যুক্তরাষ্ট্র : বাঙালি স্বাদের পরিপূরক তরি-তরকারীকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি বাঙালি খাদ্যে দিন অতিবাহিত করার অভিপ্রায়ে ভিন্ন ভিন্ন পেশা ও বয়সের ৬ প্রবাসী নিউইয়র্কে প্রায় ৯০ একর জমিতে সবুজের সমারোহ ঘটিয়েছেন। আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি বাঙালির বসতি গড়ে উঠেছে নিউইয়র্ক সিটিতে। এখান থেকে ৬৫ মাইল দূর নিউ হ্যামটন সিটির ওনিয়ন এভিনিউতে সবুজে ঘেরা মনোরম এক পরিবেশে বাঙালি আমেজ পরিস্ফুট করেছেন ‘বাংলা ফ্রেশ’ নামক কৃষি খামার স্থাপন করে।

মহাসড়ক থেকে এক্সিট নিয়ে ‘বাংলা ফ্রেশ’ এলাকায় দৃষ্টি প্রসারিত করলেই হৃদয় জুড়িয়ে যায় লাল শাক, পুই শাক, কলমি শাক, লাউ শাক, ডাটা ও শাক, পাট শাক, কচু শাক, কুমরা শাক, কাকরল, চাল কুমরা, করল্লা, ঢেড়স, মিস্টি কুমরা ইত্যাদির বিশাল বাগানে। এসব সবজি সরবরাহ করা হয় নিউইয়র্ক সিটির কুইন্সে বড় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।

সেখান থেকে বাংলাদেশি গ্রোসারির পাশাপাশি ভারতীয়, পাকিস্তানী, নেপালী, শ্রীলংকান এবং মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দোকানেও বিতরণ করা হয়। এই খামারের অন্যতম মালিক ডা. এস এম জাভেদ হোসেন জুয়েল জানালেন, ‘৫৯ ডলারের অধিক মূল্যের শাক-সব্জির অর্ডার অনলাইনে পেলে আমরা বিনা ফি-তে বাসায় ডেলিভারি দেই। আবার অনেকে সখের বশে পরিবারসহ এখানে এসে পছন্দের সবজি তুলনামূলকভাবে কমদামে নিয়ে যাচ্ছেন। এতে আমরাও আপ্লুত হই স্বদেশীদের সাথে অন্তরঙ্গ হতে পেরে।

বাগেরহাটের সন্তান ডা. জুয়েল ব্রঙ্কসের একটি হাসপাতালে চাকরির পাশাপাশি নিজস্ব চেম্বারে রোগীও দেখেন। এমনি ব্যস্ততার মধ্যেও সবজি চাষে সময় দেন পার্টনারদের মতোই। এ প্রসঙ্গে আরেক পার্টনার ভোলার সন্তান ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ থেকে বীজ এনে আমরা সবকিছু করছি। বাঙালি নাড়ির সাথে জড়িয়ে থাকা সবজির স্বাদ অটুট রেখেই আমরা প্রবাসীদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হচ্ছি।

করোনা পরিস্থিতির জন্যে ঢাকার সাথে ফ্লাইট চালু হতে বেশ বিভ্রাট ঘটায় বিভিন্ন জাতের সব্জির বীজ পেয়েছি বিলম্বে। মোট ৫৬ কেজি বীজ আনা হয়েছে এবার। বললেন অন্যতম পার্টনার নড়াইলের মোস্তাফিজুর রহমান।

বাংলাদেশে বন বিভাগের সাবেক কর্মকর্তা নারায়নগঞ্জের সন্তান আশরাফুর রহমান বললেন, দু’বছর আগে আমরা এই চাষাবাদ শুরু করেছি। ভিন্ন পেশা এবং বয়সের অনেক ব্যবধান হলেও আমরা সমমনা বিধায় পরস্পরের সহযোগী হয়ে সবজি চাষে সফলতা আসছে। তবে এখনও অনেক কিছুই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। দিন যত যাচ্ছে ততবেশী অভিজ্ঞতা হচ্ছে।

‘বাংলাফ্রেশ’র আরও তিন পার্টনার হলেন নড়াইলের কাঞ্চন সরকার ও বিপ্লব সর্দার এবং ভোলার সাকি শরিফ সোহাগ সবচেয়ে বেশি তৃপ্ত। এরা কেউ উবার অথবা কেউ অন্য পেশায় রয়েছেন। যন্ত্রের মত জীবনে কিছুটা হলেও প্রশান্তি এনে দিয়েছে এই সবজি বাগান- বললেন সমস্বরে। বাণিজ্যিক বিষয়ের সাথে মাতৃভূমির স্বাদের পরিপূরক খাদ্য সামগ্রি উৎপাদন ও পরিবেশনের মধ্যে পৃথক একটি আনন্দ রয়েছে, সেটি আমাদেরকে সবসময় উজ্জীবিত রাখে এবং উৎসাহিত করে-বললেন কা ন সরকার।

বাগানের শ্রমিকরাও বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। সন্তানেরা স্পন্সর করেছেন বাবা, চাচা, খালুদের। একেকজনের বয়স ৬৫ বছরের অধিক। তাদেরই কয়েকজন এই খামারে কাজ করেন। তারা বললেন, দেশে নিজ জমিতে কাজ করে যে আনন্দ আর তৃপ্তি পেতাম, তারচেয়ে ঢের বেশি পাচ্ছি এখানে। নিজের মত করে পরিশ্রম করছি। অন্য কোন কাজ এভাবে করতে পারতাম না। শারিরীক অবস্থা কুলোতো না। কিন্তু এটি আরও বেশি পরিশ্রমের হলেও কোন সমস্যা হচ্ছে না। যেহেতু আমরা আনন্দ পাই এটি করে। এমন অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটালেন জামালপুরের মেলান্দহের প্রবীন এক ব্যক্তি।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের আরেকজন বললেন, এই খামারের মালিকেরাও আমাদের সাথে একাকার হয়ে কাজ করেন বিধায় স্বাচ্ছন্দবোধ করি প্রচন্ড রোদেও চাষাবাদে।

ডা. জুয়েল বললেন, এই খামারের পাশ দিয়েই প্রবাহমান খালে মৎস্য চাষ করার ইচ্ছা আছে। পাশাপাশি হাঁস-মুরগী ও গরু-ছাগলের সংযোজনও ঘটাবো। স্থানীয় কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা আমাদের যে কোন সমস্যায় পরামর্শ দিচ্ছেন। তারাও অত্যন্ত আন্তরিক বহুজাতিক এ সমাজের বৈচিত্রকে সমুন্নত রাখার পরিপূরক খাদ্য উৎপাদন করছি বলে।

জুয়েল বললেন, আমরা বার্ষিক ভিত্তিতে এসব জমি লীজ নিচ্ছি। তবে চেষ্টা করছি স্থায়ীভাবে ক্রয় করতে। তাহলে টেনশন থাকবে না পরের বছরের চাষাবাদ নিয়ে। ডা. জুয়েল উল্লেখ করলেন, নিউইয়র্ক অঞ্চলে ৬ মাস খুবই ঠান্ডা থাকে। সে সময় সবজি চাষ সম্ভব হয় না। এজন্যে ফ্লোরিডাতেও জমি খুঁজছি সারাবছর চাষাবাদের জন্যে। কারণ দিন যত যাচ্ছে বাঙালি স্বাদের সবজির চাহিদাও বাড়ছে। এখন শুধু বাঙালিরাই খাচ্ছেন না। মধ্যপ্রাচ্য এবং স্প্যানিশরাও সবজির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। কেউ কেউ সালাদ হিসেবেও ব্যবহার করছেন বাঙালির শাক-সবজিকে।

নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, পেনসিলভেনিয়া, কানেকটিকাট, ম্যাসেচুসেটস স্টেটে ৪ লাখের মত বাংলাদেশি রয়েছেন। এর অনেকেই নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ করেন। তারপরও প্রায় প্রতিটি গ্রোসারিতেই সবজি বিক্রি হয় প্রতিদিনই। টাটকা সবজি গ্রোসারীতে সাজানো মাত্রই ফুরিয়ে যাচ্ছে। চাহিদার পরিপূরক সবজি এখনও মেলে না বলে দাম বেশি নেয়া হচ্ছে। বাংলাফ্রেশ’র মত আরও কয়েকটি খামার রয়েছে বাঙালিদের। তারাও চেষ্টা করছেন চাহিদা পূরণে।