত্তা আসে। তাই বিয়ে করলে এবং বিবাহিতজীবন সুন্দর ও সঠিকভাবে ধরে রাখতে পারলে দু’জনেরই মঙ্গল। এর কোনোটাতেই তেমন কোনো বিতর্ক নেই, কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে কোন নারী কোন পুরুষের জন্য বা কোন পুরুষ কোন নারীর জন্য যুতসই এবং কোন বিয়ে সফল হবে, কোনটা টিকবে না, এ ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছে বিস্তর মতভেদ ও মতবিরোধ।

ইদানীং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিবাহবিচ্ছেদ কিছুটা কমেছে তারপরও বিখ্যাত ‘জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়’-এর সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ‘অ্যান্ড্রু শার্লিন’ বলছেন, ‘শতকরা মাত্র ৫০ থেকে ৬০ ভাগ বিয়ে টিকে, বাকিগুলো স্পাউসদের জীবদ্দশায় কোনো না কোনো সময়ে ভেঙে যায়। যে ৫০/৬০ শতাংশ বিয়ে টিকে থাকে সেগুলোও যে সব সফল এবং সুখী বিয়ে তা কিন্তু একবোরেই বলা যায় না’। শার্লিনের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, কলেজপড়–য়া নারী-পুরুষের মাঝে বিয়ে সুখের হয় এবং টিকে বেশি। যাদের লেখাপড়া কম তাদের সন্তান বেশি হয়, বিয়ে অসুখী হয়, জীবনে অভাব-অনটন ও স্ট্র্রেস-টেনশন অত্যধিক থাকে এবং এ-সব বিয়েতে ভাঙনের হারও বেশি।

অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, আমেরিকায় ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেরিতে বিয়ের প্রবণতা আজকাল বাড়ছে। এখন মিডিয়ান পুরুষের প্রথম বিয়ে হচ্ছে সাড়ে ২৭ বছর বয়সে এবং নারীরা বিয়ে করছে সাড়ে ২৫ বছরে। বিয়ের পরও নারীরা সন্তান ধারণের বাপারে আগের চেয়ে বেশি সাবধানতা অবলম্বন করছে এবং বেশি দেরি করছে। বিয়ের সময় নারী-পুরুষের বয়সের ব্যবধানও আজকাল অনেক কমে আসছে।

বিবাহিত দম্পতিদের সুখীজীবনের ব্যাপারে শার্লিন একটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলছেন, ‘মানুষ বিয়ে করে সুখী হয়, না কি সুখী মানুষেরাই কেবল বিয়ে করে?’ কারণ এই সমাজবিজ্ঞানী বলতে চাচ্ছেন, ‘কিছু কিছু মানুষ জন্মগতভাবেই অসুখী প্রকৃতির। তারা অসুখী, তারা জীবনে সুখ কী জানে না, সুখী হতে পারে না এবং হতে চায়ও না’। তবে শার্লিন তাঁর এ-কথার সপে কোনো যুক্তি বা তথ্য দিতে পারেননি। এটা তাঁর একটি ব্যক্তিগত মতামতমাত্র।

বিয়ের ব্যাপারে আরেকটি জানার বিষয় হলো, নবদম্পতির মধুচন্দ্রীমা বেশি দিন থাকে, না কি অল্প দিনেই শেষ হয়ে যায়। বিয়ের আনন্দ তার চূড়ায় উঠে প্রথম তিন-চার বছরের মাথায়। তারপর কঠিন বাস্তবতার কষাঘাতে সম্পর্কে শুরু হয় টানাপোড়েন, ভাটির টান। ‘এরপর যে আবার কোনো সময় সম্পর্কের উন্নতি হয়, সেটা তথ্যউপাত্তে পাওয়া যায় না’। বলছেন, শার্লিন।

আবার ফিরে আসি সমাজবিজ্ঞানী রবিন সাইমনের কথায়। তিনি বলছেন, ‘বিয়েকে সফল সুন্দর ও সার্থক করে তুলতে প্রতিদিনই দু’জনকে একযোগে কাজ করতে হয়। অল্প অল্প করে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে গড়ে তুলতে হয়, এগিয়ে নিতে হয়’। তাঁর মতে, এমন দম্পতিদের বিয়েই বেশিদিন টিকসই হয়। ‘গ্যারি বেকার’ নামে একজন মার্কিন নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ আছেন যিনি বিয়ের ব্যাপারে শুনিয়েছেন অনেক তত্ত¡কথা। তাঁর মতে, ‘যে-সব বিয়েতে স্ত্রী, স্বামীর চেয়ে বেশি শিতিা, যোগ্যতাসম্পন্ন এবং বড় চাকরি করে, সে-সব বিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ’। ‘সামারসন’ একই সুরে বলছেন, ‘আবার যে-সব বিয়েতে এক কিংবা উভয় স্পাউস অন্যের ওপর বেশি ডিমান্ডিং সে-সব বিয়েও শেষ পর্যন্ত টিকে কম’। এখানে আরেকটি প্রাসঙ্গিক কথা বলা প্রয়োজন, একজন প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত লোক তার জীবনে যত সুখ এবং আনন্দ উপভোগ করে তার কিন্তু ৯০ শতাংশই আসে স্পাউসের হাত ধরে। একইভাবে ওই ব্যক্তি জীবনে যত দুঃখ এবং আঘাত পেয়ে থাকে তারও ৯০ শতাংশের উৎস কিন্তু সেই একই স্পাউস। তাই বিয়ের আগে সবারই চরম সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। এখানে সমাজবিজ্ঞানী ‘আমবারসন’-এর অবস্থান একটু ভিন্ন। তিনি বলছেন, ‘সুখী বিয়েতে মানুষের শরীর ও মনের যে উপকার হয়, অসুখী বিয়েতে তার চেয়ে তি হয় অনেক বেশি’। আমবারসনের মতে, ‘বিয়ের সফল সূচনার প্রথম চাবিকাঠি হলো, স্পাউসকে পরিবর্তন করার চেষ্টা না করে, যেভাবে আছে সেভাবেই তাকে মেনে নেওয়া’।

সমাজবিজ্ঞানী আমবারসনের বক্তব্যে আরেকটু জোর দিয়ে, বিয়ে নিয়ে আমার আজকের শেষকথা, যে নারী কিংবা পুরুষ তার স্বামী কিংবা স্ত্রীকে যেভাবে আছে সেভাবেই খুশি মনে বরণ করে নিতে প্রস্তুত নয়, তার কিন্তু এখনো বিয়ের সময় হয়নি। আবার এ-ও ঠিক, পরস্পরকে আগাম ষোলো আনা না জেনে, এমন প্রস্তুতি নেওয়া যে কোনো নারী-পুরুষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণও বটে। একজন বিবাহযোগ্য মানুষ কেন এমন ঝুঁকি নেবে? এ প্রশ্নের উত্তর দু’ভাবে দেওয়া যায়। প্রথমতঃ নেবে, নিতে হবে, কারণ আমাদের আদি পিতা-মাতা আদম এবং হাওয়া থেকে শুরু করে বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষ সবাই তো এমন ঝুঁকি নিয়েছে। আমরা নেব না কেন? দ্বিতীয়তঃ ঝুঁকি না নিয়েইবা লাভ কী? যারা বিয়ে করে, তারা পস্তায়, যারা করে না, তারাও তো পস্তায়। তাহলে করে পস্তানোই তো ভালো। দু’দলই কেন পস্তায়, এ-কথা সবারই জানা। যারা ‘দিল্লিকা লাড্ডু’ খেয়ে পস্তায়, তারা মনে করে, আহা! না জানি আরো কত ভালো বিয়ে হতে পারত, জীবনে আরো কত সুখী হতে পারতাম! আর যারা না খেয়ে পস্তায়, তারা ভাবে, বিয়ে না করে অহেতুক নিজেদেরকে একটি আনন্দময় জীবন থেকে বঞ্চিত করলাম। বিয়ে যদি সুখকর নাই হবে, তাহলে যুগ যুগ ধরে এত মানুষ কেন বিয়ে করছে। বিয়ে করার সপে এটা নিঃসন্দেহে একটি শক্তিশালী যুক্তিও বটে।

লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসী স্টেইট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর – জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ; Email: wahid2569@gmail.com