হাসান জাহিদ : কথা শিল্পী হাসান জাহিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন ইংরেজি সাহিত্যে, আর কানাডায় পড়াশুনা করেছেন সাংবাদিকতা ও কালচার এন্ড হেরিটেজ বিষয়ে। তিনি ইকো-কানাডা স্বীকৃত পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের লেখক হাসান জাহিদ ‘বালুকা বেলা’ কলামে ‘বাংলা কাগজ’ এর পাঠকের কাছে তুলে ধরবেন তাঁর প্রিয় সব বিষয়ের অনুসন্ধিৎসু ক্যানভাস।

খড়ম প্রাচীন পাদুকা। প্রাচীন বলেই এর সাথে মিশে থাকে রহস্য, এমনকি ভৌতিক আবহ। হিন্দি ‘খড়ৌঙ’ শব্দ থেকে বাংলায় খড়মের নামকরণ হয়েছে। এটি একটি কাঠের পাদুকা। ছোটোবেলায় গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে মুরুব্বিদের দেখেছি খড়ম পরতে। সন্ধ্যার প্রাক্কালে খড়মের সেই বিচিত্র শব্দ মনের ভেতর গেঁথে আছে।

আজকে এই খড়ম-প্রসঙ্গ আনার উদ্দেশ্য আমার একটা আছে বৈকি। কালচার অ্যান্ড হেরিটেজ বিষয়ে পড়াশোনার সময় বিভিন্ন ফিল্ডট্রিপে যেতে হয়েছিল। যেতে হয়েছিল টরোন্টোতে অবস্থিত বাটা শ্যূ মিউজিয়ামে। শ্যূ মিউজিয়াম পরিদর্শন ও খড়মের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে বলেই খড়ম প্রসঙ্গটা তুললাম। তো ‘পাদুকা’ নাম দিয়ে আমি একটা ডকিউমেন্টারি তৈরি করে সেটা উপস্থাপন করেছিলাম ক্লাসে, আর তা বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। আমাদের অ্যাসাইনমেন্টের অন্যতম ক্রাইটেরিয়া ছিল ক্লাসে সেটা উপস্থাপন করা ও ইউটিউবে দেয়া। এটা ইউটিউবে এখনও আছে। এই লিংকে এটা দেখা যেতে পারে https://youtu.be/9-q6oxD3lAA

সুপ্রাচীন কাল থেকে খড়মের ব্যবহার হয়ে আসছিল। পায়ের মাপে একখণ্ড কাঠের টুকরো দিয়ে খড়ম তৈরি হয়। এর সামনের ভাগে বর্তুলাকার একটা কাঠের গুটি থাকে যা পায়ের বুড়ো আঙুল ও পাশের আঙুলে আটকে থাকে। আরেক ধরনের খড়ম দেখেছি, যাতে পায়ের আকারের তক্তার সামনের ভাগে রাবারের ফিতা থাকে। হিন্দুরা খড়মকে দেবতা ও সাধুসন্তদের পদচিহ্নের প্রতীক মনে করে। রামায়ণে খড়মের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। উপমহাদেশের বিশিষ্ট আউলিয়া হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) চোদ্দশ’ শতকে সিলেটে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর ব্যবহৃত খড়ম এখনও তাঁর সমাধিস্থলের স্থাপনায় সংরক্ষিত আছে।
আজকে এই খড়ম প্রসঙ্গ আনার তিনটি কারণ রয়েছে। কারণ তিনটি উল্লেখ করছি। প্রথম কারণ: আমাদের ক্লাসে কালচারাল প্রেজেন্টেশন-পূর্ব কিছু প্র্যাক্টিস হচ্ছিল। সেই ক্লাসে জুতো-স্যান্ডেল প্রসঙ্গ এসেছিল। আমি খড়মের উল্লেখ করলাম। খড়ম কী জিনিস তা এঁকে দেখালাম। নাগরাই জুতোর উল্লেখ করলাম। সেটাও আঁকলাম। আমার উপস্থাপনা এবং অঙ্কন প্রফেসরকে মুগ্ধ করেছিল। পরে কালচারাল প্রেজেন্টেশন পর্বে অবশ্যি আমি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার ওপর উপস্থাপনা করেছিলাম। দ্বিতীয় কারণ: এর কয়েকদিন পরই আমরা বাটা শ্যূ মিউজিয়াম পরিদর্শন করলাম। তারিখটি ছিল ২৫ জুন, ২০১৩ মঙ্গলবার।

মিউজিয়ামটি টরোন্টোর ডাউনটাউনের ব্লোর স্ট্রিট ও সেন্ট জর্জ স্টেশনের মাঝামাঝি অবস্থিত। ‘বাটা শ্যূ মিউজিয়াম পরিদর্শন করার মধ্যে কী এমন উত্তেজনা বা রহস্য রয়েছে’Ñভিজিটে যাবার আগে এমন একটা ভাব পোষণ করছিলাম মনে মনে। কিন্তু মিউজিয়ামে পৌঁছে আমার ধারণাটা মাঠে মারা গেল। এই মিউজিয়ামে অনেক কিছু আছে দেখার মতো। বাটা’র ¯্রষ্টা টমাস জে. বাটা’র স্ত্রী সোনিয়া বাটা (Sonja Bata) এই মিউজিয়ামটি সৃষ্টি করেছেন। সুইট্জারল্যান্ডের নাগরিক (বর্তমানে ক্যানেডীয়) ১৯৪৬ সালে তৎকালিন চেকোস্লোভাকিয়ান টমাস জে. বাটাকে বিয়ে করেন। বিখ্যাত জুতো নির্মাতা বাটা, যাকে বলা হয় ‘Shoemaker to the World’, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কানাডায় অভিবাসন গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সাল থেকে আশির দশক পর্যন্ত তিনি বাটা শ্যূ কোম্পানি পরিচালনা করেন। ২০০৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

বর্তমানে এই মিউজিয়ামে দশহাজার জুতোর সংগ্রহ রয়েছে। ৪,৫০০ বছর আগের জুতো থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর অনেক সেলিব্রেটিদের জুতোও এখানে সংরক্ষিত আছে।
শুরুতেই আমাদেরকে জাদুঘরের দুই গাইড ব্রিফিং করল। তাদের মধ্যে একজন আমাদেরকে ডিসপ্লে গ্যালারিতে নিয়ে যায়। অন্য একজন আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের জুতো, সেসবের উপযোগিতা এবং এইসব জুতোর সাথে জড়িয়ে থাকা গল্প শোনাল। জুতোর মধ্যে গল্পের গন্ধ পেয়ে আমার উৎসাহ বেড়ে যায়।

৪,৫০০ বছরেরও বেশি সময়ের ইতিহাস এবং বিংশ শতাব্দীর সেলিব্রেটি জুতোর একটি সংগ্রহশালা আমাকে নিয়ে যায় প্রাচীনকালের কোনো গোলোকধাঁধায়।
জাদুঘরটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপার্সন হলেন সোনিয়া বাটা। তিনি ১৯৪৬ সালে টমাস জে. বাটাকে বিয়ে করেন, যিনি একজন তৎকালিন চেকোস্লোভাকিয়ার জুতো প্রস্তুতকারক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাটা কানাডায় অভিবাসিত হন।

এই ধরনের জাদুঘর পরিদর্শন মানবেতিহাস ও মানব আচরণ সম্পর্কে জানা ও শিক্ষার অনেক উপাদান যোগায়। প্রাচীনকালের, তথা মিশরীয়, গ্রীক এবং রোমান জুতোগুলো আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। উপরন্তু, কানাডার বিভিন্ন সময়কাল. শৈলী এবং সংস্কৃতির জুতোও আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় ও শিক্ষণীয় মনে হলো। ক্যারিবু-এর চামড়া ও পশম দিয়ে তৈরি একটি জুতো (উত্তর আমেরিকার? বিশেষ করে কানাডার একজাতের হরিণ) আমাকে বিশেষভাবে বিস্মিত করেছিল।

জুতোটি উষ্ণ এবং এতে একটি ত্রিভুজাকার চিহ্ন রয়েছে। জুতো জোড়া পরা অবস্থায় এটি একটি মেয়েকে তার বাড়ি উষ্ণ রাখার আগুনকে সবসময় জ¦লন্ত রাখার কথা মনে করিয়ে দেয়। তথ্যটা গাইড আমাদেরকে জানাল, আর আমি চমৎকৃত হলাম শুনে।
তাছাড়া আছে বিভিন্ন রঙের অনেক প্রচলিত জুতো, উপকরণ ও মাপ। এর মধ্যে একটি নির্মাণ কার্যের সময় ব্যবহারোপযোগী বিশাল আকারের জুতো এবং অন্যটি ছিল একটি ক্লাউন জুতো। গাইড আফ্রিকা মহাদেশসহ বিভিন্ন দেশের জুতো ও স্যান্ডেলও আমাদেরকে দেখাল।

আফ্রিকা থেকে আসা এমন একটি স্যান্ডেল কেবল যানবাহনের পুনর্ব্যবহৃত টায়ার দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল! গাইড আমাদেরকে ‘গেটা’ নামে একটি জুতোও দেখাল, যা পুরোপুরি কাঠের একটি টুকরো দিয়ে তৈরি। একটি স্যান্ডেল দেখেছি যা বার্চ গাছের ছাল দিয়ে তৈরি। আমরা ভালুকের চামড়া এবং পশম দিয়ে তৈরি কিছু জুতো দেখেছি, যা প্রধানত মহিলারা তৈরি করে।

মিউজিয়ামে প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক সময় পর্যন্ত নানা জাতের ও সময়ের এক বৈচিত্র্যময় জুতো সংগ্রহশালা। জনসাধারণ যেসব জুতো পরে আর বিশ^জুড়ে বরেণ্য ব্যক্তিদের নানাজাতের জুতো পরার কায়দা ও শখ এবং ফ্যাশনের প্রবণতা দেখানো হচ্ছিল টিভি মনিটরে।

অ্যাপোলো ১৩-এর জিম লাভেল নামে এক নভোচারীর একটি জুতোও ছিল সংগ্রহে, যিনি ১৯৭০ সালে চাঁদে তিন সদস্যের মিশনের নেতা ছিলেন। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।
গ্যালারিতে হিন্দু, বৌদ্ধ, ইহুদি ও ইসলামের মতো বিভিন্ন ধর্মের জুতোর নমুনাও ছিল।
আমি গাইডকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা এইসব জুতোগুলো কোথা থেকে-কীভাবে সংগ্রহ করেছে? গাইড জানাল যে, কিছু জুতো প্রতিরূপ বা রেপ্লিকা। কিছু নিলাম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। কিছু কিছু এসেছে অনুদান হিসেবে। সামগ্রিকভাবে, সময়কাল নিচে উল্লেখ করা হলো:

প্রাচীন মিশরীয়, প্রাচীন গ্রীক এবং রোমান যুগ। জুতো পরিহিত ভারতীয় মূর্তি এবং মোজরাই ‘পাদুকা’ (জুতো), পশ্চিম আফ্রিকান আসান্তে (Asante) সা¤্রাজ্য, চিনের সান কিংস এবং ইয়োরোপের বারোক ও রোকো যুগের (১৭৩০-১৭৪০) নমুনা।
জুতো আমাদেরকে একটি গল্প বলে; এমনকি তারা আমাদের বিভিন্ন সময়কালের ইতিহাস-সংস্কৃতি এবং সভ্যতার গল্প বলে।

খড়ম প্রসঙ্গ টেনে আনার তৃতীয় কারণটি হলো, ‘খড়ম পেয়ে বুড়ো’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম। এই নামটি পরে অবশ্যি কিছুটা পরিবর্তন করেছি। এটি প্রকাশিত হয় কোনো একটি পত্রিকায়। পরে কোনো কোনো অনলাইন পত্রিকা এটিকে পুনঃপ্রকাশিত করে। গল্পটা জাদুবস্তবতার আদলে নির্মিত। নব্বই দশকের কথা মনে পড়ে গেল। সেসময় ছিলাম টগবগে তরুণ। সাহিত্য আড্ডায় যাই। জাদুবাস্তবতা নিয়ে নাড়াচাড়া করি। আমরা কয়েকজন গল্পকার বন্ধু জাদুবাস্তবতা নিয়ে আলাপ করতাম।

আমি কবি-সাহিত্যিকদের নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না এখানে, যারা প্রকাশ্যে আমার কাছে জাদুবাস্তবতা ও গল্পের কাঠামো সম্পর্কে জেনে নিত। আমার সুদীর্ঘকালের বিরতিতে আমি অনেক পেছিয়ে গিয়েছি। এই গ্যাপটুকু আর কোনোভাবেই পূরণ করবার মতো নয়; তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি।

‘খড়ম পেয়ে বুড়ো’ লেখার তাগাদাটা তৈরি হলো যেদিন ক্লাসে খড়ম সম্পর্কে উপস্থাপনা করেছিলাম। খড়ম পায়ে দেয় মূলত বুড়ো ও প্রাচীন লোকেরা। তাই কেন্দ্রীয় একটি চরিত্রে এক বুড়োকে দাঁড় করালাম। গল্পটা বর্ণনা করেছি উত্তম পুরুষে। কেননা, একজন বুড়ো সম্পর্কে লেখকের বর্ণনা দেয়ার জন্য কাঠামোগত কারণেই তা করেছি। গল্পটিতে ব্যাক অ্যান্ড ফরোয়ার্ড এবং জাদুবাস্তবতার লক্ষণের কিছু উপকরণ দিয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গল্পটি জাদুবাস্তবের আদল পেয়েছে।

আজ এ পর্যন্তই। আগামী সংখ্যায় আবার আসব ভিন্ন বিষয় নিয়ে। সেই সময় পর্যন্ত বিচরণ করব বালুকা বেলায়।