
অনলাইন ডেস্ক : গত চার বছর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আমি দেখেছি তার ভাল এবং খারাপ দিনগুলোতে। কিন্তু ৭ই নভেম্বর, যেদিন তিনি নির্বাচনে হারলেন, সেই দিনটির সাথে গত চার বছরের অন্য কোনো দিনের তুলনা হয় না।
কালো রং-এর বাতাস আটকানো জ্যাকেট, কালচে রং-এর প্যান্ট এবং মাগা (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) টুপি পরে প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউস থেকে বের হন সকাল দশটার একটু আগে। বেরনোর আগে পর্যন্ত সারা সকাল তিনি ভোট জালিয়াতি নিয়ে টুইট করেছেন।
একটু সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটছিলেন, যেন বাতাস ঠেলে তাকে এগোতে হচ্ছে। একটা গাঢ় রং-এর গাড়িতে উঠলেন এবং রওনা হলেন তার গল্ফ ক্লাবের দিকে।
হোয়াইট হাউস থেকে প্রায় ২৫ মাইল (৪০ কিমি) দূরে ভার্জিনিয়ার স্টার্লিংয়ে তার গল্ফ খেলার ক্লাব- ট্রাম্প ন্যাশানাল।
সেই সময় তাকে বেশ আস্থায় ভরপুর দেখাচ্ছিল। তার হাবভাবে সেরকমই একটা ধারণা দিচ্ছিলেন। দিনটা ছিল দারুণ- গল্ফ খেলার জন্য উপযুক্ত দিন। তিনি ওই ক্লাবে দিনের বেলাটা কাটানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিন্তু যারা তার কর্মচারী, তাদের মধ্যে মনে হচ্ছিল একটা অস্বস্তির ভাব রয়েছে।
‘কেমন আছেন?’ আমি তার একজন অধস্তন কর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘ভাল,’ তিনি বললেন। একটু হাসলেন, কিন্তু তার চোখটা কুঁচকে গেল। তিনি মুখ নিচু করে তার ফোনের দিকে তাকালেন।
নির্বাচনী বিপর্যয়
নির্বাচনের পরের দিনগুলোতে হোয়াইট হাউসের মধ্যে বেশ একটা বিপর্যয়ের আবহাওয়া চলছে। নির্বাচন হয়েছে মাত্র গত মঙ্গলবার, কিন্তু মনে হচ্ছে সে কতদিন আগের ঘটনা।
শনিবার সকালে আমি যখন হোয়াইট হাউসের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম, দেখলাম ওয়েস্ট উইং অংশে বেশিরভাগ কাজের ডেস্ক খালি পড়ে রয়েছে। বেশ কয়েকজন কর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তারা অফিসে আসেননি। বাকিরা কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।
সকাল সাড়ে এগারোটায় প্রেসিডেন্ট যখন তার গল্ফ ক্লাবে, তখন থেকে বিবিসি এবং আমেরিকার সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের ফলাফল পূর্বাভাস দিতে শুরু করল। তারা ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ জো বাইডেন নিশ্চিতভাবে জয়ী হচ্ছেন বলে ফল ঘোষণা শুরু করল।
আমেরিকার নির্বাচনে এভাবেই ফলাফলের পূর্বাভাস দেয়া হয়। যে প্রার্থী যে রাজ্যে বিজয়ের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বেশি ভোট পান, তাকে সংবাদমাধ্যমই সেই রাজ্যে বিজয়ী বলে ঘোষণা করে দেয়।
জো বাইডেনকে বিজয়ী ঘোষণার খবর যখন আমি শুনি, তখন ওই গল্ফ ক্লাব থেকে মাইলখানেক দূরে একটা ইতালীয় রেস্তোরাঁয় আমি ছিলাম।
আমি হোয়াইট হাউসের সাংবাদিক পুলের একজন সদস্য। হোয়াইট হাউস সংক্রান্ত খবরাখবর দেবার দায়িত্বে থাকা হাতে গোনা কিছু সাংবাদিক এই দলে রয়েছেন।
এই সাংবাদিকরা প্রেসিডেন্ট যেখানে যান, সেখানে প্রেসিডেন্টের সাথে যান। আমরা সবাই প্রেসিডেন্টের গল্ফ ক্লাব থেকে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
রেস্তোরাঁর বাইরে এক নারী মন্তব্য করলেন, ‘উনি বিষাক্ত’। ওই এলাকাটি ডেমোক্র্যাট অধ্যুষিত এবং তার বেশিরভাগ প্রতিবেশির মত তিনিও ট্রাম্পের প্রতিপক্ষ জো বাইডেনকে ভোট দিয়েছেন।
অনেকে বেশ জোরে জোরেই বলতে শুরু করল প্রেসিডেন্ট কখন ক্লাব থেকে বের হবেন এবং হোয়াইট হাউসে যাবেন? মিনিটের পর মিনিট কেটে গেলে, এরপর ঘন্টার পর ঘন্টা পার হলো।
আইন শৃঙ্খলার দায়িত্বে কর্মরত এক অফিসার, নিচু গলায় তার এক সহকর্মীকে বললেন, ‘উনি বের হতে বেশ দেরি করছেন’।
প্রেসিডেন্টের বের হওয়ার জন্য কোন তাড়া ছিল না। ক্লাবের ভেতর তিনি বন্ধু পরিবৃত হয়েছিলেন। ফটকের বাইরে তার সমর্থকরা আমাকে এবং অন্য সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে চেঁচাতে শুরু করল: ‘সংবাদমাধ্যমের অর্থ তহবিল বন্ধ করে দেয়া হোক’।
একজন লোক ক্লাবের সামনের রাস্তায় একটা ট্রাক নিয়ে বারবার এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছিল।
তার ট্রাকে বেশ কয়েকটা পতাকা ওড়ানো ছিল। একটাতে ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটা ট্যাংকের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, যেন তিনি বিশ্বের অধিনায়ক। তার সমর্থকরা তাকে কীভাবে দেখেন এবং গত চার বছর ট্রাম্প তার সমর্থকদের মনে নিজের যে ছবি তৈরি করে দিয়েছেন, তা থেকে সেটা বেশ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল।
শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প ক্লাব থেকে বের হলেন এবং তার বাসভবনের দিকে যাত্রা শুরু করলেন। তার সমালোচকরা হাজারে হাজারে তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে।
‘আপনি হেরেছেন এবং আমরা জিতব’
প্রেসিডেন্টের গাড়ির বহর ভার্জিনিয়ার রাস্তায় আওয়াজ তুলে ছুটে চলল। ওই গাড়ির বহরে ছিল আমাদের ভ্যানও।
হোয়াইট হাউসের যতই কাছাকাছি যেতে লাগলাম, জনতার ঢলও তত বাড়তে লাগল।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ে উৎসব করতে মানুষের ঢল নেমেছে পথে। একজনের হাতে ব্যানার: ‘আপনি হেরেছেন এবং আমরা জিতব’। মানুষ গাড়ির হর্ন বাজিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছে এবং চিৎকার করে প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে গালি দিচ্ছে।
এরপর আমরা হোয়াইট হাউসে পৌঁছলাম। প্রেসিডেন্ট পাশের একটা দরোজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। ওই দরোজা প্রেসিডেন্ট কালেভদ্রে ব্যবহার করে থাকেন। তার কাঁধ ঝোঁকানো ছিল, মাথা ছিল নিচু।
তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। আমাকে এবং সাংবাদিক পুলের অন্যান্য সাংবাদিকদের দেখলেন। বুড়ো আঙুল তুলে আমাদের দিকে আস্থাসূচক একটা ইঙ্গিত করলেন।
তবে এটা তার স্বভাবোচিত ভঙ্গির সাথে ছিল অসঙ্গতিপূর্ণ। তিনি স্বভাবত যেভাবে প্রায়ই উঁচুতে তার হাত তুলে ধরেন বা হাতের মুঠি তুলে ধরেন, সেরকম কিছু করলেন না।
হোয়াইট হাউস বা গল্ফ ক্লাব কোথাওই প্রেসিডেন্ট কখনও মাথা নোয়াননি বা তাকে কখনই টলতে দেখা যায়নি। তিনি বারবার দাবি করছেন নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে, যে দাবির পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ নেই। তিনি জোর দিয়ে বলছেন তাকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সকালে তিনি টুইট করেন ‘অবৈধভাবে দেয়া ভোট’ নিয়ে এবং দুপুরের পরের দিকে তিনি ফলাফল অগ্রাহ্য করে টুইটারে বড় বড় অক্ষরে ঘোষণা করেন ‘ আই ওন দ্যা ইলেকশান’ (আমি নির্বাচনে জিতেছি)।
তবে এটা টুইটার প্ল্যাটফর্মে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি। কিন্তু আমার সাংবাদিকতার সুবাদে যে ট্রাম্পকে আমি দেখেছি, সেদিন বিকেলের দিকে হোয়াইট হাউসের পাশের ছোট দরোজা দিয়ে তাকে যখন ঢুকতে দেখেছিলাম তখন তিনি কিন্তু অন্য ট্রাম্প। সেই উদ্ধত, আস্থাভরা ট্রাম্প তিনি মোটেই ছিলেন না। সূত্র : বিবিসি