সাজ্জাদ আলী : সেন্ট-লরেন্স মার্কেট এলাকার চার্চ স্ট্রীটে স্টেফিনি গাড়ি পার্ক করলো। রাস্তার পার্কিং মিটারে খুচরা ১১ ডলার ঢেলে দিয়ে সারাটা দিনের জন্য পার্কিংয়ের মাশুল গুনলো সে। গত নয় বছর ধরে আমরা দুজন দুজনের হাঁটা-সঙ্গী। এই হাঁটাহাঁটির বাইরে আমাদের যোগাযোগ সামান্যই। গ্রীষ্মকালে মাসের দুটি দিন আমরা স্বাস্থ্যরক্ষা আর মনের আনন্দের জন্য টরোন্টো এবং আশপাশের শহর সংলগ্ন বন বাদাড়ের ওয়াকিং ট্রেইলে হেঁটে বেড়াই। তবে আজ হাঁটবো না, ঠিক করেছি দুখানা সাইকেল ভাড়া করে সারাটা দিন ডাউন টাউনে ঘুরবো। পরিবেশ রক্ষার চিন্তা থেকে সিটি অব টরন্টো নাগরিকদের সাইকেল চালানোয় উৎসাহ দেয়। শুধুমাত্র বাইক চলার জন্য শহরের রাস্তায় আনুমানিক ৬৫ কিলোমিটারের মতো বিশেষ লেন রয়েছে। এই সব লেনে গাড়ি চালানো, পার্ক করা, বা ক্ষণিকের জন্য গাড়ি থামানো, এমনকি পায়ে হাঁটাও মস্ত অপরাধ!
সেন্ট-লরেন্স মার্কেটটি টরন্টো’র আদি হাটবাজার। ১৮০০ শতকের একেবারে গোঁড়ার দিকে এই এলাকার জনঘনত্ব যখন বাড়তে থাকে, তখনই মার্কেটটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আদি সেই আদল আজও যেন স্পষ্ট, আধুনিকতাকে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলেছে এই মার্কেট। পুরোনো আমলের ভবনটিতে হাতে তৈরি কারুশিল্প, বরফ না দেওয়া তাজা মাছ, বিনা সারে ফলানো সব্জি, চাক ভাঙ্গা মধু, কয়লায় পোড়ানো মাংসের কাবাব -এমনই সব পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন ছোট ছোট দোকানীরা। টরন্টো’র ধনী এবং গরীবেরা প্রতি উইকএন্ডে ভিড় জমায় এই মার্কেটটিতে। ওখানটায় রাস্তার পাশে ভ্রাম্যমান দুটো কফির দোকান। তারই একটির বেঞ্চিতে বসে টোস্টেড ব্যাগেল আর কফি দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে আমরা দিনের পরিকল্পনা আটছিলাম।
“আমার নাম জনি, সকাল থেকে কিছুই খাইনি, তোমরা কি আমার জন্যে একটা ডিমের অমলেট আর কফি অর্ডার করতে পারো, প্লিজ?” আমাদের বেঞ্চির সামনে এসে দাঁড়িয়ে একজন ভিক্ষুক এমনই আকুতি জানালো। এ দেশে ভিক্ষুকদের আমরা “হোমলেস” নামে ডাকি।
সাথে সাথেই স্টেফিনি ডিম আর কফি অর্ডার করে জনিকে আমাদের বেঞ্চে বসার জায়গা করে দিল। ৪/৫ দিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি তার মুখে, পরনের জিন্সের প্যান্ট এবং গায়ের টি-শার্ট যারপরনাই নোংরা, হাত ঘড়িটি অচল বলেই মনে হলো। তবে চোখের কালো রংয়ের চশমাটি বেশ দামি, রে-বান ব্রান্ডের। দুহাতের ধবধবে সাদা চামড়ায় বর্ণিল সব উল্কি আঁকা। অপরিচ্ছন্নতার জন্য ওর শরীর থেকে এক ধরণের বোটকা গন্ধ বেরুচ্ছে। জনি বসেছে আমাদের দুজনের মাঝে। কথা বলছে স্টেফিনির সাথে।
আজ দিনের শুরুটা ভারি সুন্দর, তাই না?
হাঁ, বেশ সহনীয় তাপমাত্রা।
হাসবেন্ডকে নিয়ে কেনাকাটা করতে এসেছো?
না, আমরা দুজন বন্ধু। আজ ডাউন টাউনটা সাইকেলে চড়ে ঘুরবো।
তা বেশ, চমৎকার এই দিনটিকে উপভোগ করার অভিনব পরিকল্পনা করেছ তোমরা। গুডলাক!
স্টেফিনি অত্যন্ত সহজভাবে জনির সাথে কথা বলছে, তাকে আপ্যায়ণ করছে। আমার কিন্তু ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না। এই ২১/২২ বছরের প্রাণবন্ত ও সমর্থ একজন যুবক কি না রাস্তায় চেয়েচিন্তে খাচ্ছে! এ-কথা সে-কথার ফাঁকে জানতে চাইলাম,
জনি, কতদুর পড়েছ?
হাই স্কুল গ্রাজুয়েশন করেছি, আর পড়তে ভাল লাগে না।
তোমার বাসা কোথায়? এই এলাকার কাছাকাছি কি?
মায়ের বাড়ি নায়াগ্রা ফলসের ওখানটায়। ৮/৯ মাস হলো সেখানে যাই না।
মায়ের সাথে যোগাযোগ আছে?
হাঁ, সে প্রায়ই ফোন করে।
রাতে ঘুমাও কোথায়?
গতরাতে রাস্তার উল্টোদিকের বাসস্ট্যান্ডের ওই শেডের তলে ঘুমিয়েছি। কথাটা বলে জনি আঙ্গুল তুলে স্থানটি দেখালো।
তখনই প্রায় ৫০০ গজ দূর থেকে উচ্চস্বরে এক মেয়ে কন্ঠ ডেকে উঠলো, এই জনি, আমি এখানটায়।
কাগজের ঠোঙ্গায় ভর্তি ডিমের অমলেট আর কফির কাপ হাতে নিয়ে জনি উঠে দাঁড়ালো। বলল, ওটা মার্গারেট আমার গার্লফ্রেন্ড। যাই, অমলেটটা দুজনে মিলে খাবো। তোমরা দিনটি এনজয় করো। মেনি থ্যাংকস!
“বাইক শেয়ার” নামের সাইকেল ভাড়া দেবার একটি প্রতিষ্ঠান আছে টরন্টোতে। শহরের ৬২৫টি লোকেশনের যে কোনটি থেকে ক্রেডিটকার্ড পেমেন্টের মাধ্যমে বাইক ভাড়া করা যায়। আমরা ১৪ ডলার দিয়ে সারা দিনের জন্য দুখানা সাইকেল ভাড়া নিয়েছি। আমার তুলনায় স্টেফিনি দুর্বল চালক, খানিক বাদে বাদেই পিছিয়ে পড়ছে। সে অবশ্য হাঁটায়ও দূর্বল, আধা কিলোমিটার হাঁটার পরেই হাঁপাতে থাকে। তখন আমার কাঁধে কুনুই ঠেকিয়ে খানিকটা জিড়িয়ে নেয়। হাঁটার চড়াই উৎরাইয়ের মধ্যে ওর কুনুইয়ের সেই স্পর্শ-চাপে “আরো হাঁটার” উদ্দীপনা পাই! তো সেই বিবেচনায় বাইকের তুলনায় হাঁটায়ই আমার অধিক সুখ-লাভ।
প্রতিটি রাস্তার বাইক লেনগুলো জানজটহীন ও মসৃণ। প্যাডেল চাপলেই তরতর করে সাইকেল এগিয়ে চলে। আমাদের প্রথম গন্তব্য চায়না টাউন। করোনার কারণে শহরের রাস্তাঘাটে লোকের ভিড় কম, পর্যটক তো একেবারেই নেই শহরে। সবাই পরস্পরের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখছে, মুখে মাক্স পরা। যাত্রা পথে ডান্ডাস স্কয়ারে হট-ডগের দোকান দেখে স্টেফেনি তা খাওয়ার বায়না ধরলো। সে খাবে শুয়োরের মাংসের আর আমার পছন্দ গরুর মাংসেরটা। স্কয়ারের সুদৃশ্য পাথরের বেঞ্চিতে বসে আয়েশ করে হট-ডগ খাচ্ছি। চেয়ে দেখি রাস্তার উল্টোদিকে এক হিস্পানিক নারী ফেরি করে “হাওয়াই মিঠাই” বিক্রি করছে। এদেশের লোকেরা অবশ্য ওটাকে “কটন ক্যান্ডি” বলে। দৌঁড়ে রাস্তা পার হয়ে লাল ও নীল রংয়ের দুটো হাওয়াই মিঠাই কিনে আনলাম। স্টেফিনিকে বললাম, কোন রংয়েরটা তোমার পছন্দ? সে ততক্ষণে হট-ডগ খাওয়া শেষ করে মশলা লেগে থাকা আঙ্গুলগুলো চুষছে। মিঠাই সে খেল না। তবে তাতে আমার মধ্যে অখুশির কোনো লক্ষণই দেখতে পেলাম না।
আবার রওনা হবার পালা। আমি সাইকেলে চড়ে বসেছি, আর স্টেফিনি বেঞ্চিখানা টিসু পেপার দিয়ে মুছে রাখছে। এমন সময় ওর পরিচিত দুই নারী সেখানটায় এসে হাজির। ওরা নিজেদের মধ্যে “কেমন আছ, ভাল আছি, কতদিন দেখিনা” টাইপের কথাবার্তা বললো খানিকক্ষণ। আমি হাত দশেক দূরে মাটিতে পা ঠেকিয়ে সাইকেলে বসে আছি স্টেফিনির অপেক্ষায়। দুজন নারীই ভারি সুন্দরী, দেখতে একেবারে মনকাড়া, অপরূপা যৌবনবতী। একজন কালো গোত্রের, আরেকজন সাদা। আমি দুচোখ মেলে ওদের উচ্ছল রূপ দেখছিলাম। স্টেফিনি আমাকে লক্ষ করে বলল, নেমে এসো, আলাপ করিয়ে দিই। সাইকেল দাঁড় করিয়ে কাছে যেতেই বললো, ও আমার বন্ধু, খুব ভাল বন্ধু আমরা। স্টেফিনির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কালো মেয়েটি বলে উঠলো, আমি মারিয়া আর ও আমার হাজবেন্ড জুলিয়েট।
এ মেয়ে বলে কি? আমি থতমত খেয়ে একবার ওদের দিকে আবার স্টেফিনির দিকে তাকাচ্ছি। দুজনেই গ্লাভস পরা দুখানা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমার দিকে, মিলাবে বলে। আমার হাতে গ্লাভস নেই, তাছাড়া এই সুন্দরীদের স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কের ব্যপারটায়ও আমি বেশ ভড়কে গেছি। ওদের দিকে হাত এগোচ্ছি আবার পিছিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু হাত আর মেলাতে পারছি না। আমার দুরবস্থা দেখে স্টেফেনি মুচকি হাসলো। তবে আমাকে উদ্ধারও করলো। বললো, গ্লাভস নেই তো কী হয়েছে, তুমি হাত মিলাও; ওরা দুজনই আমার পুরোনো বন্ধু। গত মাসে তারা রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে করেছে। আমি হাত তুলে আর্শিবাদের ভঙ্গীতে বললাম, সুখে থাকো তোমরা।
কী বিচিত্র এই জগত সংসার! কত বৈচিত্র এই প্রাণীকুলে! কোনটা সঠিক, আর কীই -বা বেঠিক? উচিৎ অনুচিতের নির্ণায়কই বা কে? যথার্থতার সংজ্ঞা কি তবে নিত্য পাল্টায়? মানব-মানবীর সম্পর্কের রূপ জটিলতর হচ্ছে কি দিন দিন? এইসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে সাইকেল প্যাডেল করে এগুচ্ছি। পরবর্তী লালবাতিতে স্টেফিনি ঘাড়ের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
দুটো মেয়ে বিয়ে করেছে, এটা তুমি মেনে নিতে পারছো না; তাই না?
আরে না না সে কথা না। তবে হাঠাৎ শুনে কেমন যেন ধাক্কা লেগেছিলো। এ বিষয়টা এখন সমাজ মেনে নিয়েছে, রাষ্ট্র স্বীকার করছে। এটার পক্ষেই তো এখন সচেতন নাগরিক সমাজ। আমার যৌক্তিক মনও ওদের স্বগত জানায়।
তবে তোমার মুড-অফ হয়ে গেল কেন?
না ভাবছি, যে ব্যপারটা ওরা নিজেরা কেন মানতে পারছে না? দেখ না ওরা একজন আরেকজনকে স্বামী-স্ত্রী বলে পরিচয় দিল। প্রাচীন সেই দাম্পত্ব্য কনসেপ্ট থেকে ওরা নিজেরাই তো বেরুতে পারছে না। সাহস করে বুক ফুলিয়ে বলতে তো পারলো না যে আমরা দুজন লাইফ পার্টনার। ওদের চিন্তার জগতে ওরা তো সেই একজন নারী, আরেকজন পুরুষই রয়ে গেল?
বাতি সবুজ হলো, প্যাডেলে পা চালালাম আমরা। চায়না টাউনটা ঘোরা শেষ করে টরন্টো এসপ্লানেড এলাকার “দ্যা কেগ” স্টেক হাউসের বাইরের বারান্দায় বসে দুপুরের খাবার সারবো বলে ভেবে রেখেছি। স্টেফিনি সে খরচের ভার নিয়েছে। ৩২ আউন্সের একখন্ড ভেড়ার মাংস ভাল করে পুড়িয়ে নিয়ে আজ ঘন্টাব্যাপী বসে আয়েশ করে খাবো। চায়না টাউন ঘুরে ঘুরে স্টেফিনির জন্য কপালের টিপ, চুলের ক্লিপ, বক্ষবন্ধনী, মুখে মাখার হারবাল ক্রীম ইত্যাদি সব কেনাকাটা হলো।
সে প্রতিটি দোকানে ঢুকে প্রথমেই বাঁশের তৈরী ব্যাক স্ক্রাচার খুঁজছে। কিন্তু কোন দোকানেই পিঠ চুলকানোর এই হাতলটি পাওয়া যাচ্ছে না। সাইকেল ঠেলে ঠেলে দোকানে দোকানে যাওয়ায় বেচারী বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। “ফ্রিজে ঠান্ডা” এক বোতল ডাবের জল কিনে ওকে খাইয়ে দিলাম। বললো, কিছু একটা হয়েছে পিঠে জানো, সারাক্ষণ শুধু চুলকায়। এই ব্যাক স্ক্রাচারটা আমার খুবই দরকার। ভাল করে খোঁজ তো। আমি বললাম,
পিঠ চুলকে দেবার জন্য তুমি আমাকে নিয়োগ করছো না কেন?
না করার উপযুক্ত কারণ আছে। বলে রহস্যপূর্ণ হাসি দিলো সে।
আমি তোমার ভালো বন্ধু, এই চাকরির উপযুক্ত প্রার্থিও বটে। তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে পারো না।
আরে না না, কাজটি তুমি খুব ভাল পারবে, করবেও মন দিয়ে। সে আমি বুঝি। সমস্যা অন্য জায়গায়। তুমি এখন চুলকাচুলকি শুরু করলে আমার খুব অনুতাপ হবে যে গত নয়টি বছর এ সুবিধা নিলাম না কেন? হাসতে হাসতে দুজনেরই মাটিতে গড়িয়ে পড়বার যোগাড়!
লেক ওন্টারিও’র জল ঘেষে এঁকেবেঁকে বাইক লেন চলে গিয়েছে অন্টারিও প্লেস পর্যন্ত। টরন্টো শহরের দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাগুলোর মধ্যে এই অন্টারিও প্লেসটি অন্যতম। লেকের জলে কৃত্তিমভাবে একাধিক দ্বীপ সৃষ্টি করে তার উপরে এই থিম পার্কটি গড়ে তোলা হয়েছে। এখানটায় নাগরিকদের উপভোগের জন্য রয়েছে উন্মুক্ত সবুজ আর দৃষ্টির শেষ সীমানা পর্যন্ত জলরাশি। আরো আছে থ্রী-ডি সিনেমা, ১৬,০০০ দর্শক ধারণের ক্ষমতা সম্পন্ন কনসার্ট হল, ওয়াটার পার্ক, প্রমোদতরীবাজদের প্রাইভেট ডক ইত্যাদি। মৃদুমন্দ বাতাসেও লেকের জলে প্রকান্ড সব ঢেউ ওঠে, আর তা আছড়ে পড়ে ভিজিয়ে দেয় থিমপার্কটিকে।
এখানটায় কোনো মোটর গাড়ির চলাচল নেই। দ্বীপগুলোর অলিগলি দিয়ে রয়েছে বেশ কয়েক কিলোমিটারের বাইক লেন। এই অন্টারিও প্লেসের মধ্যে সাইকেল চালনায় স্টেফিনিকে অনেক প্রাণবন্ত লাগছে। আমাকে পেছনে ফেলে সে সদাই এগিয়ে থাকছে। একটা মোড়ের বাঁক ঘুরতেই ব্রেক কষে সাইকেল দাঁড় করালো সে। ২৩/২৪ বছরের অনিন্দ সুন্দরী এক মেয়ে ল্যাম্প পোষ্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। অপরূপ তার দেহ সৌষ্ঠব। শরীরের যেখানটায় যতটুকু উঁচু নিচু থাকলে তার শোভা বাড়ে, বিধাতা যেন তার সেখানটা ঠিক সেভাবেই সৃজন করেছেন। পরনে হাফ প্যান্ট, গায়ে শুধু বক্ষবন্ধনী, মাথা ভর্তি এলোমেলো সোনালী চুল। তার যা কিছু সৌন্দর্য আছে, তার প্রায় পুরোটাই সে মেলে রেখেছে। রূপ-লাবণ্যের এমন নিরাভরণ প্রকাশ সচরাচর চোখে পড়ে না। এক খন্ড শক্ত কাগজের বোর্ড সুতা দিয়ে তার গলায় ঝোলানো। তাতে ইংরেজি হরফে হাতে লেখা “বাড়ি ফিরতে সাহায্য চাই”।
স্টেফিনি বললো, তোমার কাছে ২০ ডলার ক্যাশ আছে? ওকে দাও না প্লিজ। ডলারের নোটটা মেয়েটির হাতে তুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
তোমার নাম কি গো? বাড়ি কত দূরে?
আমি সোফিয়া। প্রিন্স এডওয়ার্ড আইল্যান্ডের কর্ণওয়েল কাউন্টি থেকে এসেছি।
সে তো অনেক দূর! এই করোনা’র মধ্যে টরন্টো এসেছো কেন?
সৎ মায়ের সাথে বনিবনা হয়না বলে এখানে কাজের খোঁজে এসেছিলাম। কিন্তু প্যানডামিকের কারণে কোনো চাকরি পাইনি। এখন ফিরে যেতে ৬০০ ডলার জোগাড় করতে হবে।
তা ক’দিনে কত ডলার জোগাড় করতে পেরেছো?
৫ দিনে ৪০০ ডলার জমেছে।
তাহলে তো আর দুএক দিনেই তোমার প্লেনের ভাড়া জোগাড় হয়ে যাবে। অবশ্য থাকা খাওয়ার জন্য প্রতিদিনই তো তোমার অনেক ডলার খরচ হয়ে যায়।
তা হয়, তবে ডাউন টাউনে সারাদিন ঘুরে ফিরে যাদের সাথে পরিচয় হয়, তাদের মধ্য থেকে পছন্দসই কোনো একজনকে বেছে নেই। তার এপার্টমেন্টেই রাতে থাকি। হোটেল ভাড়া এখন পর্যন্ত লাগেনি।
বাহ! তোমার এই আয়োজনটা অভিনব তো! আগে কখনও শুনিনি!
সবাই আমাকে পছন্দ করে। তবে আমি কাকে পছন্দ করছি, সেটাই কথা।
আজ কোথায় থাকবে ঠিক করেছ?
এখনও সিদ্ধান্ত নিই নি, তবে একজনের ফোন নম্বর রেখেছি।
সোফিয়ার দ্রæত বাড়ি ফিরে যাওয়া, আর আজ রাতের জন্য একজন সুসঙ্গী কামনা করে আমরা বিদায় নিলাম। সাইকেলে প্যাডেল করছি আর ভাবছি, দেশ ও সমাজ ভেদে মানুষের জীবন চিন্তা কতটা তফাৎ হতে পারে! কানাডা’র সোফিয়া আর বঙ্গদেশের সুপিয়াদের সজ্জাসঙ্গী নির্বাচনের উদারতার কি আকাশ-পাতাল ব্যবধান!
স্টেফিনি খানিকটা দ্রুত প্যাডেল করে সাইকেল আমার সমান্তরালে চালাতে চালাতে বললো,
তুমি তো সোফিয়াকে পছন্দ করেছো। তাহলে ওকে আজ তোমার অতিথি হবার অনুরোধ করলে না কেন?
দেখ, ওর সৌন্দর্যমন্ডিত উপস্থিতি আমি পছন্দ করেছি বটে, তবে এমনতর অতিথি সমাদরে আমার মানসিক প্রস্তুতি নেই। আমি বরং তোমার অতিথি হবার জন্যই নিরন্তর অপেক্ষা করবো।
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)