অনলাইন ডেস্ক : করোনাভাইরাস সংক্রমণে ভারতের যে রাজ্যটি সবচেয়ে বিধ্বস্ত ও নাজেহাল, সেই মহারাষ্ট্রের সরকার জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকে দশ হাজার ভায়াল রেমডেসিভির কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এনিয়ে ভারতে ইতোমধ্যে কিছুটা বিতর্ক তৈরি হলেও বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে এখনও নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় মহারাষ্ট্র।
ভারতের শুধু মহারাষ্ট্র রাজ্যেই এখনও পর্যন্ত ৮৫ হাজারেরও বেশি করোনা পজিটিভ রোগী শনাক্ত হয়েছে – যা চীনের সরকারিভাবে ঘোষিত মোট রোগীর চেয়েও বেশি। মহারাষ্ট্রের রাজধানী মুম্বাইকে তো ভারতের ‘করোনা ক্যাপিটাল’ বলেও বর্ণনা করা হচ্ছে। এই কারণে বেশ চাপের মুখে আছে মহারাষ্ট্রের শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেসের জোট সরকার। ফলে পরিস্থিতি শোধরানোর খানিকটা মরিয়া চেষ্টাতেই তারা রেমডেসিভিরের মতো দামী, এবং কোভিড-১৯ চিকিৎসায় অপরীক্ষিত একটি ওষুধ কিনতে চাইছে।
মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রমেশ তোপে গত শনিবার (৬ জুন) রাজ্য সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান, রেমডেসিভির আমদানির জন্য তারা বাংলাদেশি একটি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানির সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছেন। এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে তিনি একটি টুইট করলেও পরে অন্য কারণে তা মুছে দেন।
মহারাষ্ট্রের সরকারি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিটির কাছ থেকে প্রতি ভায়াল (যা দশ হাজার ডোজের সমান) রেমডেসিভির ১৬০ ডলার বা ১২ হাজার রুপিতে কিনবে বলে প্রাথমিক আলোচনায় স্থির হয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেও এটাই বোঝাতে চেয়েছেন, ওষুধটি দামী হওয়া সত্ত্বেও মহারাষ্ট্রের মানুষের জন্য এই অর্থ খরচ করতে সরকার দ্বিধা করছে না। মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা হওয়া অর্থ থেকেই এই টাকার সংস্থান হবে বলেও জানিয়েছে রাজ্য সরকার।
কিন্তু বিপত্তির শুরু এর পরেই।
মহারাষ্ট্র সরকারের সিদ্ধান্ত জানাজানি হওয়ার পর ভারতের অনেকগুলো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি রীতিমতো অসন্তুষ্ট। তারা মনে করে ওষুধ আমদানির যাবতীয় রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে শুধু ‘চমক’ দেখাতে বাংলাদেশ থেকে রেমডেসিভির আমদানি করতে চাইছে মহারাষ্ট্র সরকার।
তা ছাড়া বাংলাদেশে (প্রেসক্রিপশনের ভিত্তিতে) খোলা বাজারে যেখানে প্রতি ভায়াল রেমডেসিভির ৬০ বা ৬৫ ডলারে পাওয়া যায়, সেখানে মহারাষ্ট্র সরকার প্রায় আড়াই-তিনগুণ দাম দিয়ে সেই একই ওষুধ কিনতে চাইছে বলেও তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে একাধিক ভারতীয় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির প্রতিনিধির কথা হয়েছে। তবে সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় তারা কেউই ‘অন রেকর্ড’ কথা বলতে চাননি।
মহারাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রমেশ তোপে
বাংলাদেশ থেকে রেমডেসিভির আমদানির ক্ষেত্রে জটিলতা কোথায়, তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন ভারতে ড্রাগ রেগুলেশন ও আন্তর্জাতিক পেটেন্ট আইনের বিশেষজ্ঞ মুরলী নীলকান্তন। তিনি বলেন, ‘প্রথম সমস্যা হলো ভারতে যেহেতু রেমডেসিভিরের পেটেন্ট আছে মার্কিন কোম্পানি গিলিয়ার্ডের, তাই চাইলেই যে কেউ যে কোনও জায়গা থেকে এই ওষুধ এ দেশে আনতে পারে না। তবে ভারত সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের একটা বিজ্ঞপ্তিতেই মাত্র এক ঘণ্টার ভেতর এই বাধাটা চাইলে দূর করা যেতে পারে।’
‘দ্বিতীয় সমস্যাটা একটু জটিল। ভারতে যে কোনও ওষুধ আমদানি করে তার ব্যবহার ও বিক্রির অনুমতি দেয় ড্রাগ রেগুলেটর সংস্থা সিডিএসসিও। তাদের কাছে ইতোমধ্যেই অন্তত তিনটি ভারতীয় সংস্থার রেমডেসিভির তৈরির লাইসেন্সের আবেদন জমা আছে,’ বলেন মুরলী নীলকান্তন।
‘এখন বাংলাদেশ থেকে মহারাষ্ট্র সরকার রেমডেসিভির আমদানি করতে চাইলে তাদের সিডিএসসিও-তে নানা নথিপত্র দিয়ে আবেদন করতে হবে। ওই সংস্থা তখন বাংলাদেশি কোম্পানির ওষুধের নমুনা, গুণগত মান, উপাদান সব পরীক্ষা করে দেখবে। শুধু এন্ড প্রোডাক্টটাই নয়, তার সাপ্লাই চেইনে কোন জিনিস কোথা থেকে আসছে সেসবও খতিয়ে দেখা হবে। স্বভাবতই এটা সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া।’, বলছিলেন মুরলী নীলকান্তন।
মুরলী নীলকান্তন
ফলে মহারাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশি কোম্পানি থেকে জরুরি ভিত্তিতে রেমডেসিভির কিনতে চাইলেও তাতে বেশ কিছু ‘আইনি ও প্রক্রিয়াগত হার্ডল (বাধা)’ আছে বলেই ভারতে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
তবে মহারাষ্ট্র সরকার এখনও বাংলাদেশ থেকে এই ওষুধটি আমদানির সিদ্ধান্তে অনড়।
রাজ্যের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, রেমডেসিভির মহারাষ্ট্রের করোনা রোগীদের কাজে আসতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন – আর সে কারণেই সরকার দ্রুত বাংলাদেশ থেকে সেই ওষুধটি সংগ্রহ করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য যে ‘হার্ডল’গুলো আছে সেটাও দূর করার কাজ চলছে ঝড়ের গতিতে।