হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

কানাডায় আগমনের প্রথম দিকের কথা। টরোন্টোর দুর্বিনীত হাওয়ার ঝড়ো-ঝাপ্টায় কাহিল। একদিন সেভেন ক্রেসেন্ট প্ল্যাসের কোণায় হাওয়ার তোড়ে প্রায় শেকড় ছেঁড়া গাছের মতো উপড়ে পড়লাম।

রাতে বাসায় ফিরে বিছানায় কাত হয়েছিলাম। বেডরুমের জানালা কাঁপছিল হাওয়ার ঝাপ্টায়। অন্ধকার ঘরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে এই কম্পন ও কুঁ-কুঁ শব্দকে কীসের সাথে তুলনা করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। মনের ভেতরে অশুভ অনুভূতির বিস্রস্ত ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। অগত্যা কল্পজগতের আশ্রয় নিলাম। সহসা মনের কোণে উঁকি দিল ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের সেই জাগর উপত্যকার কথা। ব্রিটিশ ভারত আমলে জগদ্বিখ্যাত শিকারি ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের জাগর উপত্যকার কাহিনি কল্পজগতের কাহিনি নয়; বাস্তব অভিজ্ঞতা।
ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের কথা কেন মনে পড়ল, তা জানি না। বোধহয় টরোন্টোর আবহাওয়া দেখে। ক’দিন ধরে অদ্ভুত একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। এই দুরাসদ বাতাসের চূর্ণকুন্তলে অস্থিপঞ্জর জমাট বাঁধবার উপক্রম হয়। ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা। মাইনাস পাঁচের সময় আমার এবং আমার সাথের আর দু’টি প্রাণীর কী গতি হবে ঈশ্বর জানেন। জাগর উপত্যকার কথা বলছিলাম এজন্য যে, ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের বিখ্যাত বই ‘জঙ্গল’-এর ‘ঝড়ো উপত্যকার বিভীষিকা’ অধ্যায়ের এক কুঞ্চন-ভয়াল বাঘটি শিকারের সময় তিনি এক অদ্ভুত হাওয়া বয়ে যাবার কথা বলেছিলেন। সেই কনকনে বাতাসটি ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক ভোর তিনটায় শুরু হয়ে ঠিক ভোর পাঁচটায় থেমে যেত।

টরোন্টোর বাতাস অবশ্য টাইম ধরে চলে না। সে বয়েই চলে রাতদিন। বিষয়টি ঘটছে বিগত দুই সপ্তাহ ধরে। অক্টোবরের ১৫ তারিখ। আমরা এখানে এসে কানাডার পরিপূর্ণ গ্রীষ্মকাল উপভোগ করেছি।

তখনো গাছের মাথায়, প্রকৃতিজুড়ে বয়ে যেত হাওয়া। সেই শব্দে মনটা উদাস হয়ে যেত। বাংলাদেশের গন্ধ পেতাম তখন। প্রকৃতিকেও মনে হতো যেন বাংলাদেশি ছাঁচে তৈরি। মাঝখানটাতে আমকাঁঠাল পাকার মতো গরম পড়েছিল। কিছু কিছূ আগাছা আর লতার প্রজাতি বাংলাদেশের মতোই। সেসবের দিকে তাকালে মনে হতো বাংলাদেশেরই কোনো অঞ্চলে বেড়াতে এসেছি। এক ধরনের বড় গাছ আছে দেখতে আমগাছের মতো। কল্পনা করতাম এগুলো আমগাছ, আর এর শরীর-মাথাজুড়ে যে বাতাস বয়ে যাচ্ছে তা বৈশাখী হাওয়া!

অলিন্দে দাঁড়াবার উপায় নেই। কামড়ে ধরে বাতাস। হি-হি করে কাঁপতে থাকি। একটু গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে অলিন্দে এসে দাঁড়ালে আকাশে মেঘের ঘনঘটা আর প্রকৃতিতে বাতাসের ঝাপটায় আপনি বুঝে উঠতে পারবেন না এ কেমনতরো আবহাওয়া। আকাশে মেঘ দেখে আপনার মনে ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’ ভাবটি মোটেও জাগবে না। আপনি তখন ব্যস্ত হি-হি কাঁপুনিতে। ভাববার অবসর কোথায়!

মজার বিষয় হলো, ঘরের ভেতরে বসে স্লাইডিং দরজার ভেতর থেকে বাইরের হাওয়ার দাপাদাপি দেখতে আপনার ভালোই লাগবে। হলুদ আর লাল বর্ণের পাতার ওপর দিয়ে রাক্ষুসে হাওয়া বয়ে চলেছে, সে তো বেশ উপভোগ্য দৃশ্য। এই হলুদ আর লাল পাতাগুলো আদতে হলুদ আর লাল নয়। মাত্র কয়েকদিন আগেও তারা গাঢ় সবুজ ছিল। শীতের আগমনী বার্তা তারা আগেই পেয়ে গেছে। তাই শীতের প্রস্তুতি হিসেবে রং বদল করে সবশেষে পাতা ঝরিয়ে ন্যাড়া হয়ে তবে শীতের ঘুম দেয়।

এরকম এক হাওয়ার দিনেই আমি আর আমার স্ত্রী ড্যানফোর্থে গেলাম সোফা আর ডাইনিংটেবল দেখতে। অনেকদিনই গিয়েছি, পছন্দ হয়নি বা দামে বনেনি। লিয়ন’স এখানকার নামকরা ফার্নিচার বিক্রেতা। তাদের আসবাব উন্নতমানের এবং হরেক রকম ডিজাইনের আইটেম রাখে তারা। ফ্রি ডেলিভারি। জিনিসগুলি যেমন মনমাতানো, দামটাও তেমন মন উতলাকারী। পছন্দের এবং মোটামুটি টেকসই ও মানানসই একটি সোফা কিনতে গেলে অন্তত তেরো-চোদ্দশ’ ক্যানেডীয় ডলার গুনতেই হবে। এর আবার সাইড ইফেক্ট আছে, মানে সাইড টেবল বা সেন্টার টেবল কিনতে হলে ফের সাড়ে তিনশ’ বা সাড়ে চারশ’ ডলার নেই হয়ে যাবে। লিয়ন’স-এ দুইতিনবার গিয়েছি। বিশাল ও বিলাসী শোরুম। জাঁকজমকপূর্ণ। কিন্তু মুশকিল হলো আমাদের বাজেট তো জাঁকালো নয়। আমি আর আমার স্ত্রী বৃষ্টিতে ভিজে, ঠান্ডায় কেঁপে দোকানের পর দোকান ঘুরতে লাগলাম। এসব দোকানগুলি আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে হাঁটাপথের দূরত্ব। তাই ততটা উদ্বিগ্ন ছিলাম না। দোকানের আড়ালে আড়ালে বৃষ্টি থেকে গা বাঁচিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দোকান বলছি, আসলে এগুলো একেকটি স্টেডিয়ামের মতো বিশাল। রোডের সমান্তরালে আর বেজমেন্টে বিশাল জায়গায় থরে থরে সাজানো আসবাবপত্র। লিয়ন’স-এর কোণায় কোণায় ফার্ণিচার দিয়ে বেডরুম, ডাইনিংরুম, প্যাটিও (স্প্যানীয় বা অ্যামেরিকানদের বাড়িসংলগ্ন উঠোনের মতো বাঁধানো স্থান) মডেল তৈরি করা হয়েছে। চোখ ধাঁধানো আর নস্টালজায় মেশানো। শেষে ড্যানফোর্থ ফার্র্নিচারে গিয়ে ঠেকলাম। এই দোকানে এসে মনের মতো জিনিস পেয়ে গেলাম। ডাইনিংটেবল আর সোফা পছন্দ হলো। অ্যাডভান্স করে ফেললাম পাঁচশ’ ডলার। ডেলিভারি নেব ৩১ অক্টোবর।
আমরা বাসাবদল করতে যাচ্ছি ১ নভেম্বর বা তার দুয়েকদিন আগে।

দুই বেডরুমের। বাসাটা আমাদের বর্তমান বিল্ডিংয়েই। শুধু অ্যাপার্টমেন্ট বদল। মনের মতো করে বাসা সাজানোর একটা সুপ্ত বাসনা অনেকদিন থেকেই পুষে আসছিলাম। কিন্তু কথা হলো এইযাত্রায় আমাদের প্রায় তিন হাজার ডলার দিতে হচ্ছে। আমাদের আগের দেখা ফার্নিচারের চাইতেও বাজেট বেশি। পার্থক্যটা হলো, আমরা আমাদের অভিলাষ আর পছন্দটাকেই প্রাধান্য দিলাম। সোফা আর ডাইনিং এত গর্জিয়াস আর মনমাতানো যে আমরা দু’জন সামলাতে পারিনি নিজেদের। তাই কিনে ফেললাম এই দুইখানা ফার্র্নিচার। জীবনে এত দাম দিয়ে আসবাব কিনিনি। কী আর হবে অর্থের মায়া করে, জীবনটা তো এক জনমেরই। আমরা ছয় চেয়ারের সুন্দর ডাইনিংটেবল কিনতে পারতাম ৬৫০ থেকে ৮৫০ ডলারে। মোটামুটি ৯০০ থেকে ১০০০ ডলারে কিনতে পারতাম সোফা। সেগুলো আমাদের তিনটি প্রাণী, অর্থাৎ আমি. স্ত্রী ও ছেলের সংসারে নিতান্ত বেমানান হতো না। কিন্তু পছন্দের তো মা-বাপ নেই। পছন্দ হলো একজাতের প্রলুদ্ধকারী লিপ্সা। এক ধরনের মায়াবী হাতছানি। এরচেয়ে অনেক দাম দিয়ে কানাডীয়রা বা বিত্তশালী মানুষেরা ফার্র্নিচার, তথা বিবিধ দৈনন্দিন উপকরণাদি কিনে থাকে। তা আমরা না হয় তিনহাজার ডলার খরচ করেই ফেললাম। আগের দিন (১৪ অক্টোবর) আমার সেই পুরোনো খেয়ালটা জেগে উঠল। বইয়ের দোকান থেকে গোটা পাঁচেক বই কিনে ফেললাম। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য: পোস্টমডার্নিস্ট লেখক কুর্ট ভনিগাটের গালাপাগোস ও গার্সিয়া মার্কেজের ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড। গার্সিয়ার বইটি ঢাকায় আমার সংগ্রহে আছে। তবু কিনলাম দ্বিতীয়বার পড়ার জন্য এবং এখানে সংগ্রহের জন্য। কারণ বইটি আমার খুব প্রিয়।

যাইহোক, বৃষ্টিমাথায় ফিরে এলাম বাসায় তৃপ্তমনে। আমাদের সোফা আর ডাইনিংটেবিলের অভাব ঘুচল। আমার বিশ্বাস, সেভেন ক্রেসেন্ট প্লেসে যতটা দৃষ্টিনন্দন ও আনকমন আসবাব আছে, আমাদেরটা তারমধ্যে অন্যতম। অনেকেরই এখানে গাড়ি আছে নিজের। নিজস্ব গাড়ি থাকাটাই শ্রেয়। গাড়ি থাকে, কারণ গাড়িটা একটা প্রয়োজনীয় বস্তু এখানে। গাড়ির কথাটা বললাম এজন্য যে, অনেকের গাড়ি থাকলেও বাসার কিন্তু খুবই দৈন্যদশা থাকে। একটা বিপরীত চিত্র। বাংলাদেশে যার একটা গাড়ি থাকবে, তার বাসার অবস্থা, মানে দামি বাসা আর দামি আসবাব ও উপকরণ থাকবে?এরকমটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এখানের চিত্র ভিন্ন, গাড়ি কেনা হয় সময় বাঁচাতে আর বৈরি আবহাওয়া এড়াতে। যাদের গাড়ি আছে, তারা প্রচণ্ড বরফে গাড়ির ভেতরে হিটে বসে কর্মস্থলে যায়, শপিংয়ে যায়, বেড়াতে যায়, বাসায় ফিরে আসে। যারা বহুদিন ধরে এখানে আছে, রোজগার করছে কেবল তাদের গাড়ি-বাড়ি-আসবাবের মধ্যে একটা সুন্দর সামঞ্জস্য রচিত হয়। কবিতা রচিত হয় ছন্দে-ভাবে-চয়নে।
সেরকম একটি কবিতা রচনা করার স্বপ্ন দেখে চলছিলাম।