সোনা কান্তি বড়ুয়া : আজ পঁচিশে বৈশাখ, এশিয়া মহাদেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপক, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ কবি বিশ্ব বরেণ্য গুরুদেব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম জয়ন্তীতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি। রবীন্দ্র সাহিত্যের অমরত্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বুদ্ধ বন্দনা “বুদ্ধং সরনং গচ্ছামি”!

রবীন্দ্র সাহিত্যের স্রষ্টা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম শুভ জন্মজয়ন্তীতে পুণ্যচেতনা স্মরণ করে বিশ্বকবিকে মোদের সাষ্ঠাঙ্গ প্রণতি। তিনি সব বাঙালির। আসুন, সবাই মিলে সেই শুভ দিনটি উদ্যাপন করি। বৌদ্ধ সহজতত্ত¡ ও রবীন্দ্রনাথের অরূপ সাধনা এই রূপ সব্যসাচী প্রতিভাধর মানুষ আর দেখা যায় না! সাহিত্যের সর্বদিকে তাহার বিচরণ মানুষকে দেয় প্রশান্তি, খুঁজে পায় বিশ্বমানবতা দর্শনের ভাবধারা, তাই সেই বিশ্বমানবতায় উদ্ভাসিত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরন্তন! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতা খানি / কৌতূহল ভরে!”

বিশ্বসাহিত্যের অমরত্বে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বুদ্ধ বন্দনায় বৌদ্ধ কাহিনী অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নাটক (১) নটীর পূজা (২) শ্যামা (৩) চন্ডালিকা (৪) মালিনী (৫) রাজা (৬) অচলায়তন ও (৭) গুরু। বুদ্ধপূর্ণিমা উপলক্ষে গৌতমবুদ্ধকে সশ্রদ্ধ বন্দনা নিবেদনের নৈবেদ্য সাঁজিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী” গানটি (বুদ্ধ জন্মোৎসব ২১শে ফাল্গুন, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ) মহামানব বুদ্ধের নামে উৎসর্গ করেছিলেন,
“হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বি নিত্য নিঠুর দ্ব›দ্ব
ঘোর কুটিল পন্থ তার লোভ জটিল বন্ধ।
নতুন তব জন্ম লাগি কাতর যত প্রাণী
কর ত্রান মহাপ্রাণ আন অমৃত বাণী
বিকশিত করো প্রেম প্রদ্ম চিরমধু নিষ্যন্দ
শান্ত হে মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য!”

“মানবের দুঃখ দূর করার জন্য তিনি তিনি (গৌতমবুদ্ধ ) জন্ম নিয়েছেন। রাজাধিরাজ অথবা রাজপ্রতিভ‚রুপে তিনি হয়ত প্রভ‚ত সন্মান পেতেন। কিন্তু সে সন্মান কালের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হ’ত। বর্তমানের আদর্শ মানুষকে খর্ব্ব করে। রাষ্ট্র নেতাকে ক্ষুদ্র বর্তমানের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু মহা পুরুষদেরকে দেখতে গেলে মহাযুগের মধ্য দিয়ে দেখতে হয়, গভীর অতীতের মধ্য দিয়ে যাঁর পাশে বর্তমান সংলগ্ন রয়েছে। তিনি সমস্ত মানবের চিত্তের মধ্যে জন্ম নিয়েছেন, বর্তমানে তাঁর আসন রচনা হচ্ছে, ভাবী কালেও তাঁর আসন রচিত থাকবে।”

প্রায় ২৬০০ বছর পূর্বে রাজপুত্র সিদ্ধার্থ (গৌতমবুদ্ধ) বাল্যকালে যে বাংলা লিপি অধ্যয়ন করেছিলেন এর ঐতিহাসিক প্রমাণ বাংলা বিশ্বকোষের ১৩শ ভাগ, ৬৫ পৃষ্ঠায় সগৌরবে লিপিবদ্ধ আছে। রবি ঠাকুরের ভাষায়,
“ওই নামে একদিন ধন্য হল দেশে দেশান্তরে
তব ( গৌতমবুদ্ধ ) জন্মভূমি।
সেই নাম আরবার এ দেশের নগরে প্রান্তরে
দান কর তুমি।
বোধিদ্রুমতলে তব সেদিনের মহাজাগরণ
আবার সার্থক হোক, মুক্ত হোক মোহ আবরণ,
বিস্মৃতির রাত্রিশেষে এ ভারতে তোমারে স্মরণ
নব প্রভাতে উঠুক কুসুমি।
১৩৩৮ বঙ্গাব্দে “বৈশাখী পূর্ণিমা” শীর্ষক কবিতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৌদ্ধকবি হয়ে লিখেছিলেন,
“সকল কলুষ তামস হর’ জয় হোক তব (গৌতমবুদ্ধ) জয়!

‘অমৃক বারি সিঞ্চন কর’ নিখিল ভুবন ময়।
জয় হোক তব জয়!
মহাশান্তি মহাক্ষেম,
মহা পুণ্য, মহা প্রেম!”
জ্ঞানসূর্য উদয় ভাতি
ধ্বংস করুক তিমির রাতি,
‘দুঃসহ দুঃস্বপ্ন ঘাতি’ অপগত কর ভয়।
জয় হোক তব জয়।

কেমন করে কোন ভাষায় বলব, তিনি (গৌতমবুদ্ধ) এই পৃথিবীতে এসেছিলেন, কেমন করে মানুষকে তাঁর বাণী বলেছেন, সেই স্মৃতিটুকু রাখবার জন্য মানুষ অজন্তার গুহা হতে শুরু করে কত না অসাধ্য সাধন করেছে। কিন্তু এর চেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হয়েছে সেদিন, যেদিন সম্রাট অশোক তাঁর শিলালিপিতে লিখলেন বুদ্ধের বাণী। অশোক তাঁর বীরত্বের অভিমান, রাজত্বের অভিমান দিয়েছিলেন ধূলায় লুটিয়ে। এতবড় রাজা কখনও পৃথিবীতে এসেছেন কি? কিন্তু সেই রাজাকে রাজাধিরাজ করল কে? সেই গুরু। জাতিতে জাতিতে ভেদ, বিসম্বাদ পূর্ণ, হিংসায় ভরপুর ও পঙ্কিল এই জাতিকে কি শুধু রাষ্ট্রনীতি দ্বারা রক্ষা করা যাবে? যিনি এসেছিলেন, তিনি আবার আসুন, উপনিষদের সেই বাণী নিয়ে। উপনিষদ বলছে, “কো ধর্ম্মভ‚তে দয়া, সমস্ত জীবের প্রতি দয়া, শ্রদ্ধা ও দয়া। শ্রদ্ধয়া দেয়ম, ধিয়া দেয়ম। অশ্রদ্ধা করে দান করলে সে দান কলুষিত হয়। যেখানে মানুষ মানুষকে অপমান করে, সেখানে কি মানুষ রাষ্ট্রনীতিতে সিদ্ধিলাভ করতে পারে?”

আমার লেখা কবিতায় : “বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাংলাদেশ।
জয় বাংলায় জয়! বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের জয়!
বাংলা আমার, মাতা আমার চির বিজয়ী বাংলাদেশ,
জগৎ জুড়িয়া বাঙালি জাতি জয় বাংলা গাইছে বেশ!
হাজার বছর আগের বাঙালির ইতিহাস কি কথা কয়?
অতীশ দীপঙ্করের বাংলাদেশ বাংলা ভাষা অমর অক্ষয়।”

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ড. হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘জলপাই রঙের অন্ধকার’ গ্রন্থে যা লিখেছিলেন, রবীন্দ্র-বিরোধীরা সে কথাগুলো আরেকবার পড়ে দেখুক –
“যাঁকে (রবীন্দ্রনাথকে) বাতিলের চেষ্টা করে আসছে নষ্টরা পবিত্র পাকিস্তানের কাল থেকে; পেরে ওঠেনি। এমনই প্রতিভা ঐ কবির, তাঁকে বেতার থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয় জুড়ে বাজেন; তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয়ের কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত হয়ে যান, তাঁকে বঙ্গভবন থেকে বাদ দেওয়া হলে তিনি সমগ্র বঙ্গদেশ দখল করেন; তাঁর একটি সঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে তিনি জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠেন।

প্রতিক্রিয়াশীল নষ্টরা অনেক লড়াই করেছে তাঁর সাথে, পেরে ওঠেনি; তাঁকে মাটি থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি আকাশ হয়ে ওঠেন; জীবন থেকে তাঁকে নির্বাসিত করা হলে তিনি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন জাতির স্বপ্নালোকে। নষ্টরা তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে আপ্রাণ। যদিও তিনি জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা,তবুও তিনি জাতীয় কবি নন। তাঁর নামে ঢাকায় একটি রাস্তাও নেই; সংস্থা তো নেই। তাতে কিছু যায় আসে নি তাঁর; দশকে দশকে বহু একনায়ক মিশে যাবে মাটিতে। তিনি বেঁচে থাকবেন বাঙলায় ও বিশ্বে।”

বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘মহামানব বুদ্ধ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ১৮ মে, ১৯৩৫ সালে কোলকাতায় মহাবোধি সোসাইটির ধর্মরাজিকা বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গনে মহাবোধি সোসাইটি হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন, “আমি যাঁকে আমার অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করেছি আজ তাঁর জন্মোৎসবে তাঁকে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি, এ কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে অর্ঘ নিবেদন নয়, যাঁকে নির্জনে বারংবার অর্ঘ নিবেদন করেছি, সেই আজ নিবেদন করতে উপস্থিত হয়েছি।”

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) মানুষ হিসেবে এ নশ্বর পৃথিবীতে তাঁর “সেই স্বপ্নটি ছিল বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্র সাহিত্যের সৃষ্টিকে ষোলোকলায় পূর্ণতা দিয়ে! আজও তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমরত্বের বরপুত্র। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘বিশ্ব ভুবনের অস্তিত্ব ও আমার অস্তিত্ব একাত্মক। ভ‚ভুব: স্ব: এই ভ‚-লোক, অন্তরীক্ষ, আমি, তারই সঙ্গে অখন্ড। এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের আদি অন্তে যিনি আছেন তিনি আমাদের মনে চৈতন্য প্রেরণ করেছেন। চৈতন্য ও বিশ্ব, বাহির ও অন্তরে, সৃষ্টির এই দুইধারা একধারায় মিলেছে। এমনি করে ধ্যানের দ্বারা যাকে উপলব্ধি করছি তিনি বিশ্ব আত্মাতে আমার আত্মাতে চৈতন্যের যোগে যুক্ত’।”

হৃদয়ে হৃদয়ে / আধো পরিচয়। / আধখানি কথা, / কখনো সম্পন্ন নাহি হয়। / শুরু হয়, সাঙ্গ নাহি হয়, / শুধু মরি লাজে ত্রাসে!

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “তিনি (গৌতমবুদ্ধ) জন্মেছেন মানবের চিত্তে, প্রতিদিন তিনি জন্মাচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি বেঁচে আছেন।” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “চন্ডালিকা” শীর্ষক নৃত্যনাট্যে বিশ্বমানবতার বাণী অহিংসা পরম সুধা প্রচার করেছেন। সকল ধর্মের উপদেশে বিরাজমান, “মানুষ মানুষের ভাইবোন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ‘ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা / নিতান্তই সহজ সরল! সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি / তারি দু’চারিটি অশ্রুজল / নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা / নাহি তত্ত¡ নাহি উপদেশ!”!

১৯৩৬ সালে শান্তিনিকেতনে বিষয়টা (‘বিজ্ঞান-কবিতা’) সত্যের অন্বেষণে উপস্থাপন করে রবীন্দ্রনাথ লিখেন তাঁর বিখ্যাত ‘আমি’ কবিতা। ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ,/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে।/ আমি চোখ মেললুম আকাশে-/ জ্বলে উঠল আলো।/ পূবে পশ্চিমে।/ গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম‘সুন্দর’-/ সুন্দর হলো সে’।

স্তবকে স্তবকে সাজানো এই কবিতায় তিনি তাঁর পূর্বেকার বক্তব্যে অটল থেকে সত্যের অন্বেষণে উচ্চারণ করলেন- ‘সেদিন কবিত্বহীন বিধাতা একা রবেন বসে/ নীলিমাহীন আকাশে/ ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বের গণিততত্ত¡ নিয়ে’। বুঝতে অসুবিধা হয় না কথোপকথনের ছয় বছর পরে এসেও রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনের ওই জিজ্ঞাসা বিস্মৃত হননি। তাতে করে পৃথিবীর ইতিহাসে ‘সত্য-কে’ জ্ঞাত হওয়ার মহত্তম ভাবনায় মোড়ানো শ্রেষ্ঠ দুই মহামানবের এই যুগলবন্দি উচ্চারণের সঙ্গে আমরা যেন পেয়ে গেলাম রবীন্দ্রনাথের একটি ‘বিজ্ঞান-কবিতা’।

প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘খেয়ার নেয়ে’ আলোছায়ার রহস্যলোকে অস্পষ্টভাবে ক্ষণে ক্ষণে দেখা দিয়েছেন আর গীতাঞ্জলীর দেবতা ভক্তের সম্মুখে আসীন। রবীন্দ্রনাথের DEEP SPIRITUAL বিশ্বমানবতায় রসানুভূতি গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য ও গীতালীতে স্তরে স্তরে গভীর হতে গভীরে গিয়ে পূর্ণতা লাভ করেছে। (রবীন্দ্র জীবনী ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা-২৪৫)। আত্মার দৃষ্টি রচনায় কবি বলেছেন “আমাদের চেতনা আমাদের আত্মা যখন সর্বত্র প্রসারিত হয় তখন জগতের সমস্ত সত্তাকে আমাদের সত্তা ধারাই অনুভব করি। ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নয়, বৈজ্ঞানিক যুক্তি দ্বারা নয়, সে পরিপূর্ণ অনুভ‚তি একটি আশ্চার্য্য ব্যাপার!”

রাজপুত্র সিদ্ধার্থ (ভগবানবুদ্ধ) মনের লোভ দ্বেষ মোহ অহঙ্কারসহ মারসমূহ জয় করে বুদ্ধত্ব লাভ করলেন! পরম পূজনীয় গৌতমবুদ্ধ সমগ্র মানবজাতির কল্যাণমিত্র এবং আজ ২৬০০তম পবিত্র বুদ্ধ পূর্ণিমায় বৌদ্ধ জগত জুড়ে বুদ্ধ বন্দনায় জন গণমনে “বুদ্ধং সরনং গচ্ছামি” বিরাজমান। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ তাঁর পিতা মহারাজা শুদ্ধোধনের রাজসিংহাসন ত্যাগ করে ছয় বৎসর কঠিন সাধনার (আর্য্য অষ্ঠাঙ্গিক মার্গ ও ৩৭ প্রকার বোধিপাক্ষীয় (বুদ্ধত্বের সাধনা) ধর্মের অনুসরন); পর মহাকরুনা এবং মহাপ্রজ্ঞার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে ‘বুদ্ধ বা মহাজ্ঞানী মহাজন’ হয়েছিলেন।

ভগবানবুদ্ধের ধ্যানে ও বন্দনার আলোকে মানবাধিকার প্রসঙ্গ নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চন্ডালিকা নৃত্যনাট্যে চন্ডাল কন্যা চন্ডালিকার অশ্রু প্রবাহ বিরাজমান। বাংলা ভাষার প্রথম গ্রন্থ ও আদিমতম নিদর্শন চর্যাপদ ও বৌদ্ধ দর্শনে সমৃদ্ধ। বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘মহামানব বুদ্ধ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ১৮ মে, ১৯৩৫ সালে কোলকাতায় মহাবোধি সোসাইটির ধর্মরাজিকা বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গনে মহাবোধি সোসাইটি হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন,
“আমি যাঁকে আমার অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করেছি আজ তাঁর জন্মোৎসবে তাঁকে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি, এ কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে অর্ঘ নিবেদন নয়, যাঁকে নির্জনে বারংবার অর্ঘ নিবেদন করেছি, সেই আজ নিবেদন করতে উপস্থিত হয়েছি। একদিন বুদ্ধগয়াতে বুদ্ধমন্দির দর্শনে গিয়েছিলুম। সেইদিন এ কথা মনে জেগেছিল- যে সময়ে ভগবানবুদ্ধেও চরণস্পর্শে সমস্ত বসুন্ধরা জেগে ওঠেছিল, গয়াতে যেদিন তিনি স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন, সেদিন কেন আমি জন্মাইনি, কেন সেদিন অনুভব করিনি তাঁকে একান্তভাবে শরীর মন দিয়ে। বর্তমানের পরিধি অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। এই ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে তাঁকে উপলব্ধি করতে পারা যায় না। কিছুদিন পুর্বে তাঁর জীবন কথায় পড়েছিলুম- সে যুগের কথা। সেদিন ছিল কথায় বিরোধ, চিন্তার বিরোধ। সেদিন তাঁকে খর্ব্ব করতে, তাঁর চরিত্রে কলঙ্ক আরোপ করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু যাঁরা মহাপুরুষ তাঁরা কোন ক্ষুদ্র কালে আসেন না। বর্তমানকে উপলক্ষ করে তাঁরা জন্মান না, মহাযুগের মধ্যে তাঁদের আবির্ভাব, ক্ষুদ্র বর্তমানের মধ্যে তাঁদের আবির্ভাব সম্ভব নয়। সুদূর জাপানের এক মৎস্যজীবি সেদিন এই বোধিদ্রুমমূলে কাতরভাবে তার পাপ বিমোচনের জন্য প্রার্থনা করেছিল, বুদ্ধদেবের চরনতলে লুটিয়ে পড়েছিল, সেদিনও বুঝেছিলুম তাঁর জন্ম ক্ষুদ্র কালের মধ্যে নয়।

যাঁরা প্রতাপবান, বীর্য্যবান তাঁদের সংখ্যা পৃথিবীতে বেশি নয়। অনেক মানব, রাজা, ধনী মানী ও রাষ্ট্রনেতা এ পৃথিবীতে জন্মেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব নিয়ে কতজন এসেছেন? যিনি সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব নিয়ে এসেছিলেন আবার তাঁকে আহ্বান করছি আজকে এই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভারতে, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিসম্বাদ, যেখানে ভেদ বিবাদে মানুষ জর্জরিত, সেই ভারতে তিনি আবার আসুন।

কেমন করে কোন ভাষায় বলব, তিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন, কেমন করে মানুষকে তাঁর বাণী বলেছেন, সেই স্মৃতিটুকু রাখবার জন্য মানুষ অজন্তা গুহা হতে শুরু করে কত না অসাধ্য সাধন করেছে। কিন্তু এর চেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হয়েছে সেদিন, যেদিন সম্রাট অশোক তাঁর শিলালিপিতে লিখলেন বুদ্ধের বাণী। অশোক তাঁর বীরত্বের অভিমান, রাজত্বের অভিমান দিয়েছিলেন ধূলায় লুটিয়ে। এতবড় রাজা কখনও পৃথিবীতে এসেছেন কি? কিন্তু সেই রাজাকে রাজাধিরাজ করল কে? সেই গুরু জাতিতে জাতিতে ভেদ, বিসম্বাদ পূর্ণ, হিংসায় ভরপুর ও পঙ্কিল এই জাতিকে কি শুধু রাষ্ট্রনীতি দ্বারা রক্ষা করা যাবে? যিনি এসেছিলেন, তিনি আবার আসুন, উপনিষদের সেই বাণী নিয়ে। উপনিষদ বলছে, “কো ধর্ম্মভ‚তে দয়া, সমস্ত জীবের প্রতি দয়া, শ্রদ্ধা ও দয়া। শ্রদ্ধয়া দেয়ম, ধিয়া দেয়ম। অশ্রদ্ধা করলে দান করলে সে দান কলুষিত হয়। যেখানে মানুষ মানুষকে অপমান করে, সেখানে কি মানুষ রাষ্ঠ্রনীতিতে সিদ্ধিলাভ করতে পারে?

সত্যের দ্বারা মানবের পূর্ণ প্রকাশ। যিনি আপনার মধ্যে সকল জীবকে দেখেন। তিনি স্বয়ং প্রকাশ। তিনি প্রকাশিত হবেন তাঁর মহিমার মধ্যে। এই জগতের অধিকাংশ মানুষ আজ আচ্ছন্ন, তারা প্রকাশিত হয়নি। সূর্যের আলো প্রবেশের পূর্বেই এই সুন্দরী পৃথিবীর সবকিছু যেমন আচ্ছন্ন ছিল, তেমনিতর আজকের দিনে মানুষ সমস্ত মানুষ আচ্ছন্ন, আপনার ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বারা। যাঁরা সত্যকে পেয়েছেন, তাঁরা প্রকাশ পেয়েছেন। যেমন সূর্য নিজেকে প্রকাশ করে সঙ্গে সঙ্গে এই পৃথিবীকে ও প্রকাশিত করেন, তেমনিতর মহাপুরুষগণ ও ভগবান তথাগত যখন প্রকাশিত হলেন তখন এই ভারতবর্ষ ও প্রকাশিত হ’ল পৃথিবীর কাছে। ভারত তখন আপনার সত্যবাণী প্রকাশ করলে। সকল বর্ণের, সকল ধর্মের ছোট ছোট গন্ডী এড়িয়ে তিনি ছড়িয়ে পড়লন এই মহাবিশ্বে। সমস্ত মরুক্ষেত্রের মধ্যে, দুর্লঙ্ঘ্য পর্বতের উপরে প্রস্তর মূর্তিতে ও স্তপে স্তপে তাঁর বাণী রচিত হ’ল। তিনি মানুষকে বলেছিলেন সত্যকে উপলব্ধি করার জন্যে। কিন্তু সে সত্যকে কি সহজে পাওয়া যায়? তাই মানুষকত দুঃখ দিয়ে এবং কত কৃচ্ছ সাধন করে পর্বত শিখরে, মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের ভক্তিকে চরিতার্থ করেছে। এশিয়া খন্ডে মানবের সে কীর্তি দেখলে বিস্মিত হতে হয়।

কেমন করে কোন ভাষায় বলব, তিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন, কেমন করে মানুষকে তাঁর বাণী বলেছেন, সেই স্মৃতিটুকু রাখবার জন্য মানুষ অজন্তার গুহা হতে শুরু করে কত না অসাধ্য সাধন করেছে। কিন্তু এর চেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হয়েছে সেদিন, যেদিন সম্রাট অশোক তাঁর শিলালিপিতে লিখলেন বুদ্ধের বাণী। অশোক তাঁর বীরত্বের অভিমান, রাজত্বের অভিমান দিয়েছিলেন ধূলায় লুটিয়ে। এতবড় রাজা কখনও পৃথিবীতে এসেছেন কি? কিন্তু সেই রাজাকে রাজাধিরাজ করল কে? সেই গুরু। জাতিতে জাতিতে ভেদ, বিসম্বাদ পূর্ণ, হিংসায় ভরপুর ও পঙ্কিল এই জাতিকে কি শুধু রাষ্ট্রনীতি দ্বারা রক্ষা করা যাবে? যিনি এসেছিলেন, তিনি আবার আসুন, উপনিষদের সেই বাণী নিয়ে। উপনিষদ বলছে, “কো ধর্ম্মভ‚তে দয়া, সমস্ত জীবের প্রতি দয়া, শ্রদ্ধা ও দয়া। শ্রদ্ধয়া দেয়ম, ধিয়া দেয়ম। অশ্রদ্ধা করে দান করলে সে দান কলুষিত হয়। যেখানে মানুষ মানুষকে অপমান করে, সেখানে কি মানুষ রাষ্ট্রনীতিতে সিদ্ধিলাভ করতে পারে?

দীনতম দীনের দুঃখ বিমোচনের জন্য তিনি সর্বত্যাগ করেছিলেন। সমস্ত মানুষকে একান্তভাবে জেনেছিলেন বলেই তিনি সত্য। তাঁর তপস্যা কি শুধু ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে? ভারতের মাটিতে আজ তাঁর তপস্যা বিলুপ্ত হয়েছে। আমাদের অমূল্য ভান্ডারে দ্বার ভেঙ্গে গেছে। মানুষকে আমরা শ্রদ্ধা করিনে। আমাদের সেই প্রেম, মৈত্রী, করুণা, যা তাঁর দান, সব আমাদের গিয়েছে। তাঁর দানকে রুদ্ধ করেছি মন্দির দ্বার পর্যন্ত।

এ জাতের কখনও মঙ্গল হতে পারে? তাঁকে বলা হয় শূন্যবাদী। তিনি কি শূন্যবাদী? তিনি বললেন, “জীবে দয়া কর। সমস্ত বিশ্বের মূলে কোন অতীন্দ্রীয় শক্তি আছে কি না তা আমি বলব না, তোমরা স্বার্থ থেকে, বন্ধন থেকে মুক্ত হও।” এর চেয়ে বড় আধ্যাত্মতত্ত¡ কি আছে জানি নে। তাঁর মূলকথা, মানুষকে শ্রদ্ধা কর, মানুষকে ক্ষমা কর, অসাধুতা জয় করতে হবে সাধুতা দ্বারা, ক্রোধকে জয় করতে হবে, অক্রোধ দ্বারা। বাসনা, তৃষ্ণা মানবের চরম ধর্ম নয়, এ গুলিতে মানুষ সত্যভ্রষ্ঠ হয়।

ক্ষমা আমরা করতে পারি নে কেন? কারণ ক্ষমা করতে চাইলেই আমাদের অন্তরে অহং উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আজকের দিনে সমস্ত সমস্যার মূলে এই বাণীর অভাব, অক্রোধের দ্বারা ক্রোধকে জয় কর। সমস্ত বশ্বে আজ এ বাণী পৌঁছেছে, ইউরোপেও। ইউরোপ আজ বড় দুঃখে পীড়িত, হিংসায় শতধা বিভক্ত। কোন রাষ্ট্রনৈতিক কলে (পন্থায়) শান্তি তৈরী করা যেতে পারে না, ইউরোপ তা বোঝে না। শান্তি ম্যাঞ্চেষ্টারের কল এ তৈরী করা কাপড়ের মত কিছু হতে পারে না, এই যে মানুষের মন নিয়ে খেলা। ইউরোপকে একবার প্রাচ্যেও দিকে তাকাতে হবে, যেখানে সত্য রয়েছে, সেখানে কবে মানুষের দৃষ্ঠি পড়বে? বড় দুঃখে আমরা অনেক দিনের পাপ বহন করে এসেছি, এই মানুষকে অপমান করে। তিনি আমাদের এই ভেদ বুদ্ধি থেকে রক্ষা করুন। পার্লামেন্টারী বিধি নিয়মে, অথবা ভোট নেবার কোন এক কৌশলে অন্তরের মধ্যে বিষ পোষণ করে, কলের (যন্ত্র) সৃষ্ঠ শান্তি আমাদের ধর্ম নয়। ধর্ম হইতেছে জীবে দয়া, মানুষে শ্রদ্ধা। (সৌজন্য, দেশ, কলকাতা, ২ মে, ২০০৫, পৃষ্ঠা নং ৪১;)।”

রবি ঠাকুরের কর্ম প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত ও প্রভাবিত করে এবং আমরা সাহিত্য ও শিল্পকলায় তাঁর অবদানের প্রতি সম্মান জানাতে পেরে ধন্য। গীতাঞ্জলি’র প্রথম কবিতা স্মরণ করলাম-
“আমার মাথা নত করে / দাও হে তোমার চরণধুলার তলে।
নিজেরে করিতে গৌরব দান / সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে।
নিজেরে কেবলি করি অপমান,
আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া
ঘুরে মরি পলে পলে।”

বিশ্ববৌদ্ধ পুরস্কার প্রাপ্ত প্রখ্যাত মানবতাবাদী লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), The AuthorÕs World famous and glorious New Book entitled ÒPRE – VEDIC MOHENJODARO BUDDHISM & MEDITATION IN THE NUCLEAR AGE , (516 Pages) “ সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি !