আতোয়ার রহমান : দরজায় খট খট শব্দে রাহাতের ঘুম ভেঙে গেল। সে ভীষণ ভয় পেল। কারণ, দুদিন আগে বাসায় বিকেলে দুজন কম বয়সী তরুণ রাজাকার এসে ঘরে ঢুকে সব খুঁজে দেখে বেরিয়ে গেল। রাহাত তখন ভাবছিল, ওরা কি কোনো উৎস থেকে খবর পেয়ে এল, নাকি কেউ তার ট্রেনিংয়ের ব্যাপারটা রাজাকারদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল? শেষ রাত।তখনো ভোর হয়নি। চারদিকে আবছা অন্ধকার। রাহাতরা তখন ছিল মালিবাগ প্রথম গলির একটি ভাড়া বাড়িতে।
মিলিটারি আজ রাহাতের ঘরে। আল্লাগো। কপালে আজ কী আছে আল্লাই জানে। আল্লা হুম্মা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন। পড়তে পড়তে সে দরজার দিকে এগোয়। এই কয়েক মাসে কত সুরাই না সে মুখস্ত করেছে। রাস্তায় বেরুলে পাঁচ কলেমা রেডি রাখে ঠোঁটের ওপর। যাহোক, সাহস সঞ্চয় করে লুঙ্গি ছেড়ে দ্রুত জাঙ্গিয়া, প্যান্ট, শার্ট পরে, রবারের স্যান্ডেল পায়ে গলিয়ে ব্যস্তভাবে দরজা খোলার জন্য এগিয়ে গেল। ইতিমধ্যে মা-বাবা ও চার ভাই-বোনের ঘুম ভেঙে গেছে। সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেল এই ভেবে যে আবার সেই কালরাত্রির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কি না। এর আরেকটা কারণ হলো, পেছনের দরজায় করাঘাত হচ্ছিল। দরজার পাশেই পাকা উঠান, যা পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দারাও ব্যবহার করেন। যাহোক, ভয়ে ভয়ে রাহাত নিজেই দরজা খুলল। বাইরে অন্ধকার থাকায় হঠাৎ করে আলো-আঁধারে সামনে দাঁড়ানো মানুষের অবয়বটিকে চিনতে পারছিল না। তার পাশে বা পেছনে কেউ নেই। সঙ্গে আর কেউ না থাকায় একটু স্বস্তি নিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখে, বাড়িওয়ালা নাদের চৌধুরীর মেয়ে তানিয়া দাঁড়িয়ে। এ অন্ধকার রাতে তাকে দেখে রাহাত অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে যখন রাহাত তাকে কী জিজ্ঞেস করবে ভাবছিল, ও তখন তাকে ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-আপনি কি কিছু শুনতে পাচ্ছেন? ওর কণ্ঠস্বর শুনে রাহাত বুঝল, ও প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। শীতের রাত, বেশ ঠান্ডাও পড়েছিল। কিন্তু ভয় আর উত্তেজনায় মেয়েটি গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে নিতেও ভুলে গেছে। ও রাহাতের চাইতে দু-এক বছরের ছোট ছিল। জগন্নাথ কলেজের কলা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন রাহাত আর তানিয়া হলিক্রস স্কুলের দশম শ্রেনীর ছাত্রী। সে লক্ষ করল, তানিয়ার শরীর কাঁপছে। ভয়ে নাকি ঠান্ডায়, সেটা অবশ্য বোঝার মতো অবস্থা তখন ছিল না। মেয়েটির কথা শুনে সবাই উৎকর্ণ হয়ে কিছু শোনার জন্য মনোনিবেশ করল।
হ্যাঁ। রাহাত এবার পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে! এবার সে বহুদূর থেকে ভেসে আসা প্রচণ্ড শোরগোলের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। ইতিমধ্যে পাশের বাসার দরজা খুলে কর্তাব্যক্তি বেরিয়ে কাছে এসে কী ঘটছে, তা বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। আস্তে আস্তে তাদের বাসার সবাই বেরিয়ে এসে রাহাতদের সঙ্গে জমায়েত হলেন। রাহাতরা সবাই নিশীথের অন্ধকারের বুক চিরে বহুদূর থেকে ভেসে আসা ওই কোলাহলের ধ্বনি শুনতে পারছিল।
রাহাতরা কেউই এ ধরনের বহুদূর থেকে নিশীথের আঁধার ভেদ করে আসা কোলাহল আর প্রতিধ্বনির সঙ্গে পরিচিত ছিল না। যাহোক, এবার সেই কোলাহলটা কোন দিক থেকে আসছে, বোঝার চেষ্টা করল। রাহাতরা আন্দাজ করল, ঢাকার উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কোলাহলটা তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আওয়াজের উৎস যেদিকে, সেদিকে হলো মিরপুর বা মোহাম্মদপুর, যেখানে ছিল বিহারিদের পুনর্বাসন এলাকা। রাহাতরা সবাই এটা ধরে নিল যে বিহারিরা একজোট হয়ে বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করতে এগিয়ে আসছে।
মেয়েটি এবার খুবই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। রাহাত তাকে সাহস দিয়ে বলল,
তুমি চিন্তা করোনা। আমরা নিজেদের আত্মরক্ষা করার জন্য উপায় বের করার কথা ভাবছি।
রাহাতরা ঠিক করল, ওরা যদি আক্রমণ করেই বসে, তবে তারাও প্রতিহত করবে। তারা যে যার ঘরে ফিরে গিয়ে দা, বঁটি, লাঠিÑ এসব নিয়ে বসে রইল। কেউ যদি আক্রমণ করতে আসে, তবে তারাও এসব দেশি অস্ত্র দিয়ে বাধা দেবে, নিজেদের রক্ষা করতে আঘাত করবে।
ইতিমধ্যে দূর থেকে ভেসে আসা কোলাহল ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এল এবং একসময় হঠাৎ করেই নীরব হয়ে গেল। অল্প কিছুক্ষণ পর মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এল। পুবাকাশের আঁধার কেটে গিয়ে ধীরে ধীরে শুভ্র স্নিগ্ধ আলোর ছটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল।
চারদিকে আলোকিত করে সূর্যোদয় হলো। অন্ধকার দূর হলেও কুয়াশার ধোঁয়াশা আশপাশের খালি জায়গাগুলোতে জমাট বেঁধে রয়েছে। মানুষের চলাচল আর রিকশার আওয়াজ ভেসে আসতেই কীভাবে যেন পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের খবর দ্রæতবেগে দাবানলের মতো ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। ভোরের শিশির পায়ে মাড়িয়ে রাহাত তাড়াতাড়ি খুব কাছেই মৌচাক মার্কেটের সামনে হেঁটে চলে এল। এরই মধ্যে রাস্তায় বিভিন্ন বয়েসি নারী-পুরুষ বেরিয়েছে। গত একবছরে এই প্রথম এই সময়ের মধ্যেই শহরকে ঘুমভাঙা মাতালের মতো এভাবে এভাবে জেগে উঠতে দেখল সে। এত মানুষ! এতদিন এরা কোথায় ছিল? হয়তো গ্রামে গঞ্জে পালিয়ে বেড়িয়েছে। ন’মাসের জেল-খানা থেকে মানুষ কী-ভাবে বেরিয়ে আসছে! রাহাত শুনতে পেল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের জন্য রাজি হয়ে গেছে। আজ বিকেলেই হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রমনা রেসকোর্স ময়দানে।
মৌচাক মার্কেটের সামনে চারদিকে জনারণ্য, কলরব-কোলাহল। রাস্তায় যানবাহনের চলাচল মানুষের ভিড়ে প্রায় বন্ধ। একদিকে যেমন উচ্ছ¡াস, অন্যদিকে উত্তেজনা। স্থানে স্থানে জনতা জটলা বেঁধে মুহুর্মুহু জয় বাংলা ¯েøাগান দিয়ে উল্লাসে মত্ত। সবার মধ্যে যুদ্ধজয়ের উচ্ছ¡াস আর উত্তেজনা। সবাই যেন স্বাধীনতার সুবাস পাচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু মুক্তিযোদ্ধা সবার সঙ্গে আনন্দঘন পরিবেশে বিজয়ের উল্লাস ভাগ করে নিচ্ছেন। তাদের কারও হাতে রাইফেল, আবার কারও হাতে সাব-মেশিনগান। তাদের মুখে ফুটে উঠেছে এক অমর্ত্য বিভা। হিরের মতো তাদের চোখ দুটো জ্বলছে। সোজা-শক্ত দৃষ্টি। চুল ঝাঁকড়া হয়ে নেমে আসতে চাইছে দু’কান বেয়ে। মুখে চে গুয়েভারার মতো লম্বা দাড়ি আর গোঁফ। হয়তো অনেক দিন দাড়ি গোঁফ কামায়নি। বয়সে তরুণ। পরণে ছেঁড়া প্যান্ট, ফাটা ময়লা সার্টের বুকের বোতাম সব খোলা, লোমশ বুক। মানুষজন সবাই তাঁদের অনেকদিন পর সামনাসামনি দেখা পেয়ে মৌমাছির মতো ঘিরে ধরল আর নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগল। কয়কটি কিশোরী রাস্তার ধার থেকে কয়েক গোছা জবা ফুল ছিঁড়ে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দিল। তাঁরা খলখল করে হেসে উঠল। ওদের হাসির মধ্যে যেন একটা গোপন খুশির বন্যা বয়ে চলেছে। এত আনন্দ কী থেকে পাচ্ছে ওরা! এতদিন বিভীষিকার মধ্যে বাস করা জীবন্ত মানুষরা যে এমন দিলখোলা হাসি হাসতে পারে, এদের না দেখলে তা জানা যেত না।
কিছুক্ষণের মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস থেকে বেশ কয়েকটি বাস মৌচাকের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।বাসগুলো কাছাকাছি আসতেই বোঝা গেল, ওগুলোতে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করতে ফিরে যাচ্ছে সম্ভবত ঢাকা সেনানিবাসে। দৃষ্টিসীমার মধ্যে আসতেই জানালা দিয়ে বের করা ওদের রাইফেলের নলগুলো দেখল রাহাত। ওরা যাত্রাপথেও অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত-আক্রমণ এলে পাল্টা জবাব দেবে নিজেদের বাঁচানোর জন্য। এই স্নিগ্ধ ভোরেও তাদের চোখে ঝলসে উঠছে ক্রোধ।
মৌচাক থেকে মগবাজার মোড়ের দিকে আসতে দেখা গেল, দলে দলে মানুষ রাস্তা পার হয়ে রেসকোর্সের দিকে যাচ্ছে। চারিদিকে মানুষের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ¡াস, উন্মাদনা। লোকজনের চোখ আনন্দে ছলছল করছিল, কিন্তু তারা তাদের আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিল না। এখানে ছেঁড়া গামছা আর লুঙ্গি পরা একদল মুক্তিযোদ্ধাকে দেখল সে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের হাতে থাকা স্টেনগান দিয়ে শূন্যে গুলি ছুড়ে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু,’ ‘তোমার নেতা-আমার নেতা শেখ মুজিব’ স্লোগান দিতে থাকে। মনে হয় ঢাকার কাছাকাছি কোন মফস্বল শহর থেকে তারা এসেছে। একটু দূরেই ব্যস্ত সড়কের ঠিক মাঝখানে গায়ে রাস্তার ধুলোবালি সারা শরীরে মেখে নাচছে একটা পাগল গোছের লোক। সে তার পায়ের কাছে মাটির দিকে স্থির তাকিয়ে আছে। ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক, হাড়পাজর বেরনো ক্ষয়াটে চেহারা, মুখেচোখে তবু উথলে পড়ছে সুখ।
ঝাঁচকচকে রোদ আর নীল আকাশের ফাঁকে সাদা মেঘের লুকোচুরিতে, যেন এক নতুন বসন্তের সূচনা। রোদ হি হি করে হাসছে। তবে শুধু কিছু কাক ডাকছে, আর কোনও পাখির স্বর শুনতে পাচ্ছে না রাহাত। মাথার উপর ইতস্তত কিছু চিল-শকুন উড়ছে। শীতের শুকনো পাতা খড়খড় করে উড়ে পড়ছে রাস্তায়। মগবাজার মোড় থেকে রাহাত হাঁটতে লাগল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনা যমুনার পাশ দিয়ে বেইলি রোডের দিকে। তার পাশ দিয়ে পাঁচ ছয়জন সাপুড়ে কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা বেতের ঝুড়ি ঝুলিয়ে হেটে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে দু-জন কিশোর প্রায়। এত সাপুড়ে একসঙ্গে? দিনদুপুরে সাপুড়েদের মিছিল? বেইলি রোডের মোড়টার কাছে গোল হয়ে বসেছে সেই সাপুড়েরা। কালো কাপড়ে জড়ানো তাদের বাঁশিগুলো খুলছে। এই ভোরে এখানে এত সাপুড়ে বসেছে কেন? রাহাতের মতো আরও অনেক লোক দাঁড়িয়ে পড়ে শুনছে তাদের বাঁশি।
সাপুড়েদের সর্দার বিড় বিড় করে বলল, আমরা আজ রেসকোর্স মাঠে বড়ো সাপ ধরবো।
একজন সর্দারকে বলল, ওখানে বড়ো সাপ আছে নাকি? ওখানে তো তেমন ঝোপ ঝাড়ও নাই।
সর্দার জড়ো হওয়া সকলের দিকে মুখ তুলে আগুনচোখে তাকিয়ে বলল, আছে, আজ মুক্তিরা বড়ো বড়ো সাপ ধরে নিয়ে আসবে ওখানে।
রাহাত বুঝতে পারল ওদের এই বাঁশি বাজানো তাহলে সাপ ধরার জন্য নয়।ওরা রেসকোর্স মাঠে জড়ো হওয়া হানাদার সেনাদের মাঝে বিষাক্ত সব সাপ ছেড়ে দিয়ে তাদের আক্রোশ মেটাতে চায়।
সাপুড়েদের বাঁশির শব্দ ও হাতের ভঙ্গিতে এখানে জড়ো হওয়া সকলের মাথা দুলছিল। বিজয়ের এই শুভলগ্নে রাহাতের সাপ দেখার একটুও ইচ্ছে হচ্ছিল না। সাপধরা দেখার জন্য রাহাত আর অপেক্ষা করতে চাইল না।
শীতের দিন খুবই ছোট, তাড়াতাড়ি দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। রাস্তায় রাহাত একা নয়, মানুষের মিছিল চলছে রেসকোর্স অভিমুখে। সূর্যাস্তের রঙিন আলোর বর্ণালি গায়ে মেখে সে বেইলি রোডে এসে দেখে, বন বিভাগের নার্সারির সামনে মোটাসোটা এক ব্যক্তির মরদেহ পড়ে আছে। মনে হলো, কোনো অবাঙালির মরদেহ। চারদিকে জনতার জটলা, কিছুক্ষণ ওখানে দেখে আবার চলা শুরু করল। রাহাতদের রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। পার্কের পশ্চিম পাশেই হচ্ছে রেসকোর্স।
সুগন্ধার সামনে এসে দেখে প্রধান ফটকের উল্টো দিকে রাস্তার পাশে এক পাকিস্তানি সেনাসদস্যের লাশ পড়ে আছে। আরেকটি লাশ রমনা পার্কের গেটের সামনে, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে তার দেহ। গেটের ভেতরে ঢুকতেই বাঁ দিকে ঘাসের ওপর পড়ে আছে লাশ। তার গায়ে ছিল কালো পোশাক। সম্ভবত ট্যাংকের সেনা; তার বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। জানা গেল, রাতে এখানে একটা ছোটখাটো যুদ্ধ হয়েছিল। হয়তো এরা আত্মসমর্পণ করতে চায়নি অথবা সেই সুযোগ পায়নি। হয়তোবা এরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল। কে জানে?
গোধূলির আকাশ থেকে কমলা রোদের আভা ধীরে ধীরে মুছে গিয়ে ধূসর কোমলতায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। রমনা পার্কের ফটক দিয়ে ভেতরে গিয়ে বাঁ দিকে অগ্রসর হলো রাহাত। এ সময় সে লক্ষ করল, তার বাঁ দিকের মাঠের পাশে পার্কের পূর্ব দিকে বকুলগাছের সারির নিকটে এক বিরাট কৌতূহলী জনতার ভিড়। সেই সঙ্গে সেও বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠল। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ পেরিয়ে কাছে যেতেই এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সম্মুখীন হল। কে বা কারা মাটিচাপা দেওয়া তিনটি কঙ্কাল উদ্ধার করে ওপরে নিয়ে এসেছে। তাদের পরনে শার্ট-প্যান্টগুলো অবিকৃত রয়ে গেছে।
বিজয়ের আনন্দঘন দিনে এ দৃশ্য দেখে সবার মনে এক বিষাদের করুণ ছায়া রেখাপাত করল। বেদনাভরা মন নিয়ে আবার রাহাত রওনা দিল কাছেই রেসকোর্স ময়দানের পথে। রমনা পার্ক পেরিয়ে যেতেই প্রচণ্ড ভিড়ের সম্মুখীন হল সে। ততক্ষণে শীতের দিন প্রায় শেষ, দিনমণি অস্তাচলে যেতে শুরু করেছে। ভিড় ঠেলে সাঁতরে সে যখন সামনে পৌঁছাল, ঠিক সেই সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী কুশীলবেরা- পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি আর সঙ্গের পাকিস্তানি জেনারেলরা এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরা আর সাথিরা সবাই প্রস্থান করছেন।
ততক্ষণে রাতের আঁধার নেমে এসেছে নগরীর বুকে। সূর্যের আলো মিলিয়ে যেতেই শীতের চাদর চারদিকে নেমে এল। মানুষের চেহারাগুলো সব আবছা হয়ে গেছে। একটা লাল-সবুজ রঙের বেলুন উড়তে উড়তে আসছে। নিঃসঙ্গ, দূরের যাত্রীর মতন। হঠাৎ কোথা থেকে এসে অসংখ্য ছোট ছোট নীল প্রজাপতি রঙিন ডানা মেলে উড়তে থাকল নেচে নেচে হালকা কুয়াশায় ঢাকা মাঠটার উপরে, দিগন্তের পানে ধেয়ে অনন্ত অসীমের কাছে। লাল-সবুজ নীল রঙে চোখে মুগ্ধতার ঘোর লেগে যায় তার। রাহাত এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ কেন এসেছে এই অতিকায় মাঠে? শহরের শ্রেষ্ঠ অংশে। অথচ কিছুই চিনতে পারছেনা।
মাথায় কী যেন একটা লাগতেই চমকে উঠল সে।
সেই লাল-সবুজ বেলুনটা। কখন নেমে এসেছে, রাহাতের গালে আর চুলে আদর করছে।
বেলুনটার গায়ে লেখা, জয় বাংলা, বাংলার জয়!
লেখক : কবি ও গল্পকার।