হাসান জাহিদ : কথাশিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।
১১ মে, ২০১৪ দোলনচাঁপা চক্রবর্তী সম্পাদিত ও কুলদা রায় কর্তৃক প্রকাশিত গল্পের সুবিশাল ভাণ্ডার ‘গল্পপাঠ’-এর বৈশাখ ১৪২১ সংখ্যায় আমার গল্প ‘মিথিলা, সেওহারা ও সে’ প্রকাশিত হয়। এই গল্পটা আমার খুব প্রিয় এবং জাদুবাস্তবের পদাবলি গল্পগ্রন্থে (প্রকাশিত) অন্তর্ভুক্ত। আমি চাচ্ছিলাম ভালো কোনো মাধ্যমে গল্পটা ফের প্রকাশ করি। ঢাকায় কোনো জাতীয় দৈনিকে দেয়াটা ঝুুঁকিপূর্ণ হতো, কারণ জাদুবাস্তবের পদাবলি গল্পগ্রন্থটি সম্পর্কে ইতোমধ্যেই লেখালেখি হয়েছে এবং আরও আলোচিত হয়েছে। তাই বইয়ে প্রকাশিত গল্প আবার সাহিত্য পাতায় দিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি। সেটা একটা কারণ, আরেকটা কারণ হলো- গল্পটি যদি কোনো সাহিত্য সম্পাদক আলস্যে ফেলে রাখেন, বা না প্রকাশ করেন, তবে নিজকে সান্ত¦না দেয়ার কোনো পথ খোলা থাকত না। এরকম হয়, গল্প পাঠালে তা অনাদরে পড়ে থাকে, আবার দেখা যায় যে, আমার খুব পছন্দের নয়- আমার এমন গল্পও হঠাৎ করে কোনো নামি পত্রিকার সাহিত্য পাতায় স্থান লাভ করেছে।
গল্পটি আমার নিজেরই প্রিয় হওয়ার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত এই গল্পটিতে জাদুবাস্তবতার উপাদান সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছি বলে আমার বিশ্বাস। দ্বিতীয়ত উত্তর আধুনিকতার সামান্য কিছু মালমশলাও গল্পটাতে রয়েছে বলে মনে করি। এটা শুধু আমারই কথা না। গল্পকার আতোয়ার রহমান জাদুবাস্তবের পদাবলি গল্পগ্রন্থটি সম্পর্কে আলোচনায় আমার এই গল্পটি সম্পর্কে লিখেছে: ‘কিছু কিছু গল্পে যেমন, ‘মিথিলা, সেওহারা ও সে’ গল্পে লেখকের অনায়াসলদ্ধ ম্যাজিক রিয়েলিজমের চমৎকার স্বকীয় ব্র্যান্ড সচেতন পাঠকের সামনে সফলভাবে উন্মোচিত হয়। প্রোটাগনিস্টের মৃতা স্ত্রী মিথিলা পুরো গল্পজুড়ে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, তাকে মৃতা বলে ভাবা যায় না। গল্পের শুরুটাও গল্প যেখানে শেষ হবার কথা, সেখান থেকে। গল্পের শেষ দিকে জানা যায়, মিথিলা বেঁচে নেই। গল্পের মূল চরিত্র থাকে চিলেকোঠায়। আর বাড়ির ছাদজুড়ে পাওয়া যায় বাড়িওয়ালার যৌবনতাড়িত বিধবা মেয়ের পদশব্দ। অবারিত কৌতূহলে মুখোমুখি হবার বাসনায় চিলেকোঠা থেকে ছাদে পা দিয়েই বিবশিত হয় প্রোটাগনিস্ট। সন্ধ্যার প্রাক্কালে নারকেল গাছের পটভূমিকায় চুল ছড়িয়ে যে দাঁড়িয়ে ছিল, সে তার মৃত স্ত্রী মিথিলা!
সাধারণত প্যারানরমাল আবহ সৃষ্টির জন্য আমরা গল্প-উপন্যাসে দেখি সাদা ব্যসন পরিহিতা কোনো যুবতীকে। গল্পকার এখানে সেই সাদা ব্যসনের ক্লিশের মতো বিবরণ পরিহার করেছেন। শুধুমাত্র লম্বা চুলের চকিত বর্ণনার কারসাজিতে পাঠকের করোটিতে আঁকা হয়ে যায় জঙ্গম চিত্র।’
গল্পটা একটি অতি সমৃদ্ধ সাইটে প্রকাশ করতে পেরে আত্মতৃপ্তি লাভ করছি। আরও অধিক সংখ্যক পাঠক গল্পটি ও এর রচনাশৈলী সম্পর্কে জানতে পারবেন। আমি প্রচারবিমুখ বরাবরই; এবং ইন্ট্রোভার্ট, বিশেষ করে নিজের ক্রিয়েটিভিটির ব্যাপারে। আমি দেখেছি, অনেক লো-প্রোফাইলের লেখক, গল্পকার বা কবি কতিপয় টেকনিক প্রয়োগ করে আলোচনায় এসেছে এবং পুরস্কারও বাগিয়ে নিয়েছে। এমনও দেখেছি, অসংখ্য ভুল বানান ও বিক্ষিপ্ত আইডিয়া আর আঙ্গিকগত ত্রুটিপূর্ণ লেখা পত্রিকায় ছাপিয়ে সেই লেখা নিয়ে লেখক তার লেখাটা যে গুণে-মানে ভালো, সেটা বলে বেড়াচ্ছে। অন্যদিকে, আমার নিজের কোনো লেখা প্রকাশিত হলে আমি আরও নিশ্চুপ হয়ে যাই।
১৯ মে, ২০১৪ ইকবাল তাজওলি নামের এক গল্পকার ফেসবুকে ম্যাসেজ দিয়ে জানাল যে সে ‘গল্পপাঠ’-এ প্রকাশিত আমার গল্প ‘মিথিলা, সেওহারা ও সে’ পড়েছে এবং তার কাছে ভালো লেগেছে। খানিকটা বিস্ময় বোধ করছি; কেননা এই গল্পটি বা এর প্রকাশ বিষয়ে আমি তাকে কিছু জানাইনি। সে নিজে থেকেই গল্পটা খুঁজে বের করেছে এবং পড়েছে। আমার কোনো লেখা বা প্রকাশিত গল্প সম্পর্কে ফিডব্যাক পাই কম বেশি। এরকম কোনো ফিডব্যাক আমার মাঝে দীর্ঘস্থায়ী ভালো লাগার অনুভূতি সৃষ্টি করে।
এখানে আরেকটু জানিয়ে রাখি যে, এই গল্পটি নিয়ে নাটক ‘মিথিলা’ নির্মিত হয় এবং এনটিভিতে প্রচারিত হয়। নাটকটি পরিচালনা করেন মুরশেদ হিমাদ্রী। পরিচালকের অনুরোধে আমি একটা স্ক্রিপ্ট তৈরি করি, যার ভিত্তিতে নাটকটি নির্মিত হয়। অনেকে, বিশেষত আমার পরিচিত ও অপরিচিত আলোকিত পাঠক-পাঠিকা বলেছেন যে, আমি ম্যাজিক রিয়েলিজম টার্মটি খুব পছন্দ করি। আমি বিনীতভাবে জানাতে চাই যে, তা আমি করি। কিন্তু দাবি করি না যে, আমি ম্যাজিক রিয়েলিজমে বিশেষজ্ঞ। বিষয়টা মোটেও তা নয়। আসলে এখনও আমি ম্যাজিক রিয়েলিজম কী, তা বুঝতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বস্তুত, প্রায় তিন দশক ধরে আমি জাদুবাস্তবতা বা উত্তরাধুনিকতা বুঝতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
এই বুঝার শেষ নেই, তা পাঠক ও বিজ্ঞ সাহিত্যিকগণ জানেন। একজন দ্বিতীয় গার্সিয়া মার্কেসকে পেতে কতকাল ও কত শত বছর লাগবে, আদৌ পাওয়া যাবে কিনা, আমরা নিশ্চিত নই।