হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

বানর পুরাণ: টিকাটুলি ও রাম কৃষ্ণ মিশন রোড

বানর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলার অবকাশ বোধ করি নেই; সেটি আমার উদ্দেশ্যও নয়। আমি এখানে বানরের কিছু বানরামি মানে বাঁদরামির কর্মকাণ্ড বর্ণনা করব। সেসব বানানো গল্প বা অতিরঞ্জিত নয় বলেই জানি। একদম বাস্তব জীবন থেকে নেয়া; অথচ গল্পের মতো। বাংলাদেশের বানর এবং তাদের খেলা, মানে বানরের খেলা ছোটোকাল থেকেই পথেঘাটে দেখে এসেছি। কিন্তু এরা যে বহুবিচিত্র খেল জানে এবং মানুষকেও খেলাতে জানে, তেমন কয়েকটি বাস্তব ঘটনা বলব। আমি নিজে যেমন বানরকে জ্বালিয়েছি, বানরও তেমনি আমাকে নাজেহাল করেছে। বাংলাদেশে কয়েক প্রজাতির বানর আছে। এরমধ্যে রেসাস মাঙ্কি ও কমন ল্যাঙ্গার বা হনুমান উল্লেখযোগ্য।

একটা সময় পুরোনো ঢাকা ছিল বানরের শহর। এখন তা কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। আমি ঢাকা শহরের আনাচেকানাচে বহুবার বহু দলছুট বানর দেখেছি। সর্বশেষ একটা গোদা বানর দেখেছিলাম গোপিবাগে আমাদের বাসায়। বঙ্গভবনের ভেতরে এখনও কিছুসংখ্যক বানর অস্তিত্বমান বলেই জানি। এছাড়া নারিন্দা, টিপু সুলতান রোডেও সাম্প্রতিক সময়ে বানরদের বিচরণ করতে দেখেছি।

বানরের বাঁদরামির প্রথম উদাহরণটি দিব চৌধুরি সাহেবের আক্রান্ত হবার বিবরণ দিয়ে। আব্বার কাছে শুনেছি, তিনি সেই চৌধুরি সাহেব যিনি আব্বাকে বলেছিলেন একবার নাকি এক পশ্চিমা চৌধুরি সাহেবের বেশভূষা দেখে আর তার পত্রিকার সম্পাদক হবার ‘প্রবল যোগ্যতা’ দেখে বলেছিলÑ‘এক দেখা ইসকান্দার মির্জা কো, দোসরা দেখা চোদ্রি সাহেব কো।’

একবার চৌধুরি সাহেব তার তাঁতিবাজারের বাসা-কাম-অফিসের পুরোনো ইমারতের ছাদে চেয়ার টেবিল পেতে কবিতা রচনায় মগ্ন ছিলেন। আব্বা অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিউজ ও রিপোর্ট বানান আর চৌধুরি সাহেব পাশে বসে বক-বক করে কাজের ক্ষতি করেন ও আব্বার মনোযোগ নষ্ট করেন। আব্বা চৌধুরি সাহেবকে ছাদে গিয়ে বসে কবিতা লিখতে বললেন। চৌধুরিসাহেব তা-ই করলেন। নিচে আব্বা যথারীতি ‘বাংলাদেশ টুডে’র জন্য নিউজ তৈরি করতে লাগলেন। উল্লেখ্য যে, আব্বা চৌধুরি সাহেবের বাংলাদেশ টুডে পত্রিকায় পার্টটাইম কাজ করতেন মানে, পুরো পত্রিকাই আব্বা বের করে দিতেন। চৌধুরি সাহেব নিজের নামের আগে এডিটর শব্দটা ব্যবহার করতেন। ছাদে যাবার পরের ঘটনা হলো: চৌধুরি সাহেব কবিতা বানাচ্ছিলেন আর সৃষ্টিসুখে মাঝেমধ্যে বিচিত্রসব শব্দ করছিলেন। এই শব্দ তার পেছনে রেলিংয়ে বসে থাকা কতিপয় বানরের পছন্দ হচ্ছিল না। তারাও বিচিত্রসব শব্দ সৃষ্টি করছিল। তাদের চেঁচামেচি আবার চৌধুরি সাহেবের পছন্দ হচ্ছিল না। তার ‘কবিতা’ তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটছিল। তিনি বানরদের ভেংচি কাটলেন। বানরেরাও পাল্টা ভেংচি দিল। এবার চৌধুরি সাহেব তেড়ে গেলেন বানরদের দিকে। ব্যস, চারটা বানর একযোগে আক্রমণ করল তাকে। চৌধুরি সাহেব চেঁচাচ্ছিলেন। দোতলা থেকে তার স্ত্রী সে চিৎকার শুনতে পেলেন। কিন্তু তিনি গা করলেন না। তিনি ব্যস্ত ছিলেন ঠোঁটে লিপস্টিক মাখতে ও গালে পাফ বুলাতে। উদ্ধার করতে এলেন আব্বা। সাথে ছিল চৌধুরি সাহেবের অ্যাসিস্ট্যান্ট। আব্বা এসে দেখলেন বানরেরা চৌধুরি সাহেবকে শুইয়ে দিয়েছে। এদিকে চৌধুরি সাহেবের দল ভারী হয়ে গেছে দেখে বানরেরা চম্পট দিল।

আব্বা বললেন, ‘চোদ্রী ভাই ডাক্তারের কাছে যান, নাইলে বান্দর-রোগে আক্রান্ত হবেন।’ বলাই বাহুল্য, পরের ক’টি দিন চৌধুরি সাহেবের হাতে ও কপালে ডাক্তারি পট্টি বাঁধা ছিল।
আমরা বলতে গেলে সারাজীবনই ভাড়া বাসায় ছিলাম। আব্বা মূল চাকরি করতেন বড় পত্রিকায়। বড় সংসার চালাতে তিনি প্রবন্ধ লিখতেন আর পার্টাটাইম চাকরি করতেন। ফলে আব্বার আর্থিক অবস্থার প্যারামিটার যাচাই করে কম দামি, মাঝারি দামি বা বেশ দামি বাসায় বিভিন্ন এলাকায় আমাদের বাসা বদলের পালা চলত।

তখন কম দামি বাসার পালা। মগবাজারের নয়াটোলায় আমাদের পাড়ায় কোত্থেকে যেন এক বানর এলো। আমরা পোলাপানেরা তাড়া করলাম বান্দরকে। বান্দরের পালাবার বহু জায়গা ছিল। কিন্তু আমাদের পোলাপানের সংখ্যা অতিরিক্ত বেশি ছিল। বান্দর যেখানে যায়, সেখানেই একটা না একটা পোলা দাঁড়ানো। পোলাপানের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। আর বানরটাও দৌঁড়ে, লম্ফঝম্ফ করে ক্রমেই কাহিল হয়ে পড়ছিল। শেষ পর্যন্ত সে পানির ট্যাংকের ওপর আশ্রয় নিল। মুসা নামের বানরের চেয়েও বদের হাড্ডি এক পোলা উঠে গেল পানির ট্যাংকে। তারপর আমরা বানরটাকে কব্জা করে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাড়া ঘুরছিলাম। একসময় বানরটা মাটিতে শুয়ে পড়ে নিস্তেজ হয়ে গেল। আমরা দড়ি ছেড়ে দিলাম। এমনকি গলার বাঁধনটাও খুলে দিলাম। হঠাৎ বানরটা লাফিয়ে উঠে এক দৌড়ে বুলেটের মতো ছুটে পালিয়ে গেল! আমরা আর ধরতে পারিনি তাকে।

গোপিবাগে আমাদের বাসার পেয়ারা গাছে একদিন একটা বানর দেখলাম। বেশ দশাসই শরীর ও চেহারা। সেটার দিকে একটা ঢিল মারলাম। ব্যস, বিকট খিচ-খিচ শব্দে সে তেড়ে নেমে এলো সবচে নিচু ডালটায়। আমি ততক্ষণে একটা তক্তা নিয়ে এলাম। কিন্তু বানরটা ভয় পেল না। সে লাফিয়ে মাটিতে পড়ল। বানরটা আকারে বেশ বড় ছিল; মাটিতে ভারী শব্দ হলো। আমি সাহস হারিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। বানরের সাথে বাঁদরামি না করাই ভালো।

এবার বলব টিকাটুলির বানরের গল্প। পঞ্চাশের দশকের শেষের ঘটনা। ভাইজান ও বড়পা তখন খুবই ছোটো। রামকৃষ্ণ মিশন রোডে আমরা থাকতাম। পাশাপাশি থাকতেন আমাদের বড় মামা তার সংসার নিয়ে।

ভাইজান ও বড়পা আইসক্রিম, বিস্কিট বা কোনো খাবার কখনও শান্তিতে খেতে পারত না। বানরেরা কেড়ে নিত। একবার আম্মা এক হাঁড়ি পোলাও ও এক হাঁড়ি মাংস রান্না করে কেবল বারান্দায় রেখেছেন, অমনি বানরের দল কোত্থেকে ছুটে এসে পোলাও-মাংস সাবড়ে দিল। যতটুকু খেল, তারচেয়েও বেশি নষ্ট করে ছড়িয়েছিটিয়ে ফেলে দিল। এই দলটাই একবার আমাদের কাচের বিশাল জানালার তাকে বসে গল্প করছিল। তাদের লেজগুলো ছিল ঘরের ভেতরের দিকে ঝুলানো। আম্মা ভেতর থেকে জানালা বন্ধ করে দিতেই শুরু হলো নরক গুলজার। আটকা পড়ে ও ব্যথায় বানরের রাম-চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। আম্মা জানালা খুলে দিতে ভয় পাচ্ছিলেন। এসময় এগিয়ে এলো আমার চাচাতো ভাই সাদ উল্লাহ দাদা। তিনি জানালা খুলে দিলেন।

যেই সময়টার কথা বলছি, সেইসময় এখন যেখানে ওয়াপদা ভবন, সেই জায়গাটা ছিল গভীর জঙ্গল। এসব আমার দেখা নয়; আমি এ ধরায় আবির্ভূত হয়েছিলাম অনেকবছর পরে। আব্বা-আম্মার কাছে শুনেছি। সন্ধ্যায় শেয়ালের ডাক ভেসে আসত। আশেপাশে বহু জায়গা ছিল জংলা, জলাভূমি ও ফাঁকা জায়গা।

বর্তমানে ডানদিকে ইনকিলাব ভবন ও বামে হাইরাইজ বিল্ডিং রেখে চলে যাওয়া সরু রাস্তাটার সামান্য পরেই বামে আরো একটি সরু রাস্তা। তার শেষ বাড়িটা বড়মামার আর তার আগেই বামে যে সুউচ্চ ভবন, সেটা ছিল আমাদের বাসা (যদিও তখন আমি অস্তিত্বমান ছিলাম না; আমার আব্বা-আম্মা ও ভাইজান-বড়আপা ছিলেন বলেই ‘আমাদের বাসা’ বলছি)। সেই সত্তরের দশক থেকে মোটামুটি আশির দশক পর্যন্ত টিকাটুলি মোড় থেকে সরু রাস্তাটায় ঢুকতে বাম দিকে যেটা এখন বহুতল ভবন সেখানে পুরোনো এক ভবনের ওপর ছিল লালবাগ ক্যামিক্যাল্স-এর এক বিশাল বিলবোর্ড। তার পেছনেই ছিল একটা বাসা, যার নাম ছিল ‘পুতুল কুটির।’ এই পতুল কুটিরের নাম ছোটোবেলা থেকে আম্মার কাছে শুনে আসছি। এখন আর ঠিক মনে নেই পুতুল কুটির কেন এত বিখ্যাত ছিল; নামের জন্য নাকি অন্য কোনো কারণে।

বানর প্রসঙ্গ চলছিল। একবার এক গোদা বানর বড় মামির চিনিভর্তি বড় এক বৈয়াম নিয়ে গাছে উঠে খুব তরিবত সহযোগে চিনি ভক্ষণ করে চলল। বড়মামি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন- ‘বান্দর, আমার চিনির বৈয়ামটা ভাঙিস না।’ বান্দর বোধহয় মানুষের ভাষা বোঝে! সে খুব যত্নের সাথে গাছের তিনটি কাণ্ডের মাঝখানে কাচের বৈয়ামটা রেখে দিল। বড়মামি পরে কাজের লোক দিয়ে চিনির বৈয়াম গাছ থেকে নামিয়ে এনেছিলেন। আরেকবার আব্বা অপকর্মের কারণে এক গোদা বানরের পিঠে একবার এক ঘা বসিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। গোদা বানর সুযোগের অপেক্ষায় থাকত, সে দেয়ালে ওৎ পেতে বসে থাকত আব্বার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ে কামড়ে দিতে। সে অবশ্যি সেই সুযোগ আর পায়নি।

এখন ঢাকা শহরের আনাচেকানাচে বানর আর দেখা যায় না। আমাদের দেশে বানরের যে প্রজাতিটি বেশি দেখা যায় সেটার নাম Rhesus Macaque. বাংলায় একে লাল বান্দরও বলা হয়। বিশ্বের প্রাচীন বানর (Old World monkey) প্রজাতির মধ্যে এরা সবচেয়ে পরিচিত এবং বনজঙ্গল ছাড়াও লোকালয়েও এরা থাকে। এরা ধী-শক্তির অধিকারী এবং চতুর প্রাণী।