ফরিদ আহমেদ : কর্পোরেট জগত তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্য অনেক কৌশল ব্যবহার করে। এর মধ্যে অন্যতম একটা কৌশল হচ্ছে রঙ-বেরঙের বিজ্ঞাপন প্রদান। বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করা হয়। পণ্যের গুণাবলী সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে আকর্ষণীয়ভাবে প্রচার করা হয়। সেই প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে, বিশ্বাস করে ক্রেতারা পণ্য কেনে। কিনে কেউ সন্তুষ্ট হয়, কেউ বা ঠকে যায়।

প্রাণী এবং উদ্ভিদ জগতে বংশবৃদ্ধি করারও সবচেয়ে সেরা অস্ত্র হচ্ছে বিজ্ঞাপন। বংশ বিস্তারের সময় এলে উদ্ভিদ তার শক্তির একটা বিশাল অংশ ব্যয় করে নানা রঙের ফুল ফুটিয়ে। এটাই তার রঙীন বিজ্ঞাপন। এই বিজ্ঞাপন দেখেই কীট-পতঙ্গ, প্রজাপতি, মৌমাছি নামের ক্রেতারা আসে। তারা সেখান থেকে মধু আহরণ করতে লেগে যায়। মধুর সাথে ফুলের পরাগও নিয়ে যায় তারা। সেই পরাগ নিয়ে এক ফুল থেকে আরেক ফুলে দিয়ে আসে। কোনো কোনো উদ্ভিদ আবার ফুলের বদলে রসালো ফল তৈরি করে। ওটাই তার ঘুষ। ঘুষ দিয়ে যেমন কার্যসিদ্ধি করা হয়, এখানেও পদ্ধতিটা একই। উদ্ভিদ তার ঘুষের আড়ালে লুকিয়ে রাখে বংশ বিস্তারের বীজকে। ঘুষ নিতে যে আসবে, তাকে এই বীজকেও ছড়িয়ে যাবার সুযোগ দিতে হবে।

প্রাণীরা উদ্ভিদের মতো এমন ফুল-ফল তৈরি করে না। ফুল-ফল তৈরি না করলেও, তারাও ঠিকই বিজ্ঞাপনের আশ্রয় নেয়। ডিম্বস্ফূটনের সময়ে নানা ধরনের দৃশ্যমান কিংবা ঘ্রাণময় বিজ্ঞাপন তৈরি করে নারী প্রজাতিটা। সেটা দেখেই পুরুষরা আকৃষ্ট হয়। যৌন মিলনের জন্য তাড়নাবোধ করে তারা। যে নারী এই সব সংকেত প্রদর্শন করছে না, তার সাথে মিলিত হবার ব্যাপারে পুরুষ প্রাণীদের মনে আগ্রহ সঞ্চারিত হয় না। এর সহজ কারণ হচ্ছে এই কাজটাতে যে শক্তিক্ষয় হবে, সেটা মূলত তার জন্য অপচয়। ডিম্বস্ফূটনের এই স্বল্পকালীন উন্মুক্ত সময়ে নারীরা যেমন মিলনের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে, পুরুষেরাও তেমনি সাগ্রহে সাড়া দেয় তাতে। বেবুনের কথাই ধরুন। নারী বেবুনের ডিম্বস্ফূটন ঘটলে তার প্রচার ঘটে সাড়ম্বরে। নারী বেবুনের যৌনাঙ্গের চারপাশের অংশটা ফুলে ওঠে। একই সাথে সেটা উজ্জ্বল লাল বর্ণ ধারণ করে। এমন উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন সবচেয়ে বুদ্ধু পুরুষ বেবুনটারও চোখ এড়াবে না। ডিম্বস্ফূটনের এই কালে শতাধিকবার সঙ্গমে লিপ্ত হয় নারী বেবুন। গর্ভবতী হবার আপ্রাণ প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় সে। কারণ, এটাই তার সুযোগ বংশবৃদ্ধি করে নিজের জিনকে পরের প্রজন্মে ছড়িয়ে দেবার। এই কাজটা না করলে সে হারিয়ে যাবে জিনপুল থেকে। এই সময়টার বাইরে সে নিজে যেমন যৌন মিলনে অনাগ্রহী থাকে, পুরুষেরাও তেমনি কোনো আগ্রহ দেখায় না তার প্রতি অনুর্বর ভূমি বলে। অনুর্বর ভূমিতে ফসল ফলানোর প্রচেষ্টা সময় এবং সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়।

প্রাণী জগতে মানুষও আরেকটা প্রাণীর বাইরে কিছু না। তার যৌন আচরণ অন্য প্রাণীদের মতোই হবার কথা ছিলো। কিন্তু, আশ্চর্যজনকভাবে মানুষের যৌন আচরণ অন্য প্রাণীদের চেয়ে ভিন্ন। ডিম্বস্ফূটনের কালে নারীরা কোনো দৃশ্যমান সংকেত প্রদান করে না। সংকেত দেওয়াতো দূরের কথা, অনেক সময় নিজের ডিম্বস্ফূটনকালটাকেই চিহ্নিত করতে পারে না মেয়েরা। যেখানে সে নিজেই জানে না কখন তার ডিম্বস্ফূটন হচ্ছে, সেখানে সংকেত পাঠাবার প্রশ্নটা একেবারেই অবান্তর। যেহেতু নির্দিষ্ট করে ডিম্বস্ফূটনের দৃশ্যমান কাল নেই, মানবী তাই সারা বছরই যৌনতার জন্য প্রস্তুত থাকে। পুরুষেরাও ডিম্বস্ফূটনের সময়কাল বিবেচনাতে না নিয়েই বাছবিচারবিহীনভাবে যৌনতায় অংশ নেয়। বিবর্তনের দিক থেকে এই কাজটা একটা অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, নি¤œ বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণীদের নারীরা যেখানে নিজেদের ডিম্বস্ফূটনের কালকে সহজে চিহ্নিত করতে পারে, মানুষের মতো বুদ্ধিমান একটা প্রাণীর নারী অংশ সেটাকে নিজেরাই আলাদা করতে পারছে না। এটা একটা অদ্ভুত এবং আশ্চর্য ব্যাপার!

মানুষের যৌনতার এই অদ্ভুত বিষয়টা বিজ্ঞানীদের ধাঁধাঁর মধ্যে রেখেছে। ঠিক কোন কারণে নারীদের ডিম্বস্ফূটনকাল দৃশ্যমান না, উপলব্ধিযোগ্য নয়? আপাতদৃষ্টিতে এই অদ্ভুত বিষয়টা বংশবিস্তারের জন্য সুবিধাজনক নয়। কিন্তু, তারপরেও এটা আছে। তারমানে কোনো না কোনো সুবিধা দিচ্ছে এই অদ্ভুত বিষয়টা।

বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর হিসাবে যেটাকে সবচেয়ে বেশি সামনে নিয়ে এসেছে, সেটা হচ্ছে মানব শিশুর অসহায়ত্ব। মানব শিশু যখন জন্ম নেয়, সে একটা অসহায় মাংসপিণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। বাবা-মায়ের প্রচুর পরিমাণ যত্ন লাগে তাকে টিকিয়ে রাখতে, বড় করতে। শুধু যে অসহায় হয়েই মানব শিশু জন্ম নেয়, তা নয়। জন্মের পর থেকে পূর্ণ বয়স্ক সাবলম্বী হবার সময়কালটাও তার অনেক দীর্ঘ। এই দীর্ঘ সময়েও সে নির্ভরশীল থাকে বাবা-মায়ের উপরে। বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীর নারীটা একাই বাচ্চাদের যত্ন নিতে পারে। বাবার সাহায্য সেখানে না হলেও চলে। সঙ্গম ছাড়া নারীটা পুরুষের উপর কোনোভাবেই নির্ভর নয় তার বাচ্চার জন্ম এবং বড় করার ক্ষেত্রে। মানুষের ক্ষেত্রে তা বিষয়টা তেমন নয়। মায়ের একার পক্ষে সন্তান লালন-পালন করাটা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। আজকের আধুনিক যুগে এসে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতার শক্ত ভূমিতে দাঁড়িয়েও, সিঙ্গল মাদাররা হিমসিম খায় বাচ্চা মানুষ করার ক্ষেত্রে। আদিম যুগে এটা কেমন কঠিন ছিলো সেটা সহজেই অনুমেয়। বাচ্চার বাবা সন্তানের লালন-পালনে দায়িত্ব না নিলে, সেই বাচ্চাকে টিকিয়ে রাখাটাই একটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হতো। এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করার একটাই উপায় ছিলো, সেটা হচ্ছে পুরুষ সঙ্গীকে ধরে রাখা।

তো, সেই আদিম যুগে সঙ্গীকে ধরে রাখার জন্য নারীদের স্ট্রাটেজি কী হতে পারতো? একজন পুরুষের ক্ষেত্রে যৌনমিলনের পরেই আর কোনো কাজ থাকে না। সঙ্গীর কাছে পড়ে থাকাটা তার জন্য সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। সে তখন ছুটবে আরেক উর্বরা নারীর কাছে। যতো বেশি উর্বরভূমি সে পাবে, ততো বেশি ফলন তার হবে। জিন টিকিয়ে রাখার তীব্র প্রতিযোগিতায় সে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। এই ফুলে ফুলে উড়ে বেড়িয়ে মধু খাওয়া উড়ুক্কু পুরুষকে ধরে রাখাটাই ছিলো নারীদের জন্য সবচেয়ে কঠিন একটা কাজ। এই কঠিন কাজটা করতে গিয়ে দারুণ এক বুদ্ধির উদ্ভাবন করে তারা। শুধু ডিম্বস্ফূটনের কালেই না, সারা বছরই যৌনতার জন্য সচল থাকতে হবে। কখন জমি উর্বর হচ্ছে সেটা পুরুষকে বুঝতে দেওয়া যাবে না। সন্তুষ্ট পুরুষ তখন আর অন্য কোনো নারীর কাছে যাবার তীব্র আগ্রহবোধ করবে না। তার সাথে লেপ্টে থাকবে, তার বাচ্চা-কাচ্চা লালন-পালনে সহযোগিতা করবে। যে কারণে প্রাণীজগতের অন্য প্রাণীরা যেখানে যৌনতায় লিপ্ত হয় মূলত বংশবিস্তারের নিমিত্তে, মানুষ সেখানে এটাকে নিয়ে গিয়েছে বিনোদনের পর্যায়ে। এটা নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে আঠা হিসাবে কাজ করেছে। পিরিতি কাঁঠালের আঠা বলে একটা কথা আছে না, এটা হচ্ছে সেই আঠা। মানুষের ক্ষেত্রে এটা আরো জরুরী ছিলো। কারণ, অন্য প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষ ঘন বসতিতে বসবাস করতো। ফলে, একজন পুরুষের পক্ষে অন্য যৌনসঙ্গী খুঁজে পাওয়াটা খুব সহজ ছিলো। এই রকম এক বহির্মুখী লোভী বাঁদরকে ধরে রাখার জন্য গুহার দরজায় তাই কলার কাঁদি ঝুলিয়ে দেওয়া ছাড়া নারীদের কোনো উপায় ছিলো না।

এই কাজটা কি মেয়েরা সচেতনভাবে, বুঝে শুনে করেছে? খুব সম্ভবত না। যে নারীর ডিম্বস্ফূটন যতো কম দৃশ্যমান, সে বিবর্তনে ততো বেশি সুবিধা পেয়েছে। ফলে, তার সন্তানেরা টিকে গিয়েছে। যে নারীর ডিম্বস্ফূটনকাল গোলাপ ফুলের মতো উজ্জ্বল বিজ্ঞাপনে পরিপূর্ণ, সে ওই সময়ের পরে আর সঙ্গীকে ধরে রাখতে পারেনি। বিজ্ঞাপন শেষ, পুরুষও হাওয়া। সময় গড়ানোর সাথে সাথে তাই এই উজ্জ্বল বিজ্ঞাপনের নারীদের জিন হারিয়ে গিয়েছে। টিকে থেকেছে বিজ্ঞাপন কম করা নারীরা। আর এখনতো বিজ্ঞাপনই নাই। বিশাল মূল্যহ্রাসের আলাদা কোনো বিজ্ঞাপন নেই স্বল্পকালীন সময়ে বিক্রি বাড়ানোর জন্য। বাজার এখন মোটামুটি সুস্থির। বিজ্ঞাপনের আলাদা কোনো ভূমিকা নেই আর।