সাজ্জাদ আলী : ঠক্ ঠক্, ঠক্ ঠক্, শব্দে কাজের মনোযোগ উবে গেল। সাত-সকালে এ কী জ্বালাতন! কাঁচের জানালার বøাইন্ড সরিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের দিকে চাইলাম। কিন্তু শব্দের কোনো উৎস বোঝা গেলো না। অগত্যা চেয়ার ছেড়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি একটি ঝুঁটিওয়ালা কাঠঠোকরা পাইন গাছটির মোটা ডালে বসে আছে। না, ‘বসে আছে’ বলাটা ঠিক হলো না। আসলে ওটি ডাল আঁকড়ে ঝুলে আছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছে। পাখিটি দেখতে যে কী সুন্দর, কী সুন্দর! কী আর বলি! বহুরঙা পালক ওর, বর্ণিল ঠোঁট, নীলাভ লেজ! কেমন যেন একটা চঞ্চলতা আছে ওর স্বভাবে!
শক্ত পাইন গাছে কাঠঠোকরার পোক্ত ঠোঁটের আঘাতে অমন তীব্র ঠক্ ঠক্ শব্দ হচ্ছিলো। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ওর শোভা দেখছি। সামান্য উড়ে গিয়ে সে আরেকটি ডালে ঝুলে পড়লো। আধা মিনিট বাদে আবার ঠোঁট ঠুকে একই রকম শব্দমালা তৈরি করলো। খুব দ্রুত লয়ে পনেরো থেকে বিশবার সে গাছে আঘাত করছে। ফলে ছন্দবদ্ধ ওই ঠক্ ঠক্ শব্দ-তরঙ্গ তৈরি হচ্ছে।
পাখিটিকে দেখার পরে আওয়াজটি শুনতে আর বিরক্ত লাগছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি জানালায়। কাঁচ ভেদ করে ওর দিকে চেয়ে আছি। আবার কখন গাছে ঠোঁট চালাবে, সেই অপেক্ষায় আছি। লক্ষ্য করলাম, প্রতিবার ঠোকাঠুকির পরে পাখিটি খানিকক্ষণ এদিক ওদিক চায়! কী যেন খোঁজে, কাকে যেন খোঁজে! যেন কাউকে ডাকছে সে! খানিক বাদে আবার শব্দ করে, আবার খোঁজে! এক ডাল থেকে আরেক ডালে গিয়ে ঝুলে থাকে। এমনি করেই চলছিলো।
চার-পাঁচ মিনিট বাদে প্রায় একই রকম দেখতে আরেকটি কাঠঠোকরা যেন কোথা থেকে উড়ে এলো। কিন্তু সে ডালে ঝুললো না। ডানা ঝাপটে প্রথম পাখিটি থেকে দুই তিন ফুট দূরত্ব রেখে শূন্যে ভেসে রইলো খানিকক্ষণ। তখন পাখিরা একে অন্যের দিকে চেয়ে এক ধরণের গো গো রবে ডাকছিলো। সেই ডাকে বিরক্তি নয় বরং আশক্তি জানান দেয়। ওরা একে অন্যের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। সে দৃষ্টিতে রাগ নয়, যেন অনুরাগ ফুটে উঠছে।
হঠাৎ শূন্যে ভাসা কাঠঠোকরাটি ডালে ঝোলাটিকে জাপটে ধরলো। আমি ভাবলাম, ডালেরটি বোধহয় আক্রান্ত! কিন্তু না, সে নিজেকে মুক্ত করার কোনো চেষ্টাই করলো না। উল্টো যেন সেই আক্রমনে (!) সায় দিলো। অতঃপর উড়ে আসা পাখিটি কিছুক্ষণ বেপরোয়াভাবে নিজের শরীর দোলালো। তা আট-দশ সেকেন্ড সেই দোলন চললো, তার বেশি না। এর পর কাঠঠোকরারা নিজেদের ছাড়িয়ে নিলো। গাছের কাণ্ড আঁকড়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঝুলে রইলো। একটু পরপরই ওরা পরস্পরের লম্বা জিভ লেহন করে দিচ্ছিলো। দেখে মনে হলো ওরা বেশ তৃপ্ত। আমার মোটা মাথায় এতক্ষণে খেললো ব্যাপারটা। বুঝলাম যে প্রথম কাঠঠোকরাটি শব্দ করে কাকে ডাকছিলো!
এই যে ঘটনার কথা বলছি, এটি গত বছরের জুন মাসের শেষ দিকের কথা। টরন্টোতে তখন ভরা গ্রীষ্মকাল। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে একদিন বিকেলে ব্যাকইয়ার্ডে বসে কিছু একটা পড়ছিলাম। আবার সেই কাঠ ঠোকানোর শব্দ পেলাম। ভাল করে চেয়ে দেখি সেই কাঠঠোকরাদুটো পাইন গাছের কাণ্ডে গর্ত খোঁড়ার চেষ্টা করছে। গাছ তো মহা শক্ত, কিন্তু ওদের ঠোঁটও তো কম যায় না। দেখলাম ইঞ্চিদুয়েক খুঁড়ে ফেলেছে। পালা করে কাঠ ঠুকছে। একজন ঠোকে তো আরেকজন কাছেই বিশ্রাম করে।
নানা কাজের চাপে সপ্তাহ তিনেক ব্যাকইয়ার্ডে যাওয়া হয়নি। কাঠঠোকরাদের কথাও আর মনে আসেনি। সে দিন সকালে বাসা থেকে বের হবো। তো গাড়িতে চড়বো বলে ড্রাইভওয়ে ধরে হেঁটে এগুচ্ছি। দেখি সেই কাঠঠোকরাদের একটি আমার গাড়ির ছাদে লাফালাফি করছে। মনে হয় ছাদে পড়ে থাকা বুনো ব্লাকবেরির ফল টোকাচ্ছে। আমাকে দেখে ফুরুৎ করে ব্যাইয়ার্ডের দিকে উড়ে গেল। আমিও যাত্রায় বিরতি টেনে ওর পিছু নিলাম। গিয়ে দেখি সেই পাইনগাছের কাণ্ডে পাখিরা ঝুলে আছে। পিটপিট চোখে আমাকে দেখছে। চমৎকার দুটো গর্ত খুঁড়েছে গাছে। বেশ বোঝা গেল, গাছ ফুটো করে ভেতরে ওরা বাসা বানিয়েছে।
আরেক দিনের কথা। আমাদের ব্যাকইয়ার্ডে একটা দেশী জাতের লাউগাছ লাগিয়েছি। পাতায় পাতায় মাচা ভরে উঠেছে। ফুল আসে, কিন্তু ফলের দেখা নেই। মাঝেমধ্যে সেই বাজা গাছে আমি জল দেই। সেদিন জলের পাইপের মুখ খুলে দিয়ে কাঠঠোকরাদের বাসার দিকে চেয়ে আছি। দেখি গর্তদুটোর মুখে খড়ের আগা বেরিয়ে আছে। একটু বাদে লক্ষ্য করলাম, খড়গুলো একে একে গর্তের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। বুঝলাম, কাঠঠোকরারা বাসার মধ্যে খড় জড় করছে। আগত শীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গাছের মধ্যে বাসা, তার মধ্যে খড়ের আস্তরণ। ভাবছিলাম এই খড়ের ওম কী পাখিদের প্রচণ্ড ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে?
আগষ্ট মাসের শেষ দিকে আমাদের লাউগাছটির বন্ধাত্ব ঘুচলো। উত্তর দিকের ডগায় একটি লাউ দেখা দিলো। তা নিয়ে তো বিপুল আনন্দ আমার। প্রতিদিন সে লাউ একটু একটু করে লম্বা হয়, মোটাও হয়। সকাল বিকাল তা ফিতা দিয়ে মাপ দেই। সপ্তাহ দেড়েকের মধ্যে নয় ইঞ্চির মতো লম্বা আর সাত ইঞ্চির কাছাকাছি মোটা হলো। ওই লাউয়ের টানে ব্যাকইয়ার্ডে আসাটা এখন নিয়মিত। দিনে দু’বার করে লাউগাছে জল দেই।
একদিন বিকালে লাউয়ের ব্যাড় মাপছি। এমন সময় বাচ্চা পাখির চ্যাও চ্যাও ডাক কানে এলো। শব্দটি অনেকটা কান্নার মতো শোনালো। চোখ চলে গেল কাঠঠোকরাদের বাসার ডালে। ও মা গো মা, চেয়ে দেখি দুই গর্তে দুটি বাচ্চা কাঠঠোকরা ঠোঁট বের করে কাঁদছে। একি কাণ্ড? এরা কবে এলো? গত কিছু দিন লাউয়ের দিকে মনটা এমনই ঝুঁকে ছিলো যে কাঠঠোকরার বাসার দিকে ফিরেও তাকাইনি। বাচ্চা দুটো নিশ্চয়ই ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। ওদের মা বাবারা হয়তো পর্যাপ্ত খাবারের জোগাড় করতে পারছে না। ওদের জন্য মনটা কেঁদে উঠলো!
পরদিন সকালে পৌর অফিস খুলতেই “বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ” বিভাগে ফোন করে জেনে নিলাম যে কাঠঠোকরারা কী খায়। সব কাজ ফেলে প্যাটশপে গিয়ে (প্রাণীদের খাবারের দোকান) ঝুরো বাদাম আর ব্লাকবেরির বিচি কিনে আনলাম।
বার্ড ফিডারে (পাখিদের খাওয়ানোর পাত্র বিশেষ) খাবারগুলো রেখে তা পাইন গাছের গোড়ায় বেঁধে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটো কাঠঠোকরা বার্ড ফিডারের এসে ঝুললো।
আরো সপ্তাহদুয়েক পরের কথা, বাচ্চাদুটো বেশ বড় হয়েছে। উড়ে বেড়ায় ওরা। এখন চারটি পাখিই বার্ড ফিডারে খাবার নিতে আসে। এদিকে আমাদের গাছের লাউটি এখন পরিণত। কিন্তু তাকে কাটা যাচ্ছে না। এ নিয়ে বাড়িতে কলহ বেঁধেছে। আমি চাইছি লাউটি কেটে খাওয়া হোক। আর অন্যপক্ষ চাইছেন তা বেছন রাখতে। আগামী বছর নাকি এ লাউয়ের বিচি দিয়ে শত শত লাউ জন্মানো হবে।
বরাবরের মতোই প্রতিপক্ষের জয় হলো। লাউটি খাওয়া হবে না, বেছনই থাকবে। যুবক লাউ ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হবার দিকে এগুচ্ছে। কিন্তু বিধি বাম! একদিন দুষ্টু এক কাঁঠবিড়ালী গোড়া থেকে লাউটির বোঁটা কেটে দিলো। আধোবৃদ্ধ লাউ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো! সব দোষ চাপলো আমার ঘাড়ে। আমিই নাকি লাউটি কেটে মাটিতে ফেলে রেখেছি! হায় রে কপাল!
যাই হোক, তখন অক্টোবরের শেষ, বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। রাতে তাপমাত্রা মাইনাস ৫/৭ ডিগ্রীতে নেমে যায়। একদিন লক্ষ্য করে দেখি কাঠঠোকরাদের বাসার দুটি গর্তের মুখই খড় দিয়ে ঘেরা। শীতের বিরুদ্ধে ওরা ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এই তীব্র ঠাণ্ডা আর বরফ থেকে খড়ের সামান্য আস্তরণ কী আর পাখিদের বাঁচাতে পারবে? মনটা বেদনাতুর হলো। ওদের জন্য আমি কিই বা করতে পারি? সেপ্টেম্বরের পরে কাঠঠোকরাদের আর বাইরে বেরুতে দেখিনি।
গেল বছর ডিসেম্বরের শুরুতেই টরন্টোতে ভীষণ বরফ ঝড় হলো। আমাদের মরা লাউ গাছটি তো জমে হাঁড়। ছোটবড় সব গাছগাছালির কাণ্ড ও ডালে বরফের প্রলেপ জমে উঠলো। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ১০ ডিগ্রী বা তারও নিচে রইলো। এই ক’মাস কাঠঠোকরাদের বাসার গর্ত-মুখ বরফের পুরু আস্তরণে ঢাকা থাকলো। এ অবস্থায় ওদের তো মরে শক্ত হয়ে যাওয়ারই কথা।
মাঝেমধ্যেই আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ওদের বাসার দিকে চেয়ে থাকি। আর মনে মনে বরফকে গালিগালাজ করি। সেই যে পড়েছে, তা আর গলার নামটি নেই। সব থেকে কষ্ট পাই বাচ্চা পাখিদুটির কথা মনে হলেই। মাত্র দু-আড়াই মাস বয়সেই ওদের জীবনের ফুরুৎ ফারুৎ শেষ হয়ে গেল! একটা গ্রীষ্মও পেলো না ওরা। যৌবনের জ্বালা, না উঠলো না জুড়ালো।
এ বছরের এপ্রিল মাস শুরু হয়েছে। হিম্ ঠাণ্ডার আবহটা কেটেছে। টরন্টোতে এখন বসন্তকাল। হিমাঙ্কের ওপরে তাপমাত্রা। প্রকৃতি থেকে বরফের সব চিহ্ন গলে জল হয়েছে। আর ক’দিন বাদেই গাছে গাছে নতুন পাতা গজাবে। সবুজে সবুজে ভরে উঠবে চারিদিক। কয়েক সপ্তাহ হলো কাঠঠোকরাদের কথা আর মনে আসে নি।
গতকাল সকালে হোম অফিসে বসে এক মনে একটা চিঠি টাইপ করছিলাম। হঠাৎ সেই ঠক্ ঠক্ শব্দ ভেসে এলো। তড়িৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাইন গাছটিতে কিছুই দেখতে পেলাম না। এক ছুটে ব্যাক ইয়ার্ডে পৌঁছলাম। কাঠঠোকরাদের বাসার গর্ত-মুখ স্পষ্টই চোখে পড়লো। এখন আর তা বরফে ঢাকা না। পাইন গাছের ডালগুলিতে কোনো কাঠঠোকরা দেখা গেল না। একটু বাদেই পশ্চিম দিকের ম্যাপল গাছটি থেকে ঠক্ ঠক্ শব্দ এলো। চেয়ে দেখি সেই তিনটি কাঠঠোকরা গাছের কাণ্ডে ঝুলে আছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আরেকটি এসে ঝুললো।
ওরা তাহলে বেঁচে আছে! বরফে জমে মরে নি! ওদের দেখতে পেয়ে আমার যে কী আনন্দ, কী আনন্দ! তা কী করে বোঝাই আপনাদের!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডার নির্বাহী)