হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
যেখানে প্রত্নতাত্তি¡ক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল, সেই স্থানটার নাম বটেশ্বর। এই বটেশ্বর এলাকা আর আশেপাশের মাইলের পর মাইল এলাকা লাল টিলায় আর ঘন অরণ্যে আচ্ছাদিত। এখানেই রাজারবাগ গ্রামে আমার আপন ছোটো খালা থাকতেন। সেই বাড়িতে আর সেই অঞ্চলে অসংখ্যবার গেছি। মাটির ঘর, জলপাই আর আনারস বাগান, লিচু আম আর কলা আর কাঁঠালের বাগানের এত নান্দনিক সৌন্দর্যের স্থান দেখা যায় খুব কমই। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত সব ঋতুতেই এই এলাকাটির সৌন্দর্য ভাষায় বর্ণিত হবার মতো নয়।
অনেকবার নিটোল জোছনায় বনেবাদাড়ে ঘুরে বেরিয়েছি। গানের আসর বসাতাম উঠোনে। সেখানে শরীক হতো খালা, খালাতো বোনেরা আর দুয়েকজন প্রতিবেশী। গান গাইতাম- ‘সেদিন দু’জনে দুলেছিন- বনে, ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা..।’
অঞ্চলটাকে স্থানীয়ভাবে ডাকা হয় ‘পাওরা’ এলাকা বলে। বোধহয় ছোটো ছোটো টিলা বা উঁচুনিচু জায়গার কারণে। একবার নভেম্বর মাসে সেখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। অতিমাত্রায় গাছাগাছালি আর জঙ্গুলে প্রকৃতির কারণে প্রচণ্ড শীত পড়ে সেই অঞ্চলে।
একরাতে আমার নির্ধারিত মাটির ঘরের কামরায় লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিলাম। পাতায়-পাতায়, আর চালে বৃষ্টির শব্দের মতো শিশির ঝরছিল। নিকষ কালো রাত্তির ছিল সেই রাতটা। আমার কামরার ছাউনির ছাতের ওপর ছিল একটা বিশাল জলপাই গাছে। নধর টসটসে জলপাইয়ে ছেয়ে গিয়েছিল গাছটা।
অনেক সময় রাজারবাগ বেরিয়ে সেখান থেকেই চলে যেতাম ভৈরব বা তার একটি পরের স্টেশন পার হয়ে ছয়সূতিতে, মানে নানার বাড়িতে। ভৈরবে আমি, আলম ও শিমূল এমনকি আমার কনকর্ডের কলিগ ও বন্ধু হাফিজ বহুবার ঘুরেছি। ভৈরবে একটা সময় আমার বেশ কিছু কর্মতৎপরতা ছিল। মানে সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছিলাম।
একবার গিয়েছিলাম চোরাপথে আসা ইন্ডিয়ান শাড়ির আগ্রাসী অবৈধ ব্যবসা সম্পর্কে প্রতিবেদন করতে। অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করেছিলাম। তখন আমি নিউনেশনে সাংবাদিকতা করতাম। আমার কাজ ছিল ডেস্কওয়ার্ক। জায়গাটা আমার পরিচিত বলেই এডিটর আমাকে তদন্তের জন্য পাঠালেন।
মাঝরাত। আমার ঘুম আসছিল না। কোথা থেতে নরকের মতো হল্লা ভেসে আসছিল। বাড়ির সবাই চাপা স্বরে ‘ডাকাত’ বলে উঠল। আমাদের জায়গাটায় একটা বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির দূরত্ব অনেক। তাই সাহায্য পাবার আশা বৃথা। তাছাড়া, সব বাড়িই ডাকাতদের লক্ষ্য। এখন তারা কেউ নিশ্চিত নয় কোন বাড়ির ওপর দুর্যোগ নেমে আসবে। খালাম্মা ও তার ছেলেমেয়েরা মাটি গর্ত করে সব গহনা ও মূল্যবান জিনিস মাটিতে পুঁতে ফেললেন। আমাদের দলে মুলত দুজন। আমার খালাত ভাই বয়সে ছোটো। মেয়েরা বড়। তাই বলে তারা তো আর ডাকাত সামলাতে পারবে না। রইলাম আমি ও খালাত বোনদের চাচাত ভাই। সে কুংফু-কারাতে জানে। আগের দিন সে কাঠের শক্ত তক্তা কারাতে মেরে ভেঙে ফেলে ছিল। আমি একটা শক্ত গাছের ডাল জোগাড় করলাম। খালুর বয়সজনিত কারণে তাকে ঘরে থাকতে বললাম।
ব্যস আমরা প্রস্তুত। কিন্তু ডাকাতদের হা-হা হুম হুম হাম চিৎকার অন্যদিকে মিলিয়ে গেল। ওরা দুরের অন্যকোনো হতভাগ্য গেরস্থ বাড়িতে হয়তো হামলা চালিয়েছে। বাড়িময় পাহাড়া দিতে দিতে আমার কেন যেন জিম করবেটের সেই রুদ্রপ্রয়াগের চিতার (চিতাবাঘ) কথা মনে পড়ে গেল। (ভারতবর্ষে প্রকৃত চিতা নেই; সেটা আফ্রিকার সাভানা অঞ্চলে বিদ্যমান, ডাকার সুবিাধার্ধে ভারতীয় চিতাবাঘ বা লেপার্ডকে এখা ‘চিতা’ বলা হচ্ছে।
জিম করবেটের সেই ধূর্ত চিতাবাঘ পাঁচশ’ বর্গমাইল এলাকায় বহুবছর কারফিউ জারি করে রেখেছিল তার ধূর্তামি ও হি¯্রতা দিয়ে। আমি যেন ফিরে গেলাম সেই জিম করবেটের ধূর্ত-শয়তান মানুষখেকো চিতাবাঘের রাজ্যে। তেমনি গা শিরশির করা নিশুতি রাত, তেমনি পটভূমি ও আবহ।
সেই রাতে কোনো বিপদ ঘটেনি। সকালের সোনা রোদে সাহস ফিরে পেলাম। গরম গরম পিঠার সদ্ব্যবহার করলাম।
প্রতিবেদন তৈরি করার তাগাদা এসেছিল ভৈরবের রফিকুল ইসলাম ভাইয়ের কাছ থেকে। আমি যদিও রিপোর্টার ছিলাম না, তবুও রফিক ভাইয়ের সাথে ভৈরবে সামাজিক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসাবে প্রতিবেদনটি করেছিলাম। ভৈরবে এসে রফিক ভাইদের বাড়িতে অবস্থান করে খুব ভোরে উঠে বডিগার্ডসমেত ভৈরব জংশনে এসে চোরাকারবারীদের হাতেনাতে ধরলাম। তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করলাম। এসব মাল আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে ঢোকে, তারপর ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এসব নিয়ন্ত্রণ বা পর্যবেক্ষণ বা আইনগত ব্যবস্থা নেবার মতো কেউ নেই। ভৈরব চেম্বার অব কমার্স, ভৈরব থানা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-সবারই মত ও সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম।
আমার প্রতিবেদনটি “Bhairab: A Paradise of Smugglers” শিরোনামে দি নিউ নেশন পত্রিকায় প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল। সেই সময়টায় রফিক ভাই ভৈরবে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল স্থাপন করেছিলেন, যা ভৈরবের প্রথম কিন্ডারগার্টেন স্কুল। একটি মহিলা কলেজও তিনি ভৈরবে প্রতিষ্ঠা করেন।
একদিকে নরসিংদী জেলার রায়পুরা, সড়ক পথে পুরোনো ব্রহ্মপুত্রের ওপর নির্মিত ব্রিজ পেরুলেই উত্তরদিকের ওই পারে ভৈরববাজার। এই রায়পুরায় কোহিনূর জুটমিলসে বহুবার এসেছি। ভৈরব থেকেও নদী পার হয়ে সেখানে যাওয়া যায়। স্থানটার নাম গৌরিপুর। প্রয়াত অখিল মামা কোহিনূর জুটমিলে চাকরি করতেন। তিনি আমার এক দূরসম্পর্কীয় মামা। তার সাথে বহুবার জুটমিলে বেড়িয়েছি। ভৈরব থেকে চলে যেতাম আশুগঞ্জ সার কারখানায়। চলে যেতাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। কখনো আলমকে সাথে নিয়ে, কখনো বা স্থানীয় বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে। ভৈরব ব্রিজের পাথুরে গোড়ায় বসে গভীররাত অবধি নদীর বুকে বৈদ্যুতিক বাতির আলোকসজ্জা দেখেছি। ঘুরে বেড়িয়েছি আমাদের জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। গিয়েছি জঙ্গলবাড়িতে। সাম্প্রতিক কালেও আমি জঙ্গলবাড়ি ভ্রমণ করেছি। পরের এপিসোধে সেই কাহিনি আমি আপনাদের শোনাবো।
আজ একটুকুই। বালুকা বেলায় হাঁটতে হাঁটতে আবার গল্প করা যাবে।