হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
আসুন না আজ একটু হোর্হে লুইস বোরহেস বা গার্সিয়া মার্কেসের জাদুবাস্তবতার জগৎ থেকে ঘুরে আসি।
ক’দিন আগের এক এপিসোডে আমার স্মৃতির নয়াপল্টন সম্পর্কে লিখেছিলাম। সেখান থেকেই শুরু করছি। সত্তর দশকের শেষের দিকের কথা।
জোনাকি সিনেমা হল সংলগ্ন যে পুকুরটি ছিল সেটি বিরাট পুকুর। পুকুরটাকে ঘিরে ছিল বেশ ক’টি আমগাছ। একটা আমগাছ ছিল বিশাল। পুকুরপাড়ে ছিল দুয়েকটি কুঁড়েঘর, সেখানে কয়েকটি দরিদ্র পরিবার থাকত।
আমরা নয়াপল্টনের বাসায় যে বছর এলাম তার পরপরই এসে গেল কোরবানির ঈদ। সেই ঈদে আমাদের কয়েকটি প্রতিবেশী পরিবারের মধ্যে ভাগে কোরবানি দেয়ার সিদ্ধান্ত হলো। এদের মধ্যে মঞ্জু ভাইদের (অন্য এক টেনিদা. আমরা ছিলাম তার চ্যালা) পরিবার আর আমাদের বাড়িওয়ালা অন্যতম। একদিন সন্ধ্যায় এসে গেল দুইটি জোয়ান তরতাজা ষাঁড়। একটি কালো, একটি সাদা (পুরোপুরি সাদা নয়, একটু ময়লা সাদা)। রতন ভাই (টেনিদার বড়’র বড় ভাই) আমাকে প্রায় কোলে তুলে ষাঁড় দুটির সামনে এনে জিজ্ঞেস করল কোন্টি আমার পছন্দ। আমি সাদাটা দেখালাম। অতএব সাদাটা আমাদের তিন পরিবার-আমাদের, বাড়িওয়ালা আর টেনিদা’র পরিবারের জন্য নির্দিষ্ট হলো।
পাশাপাশি দ্ইুটি গাছের মাঝখানে ষাঁড় দুইদিকে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। রতন ভাই ষাঁড়ের তদারক করছিল। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। হঠাৎ সাদা গোরুটা দড়ি ছিঁড়ে দৌড় দিল। রতন ভাই চিৎকার করে গোরুর পেছনে দৌড় লাগাল। আমিও কিছুটা দৌড়ে গেছিলাম। কিন্তু তাল রাখতে না পেরে ফিরে এলাম। পরে শুনলাম গোরুটা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে গিয়ে নেমে পড়েছিল জোনাকির পুকুরটায়। তারপর সাঁতরে ওপারে উঠে একটা কুঁড়েঘরে ঢুকে গেল। ভাগ্যিস কুঁড়েঘরে তখন কেউ ছিল না। গোরুটা হয়তো ঘরের বাসিন্দাকে গুঁতিয়ে দিত, বা পায়ের তলায় পিষে মেরে ফেলতে পারত। রতন ভাই এবং আরও কয়েকজন মিলে অবশেষে ষাঁড়টাকে বাগে আনতে পারল।
পুকুরটায় আমি দিনের পর দিন ডুবাতে ডুবাতে একসময় শিখে ফেললাম সাঁতার। আমি সাঁতার কাটতে জানিÑএই চিন্তাটা আমাকে বরাবরই পুলকিত করে। নানার বাড়িতে বেড়াতে গেলে বর্ষার সময় বিলে নেমে চিৎ হয়ে টানা ভাসতে থাকি, ওপরে অবারিত আকাশ দেখি আর গুনগুন করে গান গাইতে থাকি।
তো জোনাকির সেই পুকুরটায় একদিন সাঁতার কাটছিলাম আপনমনে। পাড়ের কাছেই ছিলাম। খানিকটা দূরে বস্তির কয়েকটা ছেলে সাঁতরাচ্ছিল। তারা আমাকে ভেংচি কাটছিল। আমি আপনমনে সাঁতরাচ্ছিলাম। ওদের সাথে কোনোরকম ঝগড়াফ্যাসাদে গেলাম না। কিন্তু এ কী! কী একটা যেন পানির নিচে আমার পা চেপে ধরেছে। আমি গলা সমান পানিতে ছিলাম। হঠাৎ বুঝে ফেললাম ব্যাপারটা। সেই ছেলেদের একজন ডুব সাঁতার দিয়ে আমার পা চেপে ধরেছে। আমি পা ছাড়িয়ে নিতে গেলে ছেলেটা আমার পা ধরে টান দিল। আমি পায়ের নিচের পিচ্ছিল মাটিতে হড়কে গিয়ে পুুকুরের অনেকটা গভীরে চলে গেলাম। সেখান থেকে সাঁতরে পাড়ের কাছে চলে এলাম। এইসময় আবার ওরা এলো। দুইজন ডুব সাঁতার দিয়ে বারবার আমার পা চেপে ধরছে। আরও দুইতিনজন চেপে ধরে আমাকে পানির ভেতরে ডুবিয়ে দিচ্ছে। দুই তিনটাকে আমি চিমটি কাটলাম। কিন্তু ওরা গা করছে না। একসময় অনুভব করলাম, আমি পানির ওপরে মাথাই তুলতে পারছি না। একবার কোনোক্রমে মাথা তুলি তো আবার পায়ের টানে নিচে চলে যাই। এরপর আমি আর উঠতে পারছিলাম না। পানি খেয়ে ফেললাম অনেকটা। তারপর মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। একবার অন্ধকার দেখলাম। এই অবস্থায় আরও কিছুক্ষণ ছিলাম, আগাতে চেষ্টা করছিলাম পাড়ের দিকে। বোধহয় কিছুটা এগিয়েও গিয়েছিলাম। এইসময় হাতে লাগল জিনিসটাÑআমগাছের শেকড়। সেটা শক্ত করে ধরে বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলাম। ততক্ষণে আমার পা শুধু একজন ধরে ছিল। সাপোর্ট পাওয়াতে আমি হ্যাঁচকা টানে আমার পা ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর শেকড় ধরে ওপরে উঠে গেলাম। ওরা বুঝতেই পারেনি কী হলো-পানিতে তারা খুঁজছিল আমাকে।
পাড়ে উঠে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে একটা ইটের টুকরো হাতে নিয়ে একজনকে টার্গেট করে মেরে দিলাম। সেটা একটা ছেলের কপালে আঘাত হানল। সে চিৎকার করে উঠল। আরও কয়েকটা ঢিল ছুঁড়লাম। লাগল কি লাগল না জানি না। তারপর আর সময় ব্যয় করলাম না। ওরা ওপরে উঠে এলে সমস্যা হবে। তাই দ্রুত বাসায় চলে এলাম। ঘটনাটি বাসায় কাউকে জানাইনি। কেন জানাইনি তা বলতে পারব না। আজও কেউ এই বিষয়টি জানে না।
আরেকবার, খুব ছোটোবেলায়, শান্তিবাগে থাকতাম। যেদিকে প্রান্তর-তেপান্তর, আমাদের একতলা দালান বাড়িটা সেদিকে পুরোটাই উঁচু প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। এই প্রান্তরই বর্ষায় পরিণত হতো বিলে। একদিন আমি প্রান্তরে দৌড়–চ্ছিলাম। কেন দৌড়–চ্ছিলাম তা জানি না। হঠাৎ একসময় অনুভব করলাম আমি যেন কীসের মধ্যে পড়ে গেছি। প্রচণ্ড ঠান্ডা সেটা। তারপর মনে হলো কে যেন উঠাল আমাকে। সেই কে-টা কে আমি বলতে পারব না। আবছা একটা কাঠামো।
আমি যেখানে পড়েছিলাম সেটা পানাভর্তি একটা লুকোনো গর্ত ছিল। ঝোপঝাড় আর কচুগাছের ভিড়ে মৃত্যুফাঁদ লুকিয়ে আছে সেটা বুঝার কোনো উপায় নেই।
আবছাভাবে অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। কোনো কোনো স্মৃতি বা স্বপ্ন, আমার ভেতরে একাকার হয়ে গেছে। তবে কতোগুলো স্মৃতি মনে দাগ কেটে আছে। সেসব যে বাস্তব, স্বপ্ন নয় তা নিশ্চিত হয়েছি পরবর্তীতে। সেই শান্তিবাগের বাসায় আমাদের আঙিনায় একটা হিজল গাছ ছিল। সেই গাছটাকে ভীষণ ভয় পেতাম, বিশেষ করে সন্ধ্যা ঘনাবার পর থেকে। সন্ধ্যার পর অবসর সময় আম্মা বলতেন গাছটায় নাকি শয়তান থাকে। শুনে ভয় পেতাম, আবার জানালার কাছে বসে নিমেষে তাকিয়েও থাকতাম ঝাঁকড়া গাছটার দিকে।
দেখতে পেতাম ভূতুড়ে সব শয়তানের অবয়ব, নানা আকারের শয়তান গাদাগাদি করে বসে আছে। বিচিত্র সব শব্দ করছে। হিজল গাছ, আম্মার বলা কথা আর আমার তাকিয়ে থাকাটা পরবর্তী সময়ে বড়পা বা আম্মাকে অনেক সময় জিজ্ঞেস করতাম। তাদের কাছে শুনে বুঝতাম ওরকম হিজল গাছ ছিল সেখানে, আর আমিও এভাবে তাকিয়ে থাকতাম। ভয় পেতাম, তারাও ভয় পেত। বিচিত্র শব্দগুলো আসত জলাভূমি থেকে আর অদূরের বস্তিবাসীদের কাছ থেকে।
আমার এই বিলে গতায়ত ঠেকাতে আম্মা আমাকে জলাভূমির অদ্ভুত কোনো জীবের কথা বলতেন। যার গলা ছিল লম্বা, জিহ্বা ছিল আরও লম্বা। যেমন প্রবাদ আছে যে, ক্যানেডার লেক অন্টারিওতে একসময় দানব ছিল। লক নেস দানব। তাদেরও গলা লম্বা ছিল।
মানুষের মুখের কথা, প্রবাদ বাক্য আর মানুষের কল্পনা থেকে অনেক কাহিনির জন্ম হয়। জলাভূমি, গভীর বন-জঙ্গল, সাগর-নদী-এসব রহস্যে ভরপুর। জীবজন্তু ছাড়াও বন-জঙ্গলে থাকে অশরীরী জীব, দানো, প্রেতযোনী, শয়তান আর জিন।
এসব বিশ্বাস থেকে অনেক কাহিনির জন্ম হয়। তেমনি এক প্রাণী ছিল শান্তিবাগের সেই জলাভূমিতে। সেই অতিকায় জীবটাকে আমি আবার নতুনভাবে আবিষ্কার করি বহু যুগ পরে ক্যানেডার টরোন্টোতে এসে।