ভজন সরকার : এবারেও শতাব্দী এক্সপ্রেসেই শিলিগুড়ি থেকে কলকাতা ফিরলাম। দিনের ট্রেন। চেয়ার কোচ। শীতাতোপ নিয়ন্ত্রিত। বরাবরের মতোই ভারতে ট্রেন সার্ভিস বেশ উন্নতমানের। আজ থেকে প্রায় বছর তিরিশ আগে রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লী গিয়েছিলাম। তখনও যাত্রী সেবাসহ প্রায় সব ব্যবস্থাই ছিল উন্নতমানের। এবারেও দেখলাম শতাব্দী এক্সপ্রেসে খাবারসহ প্রায় সব সেবাই চমত্কার। বিশাল ভারতে বিমান দিয়ে তো আর এতো মানুষের চলাচল নিশ্চিত করা যাবে না। তাই মাকড়সার জালের মতো বিস্তৃত রেল পরিসেবা ছড়িয়ে আছে সারা ভারত জুড়ে।

খুব ভোরে শিলিগুড়ি থেকে রওনা হয়ে দুপুরে কলকাতা। পথে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে ট্রেন থামে। এবারেও ফারাক্কার উপর দিয়ে শতাব্দী এক্সপ্রেস যখন যাচ্ছিল তখন ভাটিতে জলের স্বল্পতা দেখে ধুধু পদ্মার কথাই মনে হচ্ছিল। সারা পৃথিবী জুড়েই অভিন্ন নদীর ভাটির দেশগুলো বঞ্চনার শিকার। ফারাক্কা চুক্তির পরেও কি ভাটির অববাহিকা ন্যায্য হিসসা পাচ্ছে? জানি না। তবে এটুকু জানি বাংলাদেশের নদীগুলো বছরের অধিকাংশই সময়ে নাব্যতাহীনই থাকে।
প্রতিবার বোলপুর স্টেশনে ট্রেন থামলে শান্তিনিকেতনের কথা মনে হয়। শান্তিনিকেতন মানেই প্রচ্ছন্ন কিংবা প্রত্যক্ষ ভাবে দন্ডায়মান এক মূর্তিমান মহাপুরুষ, যিনি একটি ভাষিক এবং ভৌগলিক জাতিগোষ্ঠীর কাছে নিত্যদিনের জন্য স্মরণীয় এবং বরণীয়। বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি-সাহিত্য-শিল্প-সংগীতের একছত্র অধিপতির নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই তো বোলপুর, শান্তিনিকেতন, শতাব্দী এবং রবীন্দ্রনাথে যেন এক সূত্রে গাঁথা।

ঢাকার তীব্র যানজটে নাকাল হয়েই এবার পশ্চিমবংগে এসেছিলাম। লেখক বন্ধুদের কথা দিয়েও কলকাতা বইমেলায় যেতে পারিনি পারিবারিক প্রয়োজনে। ঢাকার একুশে বইমেলায় অল্প সময়ের জন্য গিয়েছিলাম। সময়ের স্বল্পতা এবং ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার জন্য একটু সময়ের জন্য যখন বাংলা একাডেমি চত্বরে পৌঁছুলাম, তখন মেলার সময় শেষ। তবুও অনেকের সাথেই দেখা হলো। চার দশকের তিন বন্ধু কবি ফরিদুজ্জামান, প্রকৌশলী শ্যামল ঘোষ আর প্রকৌশলী যদুরাম পাল দা সাথেই ছিল। অনেক কবি-সাহিত্যিক বন্ধু তখন কলকাতার বইমেলায়। কলকাতা বইমেলায় যেতে না পেরে অনেকের সাথেই দেখা করতে পারলাম না।

‘কারুভাষ’ সাহিত্যপত্রের সম্পাদক ও কবি মানসী কীর্তনিয়াকে কথা দিয়েছিলাম কলকাতা বইমেলায় দেখা হবে। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে নিবেদিত এক অনলাইন লাইভে মানসীদির সাথে পরিচয়। আমার লেখা অনেকগুলো কবিতাও প্রকাশিত হয়েছে মানসীদির সম্পাদিত পত্রিকায়। ভেবেছিলাম কলকাতা বইমেলায় আড্ডা হবে। সেটা হল না। পশ্চিমবংগের কবি আভা সরকার মন্ডলের সাথে বইমেলায় দেখা না হলেও ওঁর রায়গঞ্জের বাসায় এক সন্ধ্যায় আড্ডায় মেতেছিলাম। দীর্ঘ তিন দশক আগের মানিকগঞ্জে ফিরে গিয়েছিলাম কবি আভা সরকার মন্ডলের পরিবারের সাথে সেদিনের সে সান্ধ্য-আড্ডায়।
কলকাতা শহরের যানজট নিয়ে আগে অনেক বদনাম ছিল। এবার দেখলাম কলকাতা তার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার খোল-নলচে বদলে ফেলেছে। বনেদি ট্রাম সিস্টেমের সাথে আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থা, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে, পাতাল রেল এবং অটোমেটেড রিয়েল টাইম সিগনালিং ব্যবস্থা কলকাতার যানজটকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।

সে তুলনায় ঢাকার যানজট এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মান, নির্মান চলাকালীন অব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন চলাচল, ট্রাফিক সিগনালিং ব্যবস্থাপনার ত্রুটি- সব কিছু মিলিয়ে স্থবির এক ঢাকা শহরের অভিজ্ঞতা নিয়ে চলে এলাম বাংলাদেশ থেকে।

ঢাকার বানিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিল থেকে প্রান্তিক এলাকা মীরপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল তৈরী হচ্ছে। এক সময়ে হয়ত এই মেট্রোরেলের সুবিধা রাজধানীবাসী পেতেও পারে। পেতেও পারে বলে সম্ভাবনার কথা বললাম এই কারণে যে, মেট্রোরেলের ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি রেজাল্ট আগেই বলে দিয়েছে কতটুকু সুবিধে রাজধানীবাসী পাবে এবং কখন পাবে। তবে খুব খোলা চোখে এটা বলা যায়, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সবগুলো পয়েন্টকে সুবিধে না দিলে মাঝখানের মেট্রোরেল দিয়ে যানজট মুক্ত করা যাবে না। মেট্রোরেল থেকে বের হওয়ার এবং মেট্রোরেলে আসার পথগুলো যানজট মুক্ত রাখতে হবে। তা না হলে মেট্রোরেল এক সময় ঢাকা শহরকে আরও অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাবে।

ঢাকা থেকে কলকাতার ফ্লাইট ধরার জন্য ১১টায় বিমানবন্দরে পৌঁছুতে হবে। শাহবাগ হোটেল ইন্টারকন্টিনেটাল থেকে বেরুবো। আমার এক বন্ধু বললো পৌঁছে দেবে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বন্ধু টেলফোন করলো ৮টায় বেরুচ্ছে। আমাকে সাড়ে ৮টায় তুলবে। সাড়ে ৮টায় বন্ধুর টেলিফোন। প্রচন্ড যানজট, এখনো সংসদ ভবন এলাকায়। আমার তাপমাত্রা বাড়া শুরু করলো। সাড়ে ৮টা, ৯টা, সাড়ে ৯টা বন্ধুর দেখা নেই। পৌনে ১০টায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে বেরিয়ে দেখা গেল বাংলামটর-ফার্মগেট-বিজয় সরণী- মহাখালি পর্যন্ত মহা যানজট। সেদিন ৭ মার্চ। ভিভিআইপিরা বিভিন্ন প্রোগ্রামে বেরুবেন। ট্রাফিক পুলিশ তাই সকাল থেকেই মোড়ে মোড়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে ভিভিআইপিদের যেন কোন অসুবিধে না হয় সে জন্যে। পাক্কা ১ ঘন্টা লেগে গেল বাংলামটর আসতেই। তখন ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছুঁই ছুঁই। অথচ ১১টায় আমার রিপোর্ট করার কথা।
ঢাকা থেকে কলকাতা শুধু নয়; কলকাতা থেকেও বিমান, ট্রেনসহ অনেক কিছু বুকিং। অসহায়ত্ব কা’কে বলে আমরা ছাড়া আর কেউ জানেনি সেদিন। আমার বন্ধুটিও একেবারে বোকা ব’নে গেছে। ইচ্ছা করে উপকার করতে এসে উল্টো আমার সব কিছু মাটি করে দিল হয়ত।

হাজার হাজার যানবাহন বসে আছে স্থবির হয়ে। বিপরীত দিক থেকে গাড়িতে ফ্লাগস্টান্ড লাগিয়ে অনেক গাড়ি চলে যাচ্ছে। কী এক অসভ্য নিয়ম! সচিবালয় থেকে শুরু করে সরকারী প্রায় সব গাড়িতেই পতাকা নয়, পতাকার স্ট্যান্ড লাগানো। হাজার হাজার সাধারণ মানুষ রিক্সা, সিএনজি, বাসসহ অন্যান্য যানবাহনে বসে ঘামছে আর কিছু অসভ্য আমলা শীতাতোপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে চলে যাচ্ছে নাকের ডগা দিয়ে। অথচ এই সাধারণ মানুষের টাকাতেই ওই আমলা-কামলাদের বেতন-ভাতা হয়।

বন্ধুর ড্রাইভারটি খুব স্মার্ট একটা ছেলে। হাতের মোবাইল থেকে গুগল ম্যাপ বের করে দেখলো মগবাজার ফ্রাইওভার দিয়ে কোন যানজটই নেই। সিদ্ধান্ত হলো গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো দিক দিয়ে আবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল দিয়ে মগবাজার ফ্লাইওভারে উঠবে। শেষ চেষ্টা দেখা যাক কী হয়।
অনেক কষ্ট করে যখন বিমানবন্দরের বোর্ডিং পাসের কাউন্টারের পৌঁছুলাম তখন সব কিছু গুছিয়ে ইন্ডিয়ান বিমান সংস্থার কর্মীরা কাউন্টার বন্ধ করছে। আমিই শেষ যাত্রী হিসেবে বোর্ডিং পাস নিলাম।
সব কিছু ঠিকঠাকই হলো। বিমানেও বসলাম। বিমান ছেড়ে দিল। কিন্তু রান-ওয়ে থেকে উড়াণ দিচ্ছে না। আবার ১ ঘন্টা। চৈত্র মাসের গরম। বিমানের শীতাতোপে তাপ নিবারণ হচ্ছে না। বিমানের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পেছনে আরো ৬টি বিমান উড়াণের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। এই ৬টি বিমানের সবগুলোই আন্তর্জাতিক। বিমানের কর্মীরা বললো আরো অপেক্ষা করতে হবে। ভিভিআইপি নামবেন। তাই সেই মহামান্যের নামার পর আমরা যারা ‘সামান্য’ তারা উড়তে পারবো।

৭ মার্চ বংগবন্ধুর স্বাধীনতার সেই অবিস্মরণীয় ভাষণের দিন আজ। তখনকার রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানের সোহরওয়ার্দি উদ্যান) থেকে বংগবন্ধু একটি জাতিকে স্বাধীন দেশ ও পতাকার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। সেই জাতির সাধারণ মানুষ ঠিকই সেদিন স্বাধীন হয়েছিল। বাংলাদেশ নামক এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। ঠিক ৫০ বছরে সে দেশটি কী সত্যি সাধারণ মানুষের বসবাস উপযোগী আছে?
বিমানবন্দরের রানওয়েতে ঠিক দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করার পর দেখা গেল ১টি বিমানবাহিনীর ছোট বিমান অবতরণ করলো। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি কিংবা বিদেশী কোনো দেশের বড় নেতা কেউ তো আসেননি সেদিন। তবে কার জন্য অপেক্ষা করতে হলো এই দেড়টি ঘন্টা ৭টি আন্তর্জাতিক রুটের বিমানগুলোকে?

একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম যে, কয়েক জন মন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অবতরণ নির্বিঘ্ন করার জন্যই নাকি এই ব্যবস্থা। সেদিন ছিল ৭ মার্চ। বংগবন্ধু এখন থাকলে লজ্জা পেতেন। এই আমলানির্ভর একটি বাংলাদেশের জন্য বংগবন্ধু বছরের পর বছর জেল খেটেছেন? সেদিন আমার মনে পড়ছিল বংগবন্ধুর লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-র কথা।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’-র এক জায়গায় বংগবন্ধু লিখেছেন,
“সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ায় খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ, যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।”
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও স্বাধীন বাংলাদেশে কি সত্যি সাধারণ মানুষের মুক্তি এসেছে? নাকি, কিছু অসত আমলা, দুর্ণীতিবাজ রাজনৈতিক নেতা কিংবা লুটেরা ব্যবসায়ীদের হাতে সাধারণ মানুষ আবার জিম্মি হয়েছে?
(ভজন সরকার: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)