হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
অল্পবয়সী, বিশেষত টিনএজ ছেলেমেয়েদের (১৩ থেকে ১৯ বছর) মধ্যে বিষণœতা বা বিষাদ ভাবকে ‘খারাপ মুড’ বা ‘বিশেষ কোনো কারণে বিষণ্নতা’ বলে সবসময় উড়িয়ে দেয়া যায় না। বরং কেন এই বিষন্নতা বা খারাপ মুড তা তলিয়ে দেখা উচিত পিতামাতা বা শিক্ষকদের। উঠতি বয়সীদের মধ্যে ডিপ্রেশন বাড়ছে, নাকি এব্যাপারে সচেতনতা বাড়ছে- তার চেয়েও বড় কথা- যতটুকু ধারণা করা হচ্ছে, তার চেয়েও দ্রুত হারে বাড়ছে টিনএজ ডিপ্রেশন।
বিশ্বব্যাপী টিনএজ কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেড়ে চলেছে ডিপ্রেশন। এইসব ডিপ্রেশনের বলি টিনএজার ছেলেমেয়েরা নিজেদের জন্য তো বটেই, অন্যদের জন্যও বিপদ ডেকে আনে। সম্প্রতি Step Up to Academic Reading by Marina Rozenberg, Oxford University Press, Canada 2012-এ ‘Depression in Young People’ নিবন্ধটা পড়লাম।
তার আলোকেই আমার এই নিবন্ধের সূত্রপাত। নাতিদীর্ঘ এই রচনায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে কেন টিনঅ্যাজার ছেলেমেয়েরা ডিপ্রেশনের শিকার হয়, এসব ক্ষেত্রে করণীয় কী এবং কীভাবে এর বৃদ্ধি রোধ করা যায়।
ডিপ্রেশন কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিত্বে ও চালচলনে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাদের মধ্যে ক্রোধ ও হতাশা দেখা দিতে পারে। এরকম ডিপ্রেশন অলক্ষ্যে চলতে থাকলে বা আমলে না আনলে তা গৃহে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংঘাত, ড্রাগ আসক্তি, হীনমন্যতাসহ সমাজে নানা ধরনের অশান্তি-অস্থিতিশীলতা বয়ে আনতে পারে। বিষণœতায় আক্রান্ত টিনএজ ছেলেমেয়েরা নানা প্রকার ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, যেমন- বেপরোয়া ড্রাইভিং, সীমাহীন মদ্যপান এবং অ-নিরাপদ যৌন কর্মকান্ডে জড়িয়ে যেতে পারে। সবচাইতে ভয়াবহ দিক হলো- ডিপ্রেশন আক্রান্ত অনেক টিনএজ বালক বা কিশোর অত্যুগ্র হয়ে উঠতে পারে। বিশেষত বুলিয়িং-এর শিকার কোনো কিশোর ভয়াবহ মানসিক অবস্থার শিকার হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। এপ্রসঙ্গে ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় টেক হত্যাকাণ্ড স্মর্তব্য। সেই বছর ১৬ এপ্রিল ভার্জিনিয়া পলিটেকনিক ও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইতিহাসের এক করুণ রসসিক্ত অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী দক্ষিণ কোরীয় নাগরিক চো সাং-হুই সেদিন ক্যাম্পাসের পৃথক দুই ভবনে ৩২ জনকে গুলি করে হত্যা করার পর নিজেও গুলিতে আত্মহত্যা করে। চো ছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র।
নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে- হাইস্কুল পর্যায়ে প্রায় ২০ শতাংশ টিনএজার সাবালকত্ব অর্জনের আগে পর্যন্ত কমবেশি ডিপ্রেশনের শিকার হয়। নিবন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিশিগ্যানের ডিপ্রেশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক জন গ্রেডেন, এমডি’র উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে- “Depression is a huge problem in the college student population too.” জন গ্রেডেন আরো বলেন, “The age of onset for depressive illnesses tends to peak during the ages of 15 to 19. That’s when it starts to appear, and the estimates are that probably 15 percent of the college student population may be struggling with depressive illnesses.”
লিঙ্গ, সামাজিক প্রেক্ষাপট, আর্থিক অবস্থা, শিক্ষা, বর্ণ কিংবা অন্যান্য প্রেক্ষিতে- যে কোনো মানদণ্ডেই কোনো টিনএজার ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে। তবে ডিপ্রেশনে নিপতিত ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে আচরণগত কিছু পার্থক্য লক্ষ করা যায়। টিনএজ মেয়েরা টিনএজ ছেলেদের চাইতে তাদের ডিপ্রেশনের অভিজ্ঞতার কথা বেশি বলে। টিনএজ ছেলেরা তাদের অভিজ্ঞতার কথা কম বলে। এর একটি কারণ সম্ভবত সমাজ কাঠামোতে ছেলে ও মেয়েদের কাছ থেকে প্রত্যাশার ভিন্নতা। মেয়েদেরকে তাদের মনের অবস্থা প্রকাশ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়; ছেলেদের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। টিনএজ মেয়েদেরকে পারিবারিক বন্ধনে জড়িয়ে থাকতে হয় আর অন্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়।
কিন্তু কেন এই ডিপ্রেশন? বয়ঃসন্ধি ক্ষণ থেকে এবং কয়েকটি প্রশ্ন থেকে, যেমন- তারা কে আর কোথায়ই বা তারা খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তারা বিভ্রান্ত হয়, ডিপ্রেশনের শিকার হয়। ডিপ্রেশনের আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। যেমন, কোনো ঘনিষ্ঠজনের মৃত্যুতে প্রতিক্রিয়া, বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদ, ছেলে ও মেয়ের বন্ধুত্বে ফাটল, পরীক্ষায় ফেল করা বা স্কুলে মানিয়ে নিতে না পারা। আমি দুয়েকটি ছেলেমেয়েকে দেখেছি, যারা টিনএজ বয়সে কানাডায় এসেছে কিন্তু দেশে তাদের স্বজন বা বন্ধুবান্ধবদের ভুলে থাকতে পারছে না। তারা কমবেশি বিষন্নতায় ভুগছে। এমন এক কিশোরী বাংলাদেশে ফিরে গেছে বাপ-মা সমেত, এমনটিও ঘটেছে। তবে এটি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ, বিশেষত বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে। অনেকেই হতাশায় ভোগেন। সেটা পরিণত হয় এক ধরনের বিষণœতায়। আবার সময়ের সাথে সাথে সেটা ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু টিনএজ ছেলেমেয়েদের যে বিষণœতার কথা এখানে বলছি, তা শেকড় ছেড়ে এসে বিষন্নতায় ভোগার বিষয় নয়; এই বিষন্নতা অনেকটা বৈশ্বিক। পৃথিবীর সবস্থানেই তা ঘটে। এটি তীব্র রূপ ধারণ করতে পারে যদি অভিভাবক সময়মতো লক্ষ্য বা হস্তক্ষেপ না করেন। কিংবা স্কুলে শিক্ষক যদি ডিপ্রেশনের শিকার হওয়া ছেলে বা মেয়েকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হন।
যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে আসতে পারে, সেগুলো হলো- কোন্ বিপজ্জনক কাজগুলো ডিপ্রেশনের শিকার হওয়া টিনএজারদের বিপদই শুধু ডেকে আনে না; সেগুলো অন্যকেও বিপদে ফেলে? উত্তর হলো ড্রাগ আসক্তি ও অধিক পরিমাণ অ্যালকোহল গ্রহণ। এই কাজগুলো এদেরকে তাড়িত করে বেপরোয়া গাড়ি চালনায়, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিতে, উগ্রতা ও আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়ায়।
সময়মতো প্রফেশনাল হেল্প মানে মনোচিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া বা থেরাপিউটিক চিকিৎসা বিষন্নতার শিকার হওয়া কিশোর-কিশোরীকে নরক থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে। আবার অভিভাবকের সময়োপযোগী নির্দেশনায় বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ, যেমন শারীরিক এক্সারসাইজ, ডেইলি রুটিন অনুসরণ এমনকি ডগ ওয়াকিং-এর মাধমে ডিপ্রেশন কাটানো যায়। বিশেষ ক্ষেত্রে মেডিকেশন বা ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমেও ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলোকে দমিয়ে রাখা যায়। তবে নিয়মিত অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট (ডিপ্রেশন নিরাময়ের ওষুধ) প্রয়োগ করা উচিত নয়; সেসবের সাইড ইফেক্ট রয়েছে। সেজন্য সবচেয়ে ভালো ও কার্যকরী অপশন হলো অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে স্ট্রেস ও উদ্বিগ্নতা কমিয়ে ছেলেমেয়েদের নানা কাজেকর্মে ব্যস্ত রেখে ডিপ্রেশন কমিয়ে আনা।