বনানী বাবলি : আমাদের তখন কিশোরবেলা, সদ্য পড়ে বোঝার চেষ্টা করছি শরৎচন্দ্রের দেবদাস। কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছি পারুর দুঃখে। নিষিদ্ধ ফলের মতো আমরা বন্ধুরা ইস্কুল পালিয়ে শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েট ছবি প্রেক্ষাগৃহে দেখে শোকে আত্মহারা হচ্ছি। আর প্রতিজ্ঞা করছি আমরা বড়ো হলে জুলিয়েট হবো, লাইলী হবো, শিরি হবো। স্বপ্নগুলি কুঁড়ি হয়ে ফুটে রইলো অজান্তে মনের আকাশে।

এরই মধ্যে আমরা কলেজের আঙিনা রাঙিয়ে দিলাম উচ্ছল তারুণ্যে। গান, কবিতা, দেয়াল পত্রিকা। আমরা কলেজের সীমানাতে রং ছড়ালাম উচ্ছল নবীন তারুণ্যে। বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বাৎসরিক বনভোজনের প্রস্তুতি এবং শহর থেকে দূরে হারিয়ে যাওয়া। উচ্ছাস ও অফুরন্ত আনন্দের সেই দিনগুলিতে সহপাঠী বন্ধুর সংখ্যা বেড়ে গেলো অনেক । নিষ্পাপ আনন্দ মুখর সেই দিনগুলিতে ভুলেই গেলাম রোমিও – জুলিয়েট, লাইলী-মজনু ও শিরি-ফরহাদকে। আমাদের আলাপের বিষয়বস্তুর ক্ষেত্র বেড়ে গেলো অনেক গুণে। আমরা সদ্য তরুণ তরুণীরা স্বপ্ন দেখছি দেশকে ভালোবাসার, প্রকৃতিকে ভালোবাসার, দেশের মানুষকে ভালোবাসার। প্রশ্ন জাগছে শ্রেণী বৈষম্যে আর রাজনীতিবিদদের চাটুকারিতায়, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে মনকে আমরা তৈরী করছি সম্মিলিতভাবে।

আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো বিশাল পরিবেশে নিজেদের হারালাম চিরতরে। পরিচয় হলো আরো অন্যান্য বাংলাদেশের জেলা থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের সাথে। চট্টগ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরত্বের কারণে শামসুন নাহার আবাসিক হলে থেকে জানলাম আরো গভীরভাবে মেয়েদের সুখ-দুঃখ, তাদের আপন ভুবন এবং তাদের পৃথিবীটা জানতে চেষ্টা করছিলাম। এরই মধ্যে অনেকে তাদের রোমিওকে খুঁজে পেলো, আবার আমাদের অনেকে সামাজিক বিপ্লব ঘটালো ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মজনুকে জীবনসঙ্গী করে এবং পড়াশুনা, আড্ডা, মিছিল-মিটিং, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ঝিরি ঝিরি ঝর্ণা, সেই সারি সারি জারুল গাছ সবাই ধন্য হলো তাদের সান্নিধ্যে। স্বপ্ন ছিল নিজের যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মনের মানুষকে নিয়ে জীবন তরী বেয়ে যাওয়া। সমাজে আশির শেষের দশকেও মূল্যবোধের অবক্ষয় তখনো পুরোপুরি দেশকে গ্রাস করেনি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাই ছিল স্বাভাবিক। জারুল গাছের ডাল ভেঙে সেটা দিয়েই শিবির তাড়ানো হয়েছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে ওই তারুণ্যের সজীবতায়। অথবা ধরা যাক সেই যে স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামানোর পর উল্লাসে উদ্দীপনায় সারা বাংলাদেশ যখন মেতে উঠেছিল।

বিভিন্ন ধর্মীয় পালা পর্বন, একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ, বিজয় দিবস ছিল আমাদের সার্বজনীন আনন্দ উৎসব। আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে ছিল নিবিড় সম্পর্কের বিনি সুতার মালা। চাহিদা ছিল সীমিত। আমাদের সামাজিক পরিমণ্ডল ছিল স্বাভাবিক ও প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর। এই মুহূর্তে মনে হলো সেই আশির দশকের শেষ দিকের কোনো এক পহেলা বৈশাখের ওই জনসমুদ্রে, বিকেলে আমি আর আমার জীবনসাথী বাসা থেকে বের হলাম রিক্সায়, তারুণ্যের স্রোতের বহতায় কিংবা চঞ্চলতায়। স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার মৌচাক মার্কেটের ট্রাফিক জ্যামে আমাদের রিক্সা আটকে গেলো। হঠাৎ এক মায়াবী মুখের কিশোর এসে আমাকে একটা রজনীগন্ধা ফুলের স্টিক আমার হাতে দিয়ে ভিড়েই আবার উধাও হয়ে গেলো আর আমাকে রেখে গেলো মুগ্ধতায়। নববর্ষে তখন ফুল দেওয়া ছিল রেওয়াজ, পরিচিত বা অপরিচিতদের। আমি ফুলটি হাতে নিয়ে চলে গেলাম আমার কল্পনার রাজ্যে। ভাবলাম আমার মতোই কোনো এক হারানো বোন হয়তো ওর ছিল। হয়তো তার হারিয়ে যাওয়া শোলক বলার কাজলা দিদি কিংবা সেই মল্লিকা’দি, দূরের গ্রামের।

আজ বাংলাদেশের সমাজ ভিন্ন ধারায় বয়ে চলেছে। পারিবারিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক সম্পর্কের বাঁধনে শিথিলতা। যার প্রতিচ্ছবি পাই সাহিত্যে, নাটকে এবং মানুষের জীবনের গল্পে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ মহামারী আকার ধারণ করেছে। আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি। একটু সরব হই, তারপর আবার ভুলে যাই। দুর্নীতি, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সমাজের প্রতিটা স্তরে এমনকি মানুষের মনকে ধীরে ধীরে কলুষিত করে চলেছে। শিবিরের প্রতিনিধি, রাজাকাররা আজকে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে জায়গা অধিকার করছে। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় যে রাজাকার তাকেও গান স্যালুট দেয়া হচ্ছে। জাতির এ কলঙ্ক আজ কোথায় রাখবো আমরা? বার্টান্ড রাসেল বলেছিলেন, “সাইক্লোন ও দুর্ভিক্ষকবলিত আর্তমানবতাকে সযতœ সহযোগিতায় অনায়াসে রক্ষা করা যায় কিন্তু মূল্যবোধের অবক্ষয়ে নিমজ্জিত জাতিকে রক্ষা করা দুরূহ ও দুর্বিষহ ব্যাপার।”

চেয়ে চেয়ে দেখছি, হয়তো মানসিকভাবে ধর্ষণের বর্ণনাটা শুনতে বা পড়তেও রোমাঞ্চবোধ করছি আমরা অনেকে। সেদিন খবরের কাগজটা বিক্রিও হয় বেশি নির্যাতিত নারীটির বর্ণনা চিত্রের গল্পের কারণে। তাই প্রতিবাদ করুন সম্মিলিতভাবে। শুধু বাস্তবে ধর্ষণ হলে নয় – প্রতিবাদ করুন যখন গল্প, কবিতায়, চলচিত্রে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয় কল্পনা দিয়ে। কোনো পুরুষ যখন একটি মেয়েকে বলে, “তুমি সুন্দর” প্রতিবাদ করো, নারী তুমি বলো, “আমার মেধা আছে, প্রজ্ঞা আছে। একমাত্র সৌন্দর্য দিয়ে আমায় বিচার করো না, আমি নবীন গাছের সদ্য ফোঁটা কুঁড়ি নই। আমি কালো পাহাড়ের শতাব্দীর পুরানো পাথর।”
বিবস্ত্র করছে শুধু নারীকে নয়, বিবস্ত্র করছে বাংলাদেশকে। মাদক ব্যবসা, শিশু ধর্ষণ, ব্যাঙ্ক ঋণের টাকা বিদেশে পাচার, পরকীয়া, আদিবাসীদের উচ্ছেদ, সংখ্যালঘুদের ভূমি দখল এবং আরো শত শত ধরণের অন্যায় সমাজে স্রোতের মতো বয়েই চলেছে। সমাজে অন্যায়কারীরা মুখোশে ঢেকে রাখে মুখ। মুখোশধারীদের চেনে সবাই কিন্তু পারে না তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে কারণ তারা বড়ো গাছে বেঁধে রেখেছে তাদের শিকড়। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ভলগা থেকে গঙ্গা পুস্তকে উল্লেখ করেছেন, “সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন পদ্ধতি পাল্টিয়েছে, ভাষার রূপান্তর ঘটেছে, বিকশিত হয়েছে সমাজ।” যে সমাজের সভ্যতার বর্ণনা তিনি দিয়েছিলেন সেটা ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০০ সালে ভলগা নদীর তীরের। আমরা এখন বিংশ শতাব্দীতে কিন্তু এ কোন সমাজের চিত্র দেখতে পাচ্ছি? সমাজের উন্নয়ন হয় ধীরে ধীরে। সামাজিক কাঠামো বিকশিত হয় সময়ের সাথে সাথে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছি আমরা? গর্জে উঠো বাংলাদেশ। রুখে দাঁড়াও তুমি আবার একাত্তরের মতো। বায়ান্নর ভাষার লড়াইয়ের মতো। বাংলাদেশ তুমি পারো পৃথিবীকে দেখিয়ে দিতে যে, অন্যায় অবিচারকে তুমি আশ্রয় দাওনা। তুমি এক ও অভিন্ন, বাংলাদেশ। জেগে উঠো বাংলাদেশ।
বনানী বাবলি
তথ্যসূত্র : আংশিক ভাবে প্রকাশিত।
পরবর্তী লেখাগুলি প্রকাশ হয় লেখকের প্রথম প্রকাশিত পুস্তক “বাংলাদেশ তোমারই জন্য” তে।
প্রকাশক: আপন আলো, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারী ২০২১।