হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
সামারে গোটা কানাডা নববধূর মতো সাজে। বছরের অধিকাংশ সময় নিরেট বরফে স্থবির হয়ে থেকে এপ্রিলের শেষদিকে প্রকৃতি নড়েচড়ে ওঠে। ন্যাড়া গাছের ডালে পাতা গজাতে শুরু করে। চঞ্চল হয়ে ওঠে কাঠবেড়ালির দল। গাছের শাখায় পাখিরা তীক্ষ্ম কলরবে মেতে ওঠে। স্কাঙ্ক ও র্যাকুন তৎপর হয়ে ওঠে (নিশাচর জন্তু)।
দুইপাশে মনকাড়া সৌন্দর্যের বাড়িঘর, দোকানপাটের মাঝখান দিয়ে অ্যাস্ফল্টের কালো রাস্তা রোদ্দুরে ঝিকিয়ে ওঠে। তার বুকের ওপর দিয়ে চলে অসংখ্য যানবাহন। চওড়া ফুটপাথজুড়ে কংক্রিটের স্কোয়্যার আকারের বিশাল টবে হরেক রকমের বহুবর্ণিল ফুল মন কেড়ে নেয়। গোটা টরোন্টো যেন এক বিশাল বনানী। আর সেগুলোর বৃক্ষ-তরুলতা বর্ণে আর সৌন্দর্যে অপূর্ব। বিশাল ফাঁকা জায়গা, স্থানে স্থানে পার্ক, গল্ফ কোর্স আর টেনিসকোর্টে গোটা টরোন্টোকে একটা বড় পার্ক বলা যেতে পারে। যে ক’টি আনন্দের ব্যাপার গ্রীষ্মে ঘটে তার একটি হলো আউটডোর ভ্রমণ। অনেক অপশন আপনার রয়েছে। বিচেস থেকে শুরু করে টরোন্টো আইল্যান্ডস, এমনকি কাছের স্ক্যারবরো বøাফ ট্রেইল দেখে আসা যেতে পারে। যারা হাঁটতে পছন্দ করেন তাদের জন্য বিশ্বের যে কোনো শহরের চেয়ে টরোন্টো সেরা। লেক অন্টারিও ধরে হাঁটতে থাকুন; কিংবা হারিয়ে যান ডন ভ্যালির রহস্যময় সবুজ অরণ্যে। অথবা কুইন স্ট্রিট পশ্চিম ধরে হাঁটা যেতে পারে মাইলের পর মাইল। যাঁরা ভিক্টোরিয়া পার্ক-ড্যানফোর্থে থাকেন, বিশেষত বাঙালিরা- তারা চলে আসুন বাংলাদেশি রেস্তরাঁয় জম্পেশ বাংলাদেশি খাবার খেতে ও আড্ডা দিতে।
এবারের সামারটা কি কুল সামার হবে? মাত্র সাড়ে তিনমাসের নিখাদ সামারটা কি উইন্টারের মতো বরফে ঢেকে যাবে? বিচিত্র কী? এদেশে ‘থ্রী ডব্লিউস’ বলে একটা প্রবচন আছে- ওয়েদার, উইম্যান আর ওয়র্ক। এই তিনটিরই নাকি ঠিক-ঠিকানা নেই। তো বছর তিনেক আগে কুল সামার সম্পর্কে টরোন্টো স্টারের একটা নিউজ পড়েছিলাম। অ্যাকিউওয়েদার.কম সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে, একটা ঠাণ্ডা আবহাওয়া প্যাটার্ন যা ক’বছর আগের বসন্তে বিরাজমান ছিল মধ্য ও পূর্ব কানাডায়, তা সামারজুড়ে থাকতে পারে। অন্যদিকে পশ্চিমাঞ্চলে বিরাজ করবে শুষ্কতর ও গরমতর একটা সামার। অ্যাকিউওয়েদার.কম সূত্রমতে মধ্য ও পূর্ব কানাডায় জেট স্ট্রিমের (বাতাসের গতিময় স্রোত) আর্দ্রতার কারণে জুন-জুলাই মাস জুড়ে বিশেষভাবে অন্টারিওতে কুল সামার থাকবে। জেট স্ট্রিমের প্যাটার্ন ছাড়াও গ্রেট লেকগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ বরফ জমার কারণে লেকগুলোর উষ্ণতা পেতে সময় লাগার বিষয়টিও এবারের ঠাণ্ডা সামারের একটা অন্যতম কারণ।
কোনো এক গ্রীষ্মে থমসন পার্কে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! বাংলাদেশের মতো গরম পড়েছিল। আমরা কয়েকটি পরিবার মিলে বারবিকিউ অভিযানে মেতে উঠলাম। কানাডিয় হ্যামলক ট্রি দেখে মনে পড়ল সক্রেটিসের কথা। ধোঁয়াটে সবুজ হ্যামলকের শাখা-পাতাগুলো গোল ব্রাশ চিরুনির মতো। গোল চিরুনির একেকটি দাঁড়ার মতো সরু পাতার প্রান্তভাগ বেশ তীক্ষ্মধার। আর আছে কান্না গাছ। ওয়েলিং ট্রি- লম্বা লতানো পাতাগুলো এমনভাবে নুয়ে থাকে যে দেখে মনে হয় কোনো দুঃখিনী নারী যেন কান্নায় ভেসে যাচ্ছে! আর বিচিত্র সব বৃক্ষের এত সমাহার যে সেসবের নাম জানতে হলে বোটানির বই পড়তে হবে। পিকনিক স্পটে আরো অসংখ্য মানুষের কলরবে থমসন পার্ক মুখরিত হয়ে উঠল।
আমি বরাবরই প্রকৃতিপ্রেমী। দলবল ফেলে গাছের সাথে, উন্মুক্ত নীল আকাশের সাথে সখ্যতা করে গেলাম। এমন অবারিত প্রকৃতির কাছাকাছি হওয়া তো কিছু আর সহসাই ভাগ্যে জোটে না। স্থানে স্থানে পরিষ্কার টলটলে পানির নালা, তার ওপর ব্রিজ। হাঁস আর মাছ চড়ে বেড়ায় সেসব নালায়।
আমার আজকের এই লেখায় থমসন পার্ক সম্পর্কে বালুকা বেলা’র আগের কোনো এক লেখার সাথে মিলে যেতে পারে। থমসন পার্কে দুইতিন বার গিয়েছি। প্রতিবারই নতুন করে তো আর বলার কিছু থাকে না।
আসলে সামার মানেই টরোন্টোর অন্য আরেক রূপ। পুরো শীতে তো টরোন্টো সাদা ব্ল্যাকেট গায়ে প্রায় ঘুমিয়ে থাকে। সামারে তার অন্য রূপ দেখা যায়। শুধু কালো কাঠামোর ন্যাড়া গাছে বরফের আস্তর দেখে দেখে চোখ ব্যথা করে। সামারে সেই কালো ডালপালায় গজিয়ে ওঠে গাঢ় সবুজ পল্লব। শরীর-মন-চোখ তখন জুড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের গ্রীষ্মের সময়ের মতো এক ধরনের আলস্য ভর করে।
সেই সতেরোশ’ শতকে থমসনরা স্কটল্যান্ড থেকে এসে এখানে ঘর তুলে থাকতে লাগল থমসনদের ক্যাবিন। সেই আমলের কাঠের বাড়ি দেখে মনে হয় যেন এইমাত্র ঘরটা তোলা হয়েছে। একটা প্রাচীন চাপকলও আছে।
জায়গাটাকে সুচারুরূপে সংরক্ষিত করা হয়েছে। একটা ছোটোখাটো মিউজিয়ামও আছে এখানে।
বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে লেকশোরে গিয়েছি। উপভোগ করেছি অব্যক্ত সৌন্দর্য। মিসিসগার প্রান্ত দিয়ে যেবার লেকশোরে গেলাম সেবার দূরের ডাউনটাউনের আকাশছোঁয়া ইমারত আর সিএন টাওয়ারের উঁচু চূড়াকে দেখলাম পানিতে ভাসছে! সাঁঝের প্রাক্কালে বিস্তৃত পানিতে শতসহস্র বর্ণিল বিদ্যুৎবাতির চোখধাঁধানো প্রতিফলন দেখে মনে হয় স্বর্গরাজ্যে চলে এসেছি। পাথুরে বেলাভূমিতে আছড়েপড়া ঢেউ আর তার শব্দে অতিসাহসীরও বুক কেঁপে উঠবে। অন্যদিকে, লেকের অপেক্ষাকৃত সরু ও স্থির অংশে বিশাল সব ধবল রাজহাঁস পালতোলা ময়ূরপক্সক্ষী নায়ের মতো ভেসে বেড়ায়।
আমরা যে পথটা দিয়ে গাড়িতে করে এসেছি বিচে, সেটা ছিল আঁকাবাঁকা, দুইপাশে পাহাড় আর টিলা। বিচে নেমে একদিকে দেখতে পেলাম লাল-হলুদ মাটির পাহাড়। অসংখ্য বৃক্ষ তরুলতায় ছাওয়া। ওপরে অবারিত নীল আকাশ। এসব পাহাড়ের চুড়োয় আবার দুয়েকটি বাড়ি দেখা যায়। সেগুলো মিলিয়ন ডলার ক্যাবিন। লেক অন্টারিওর সুবাদে পুরো অন্টারিও শহরের যত্রতত্র আপনারা দেখতে পাবেন সীগাল। এরা উড়ে বেড়ায় টরোন্টোর আকাশে, ডাকে কোয়াঙ্ক-কোয়াঙ্ক ধাতব শব্দে। মাটিতে নেমে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। মানুষকে দেখে পালিয়ে যায় না, কারণ কেউ ওদেরকে বিরক্ত করে না বা ক্ষতি করে না।
টরোন্টোর সামারকে কনসার্টের মহোৎসবও বলা যায়। এসময় বিভিন্ন থিয়েটারে অনুষ্ঠিত হয় বিখ্যাত ব্যান্ডের কনসার্ট। আরো আছে অসংখ্য অ্যানোয়াল ফেস্টিভ্যাল বা বার্ষিক উৎসব, যেমন লুমিনাটো ফেস্টিভ্যাল, মিসিসগা ওয়াটার ফ্রন্ট ফেস্টিভ্যাল, টিডি টরোন্টো জাজ ফেস্টিভ্যাল, রেডপাথ ওয়াটার ফ্রন্ট ফেস্টিভ্যাল- এমনি অসংখ্য উৎসব।
অসংখ্য পাখি আর কানাডা গুজের দেখা পাওয়া যাবে ব্রিমলি পার্কে ও আশেপাশের এলাকায়। সামারের টরোন্টোতে আরেকটি মজার অভিজ্ঞতা হতে পারে টরোন্টো জু-তে। বছরের অধিকাংশ সময়ে বরফে জেরবার হয়ে থেকে গ্রীষ্মে পশুপাখিরাও তৎপর ও কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে।
গ্রীষ্মের টরোন্টোকে উপভোগ করতে গ্রীষ্মে টরোন্টোতেই থেকে যেতে চাই। বাংলাদেশে বছরের অন্য যেকোনো সময়ে যাওয়া যেতে পারে।