মনিস রফিক : কানাডার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো নিজের জন্ম, বেড়ে উঠা আর কানাডার নেতৃত্বে আসার অসাধারণ কিছু ঘটনা উপস্থাপন করেছেন তাঁর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এ। জাস্টিন ট্রুডোর সাবলীল আর অসম্ভব সুন্দর বর্ণনা খুব সহজেই পাঠকের সামনে উম্মোচিত করে কানাডার রাজনীতি, সংস্কৃতি আর স্বপ্নকে। ইংরেজি ভাষায় লিখিত গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মনিস রফিক। ‘বাংলা কাগজ’ এ ‘কমন গ্রাউন্ড’ এর অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

উনিশ.
এই সময়েই আমি আমার জীবনের প্রথম সত্যিকারের ভালো লাগা গার্লফ্রেন্ডের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছিলাম। আমরা ব্রেবফ এর পেছন দিকে যাওয়া শুরু করলাম এবং আমরা দুজনই আমাদের সেই পুরানো বন্ধু বান্ধবদের সাথে তখনো আড্ডা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। নতুন কারো সাথে পরিচয় বা কথাবার্তা হলে যদি তাদের সামনে আমার নামের শেষ অংশটা উচ্চারণ করার প্রয়োজন না পরতো এবং আমাকে ‘ট্রুডো’র ছেলে না ভেবে যখন তারা আমার সাথে সাধারণ একজনের মত ব্যবহার করতো, সেটা দেখে আমি এক ধরনের প্রশান্তি পেতাম। আমি স্বীকার করছি, মাঝে মাঝেই কারো সাথে প্রথম পরিচয়ে আমি ইচ্ছা করেই আমার নামের শেষ অংশটা পরিহার করতাম। আমি কখনোও তাদেরকে ‘ট্রুডো’ শব্দটা শুনাতাম না যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি আমার নিজের স্বকীয় ব্যক্তিত্বে তাদের ওপর আমার প্রতি সত্যিকারের মুগ্ধতা না আনতে পারতাম।

মাঝে মধ্যে আমার আবার নামের বিষয়টা নিয়ে আমাকে একটু এদিক সেদিক করতে হতো। আমার গার্লফ্রেন্ড কনকর্ডিয়ায় পড়তো, আর আমি যদিও ম্যাকগিল এ পড়তাম কিন্তু তাদের ডিবেটিং ক্লাবের সদস্য সংগ্রহের রাতে আমি তার সাথে ওখানে ছিলাম। সেই রাতে আমরা এক তর্কে মেতেছিলাম। আমাদের তর্কের বিষয় ছিল, সিটি অলিম্পিক স্টেডিয়াম গুড়িয়ে ফেলা উচিত কি না, এবং কুইবেক থেকে নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের ব্রিজ তৈরীতে কি ধরনের মালমশলা ব্যবহার করা উচিত। যখন আমার বলার পালা এলো তখন আমি আমার নাম জেসন ট্রেম্বলে বলে শুরু করলাম। আমি খুব রোমাঞ্চিত বোধ করছিলাম, কেউ আমাকে চিনতো না। আমি জানতাম, নিজের আসল নাম লুকিয়ে নিজেকে উপস্থাপিত করায় ওখানে আমাকে কোনো ধরনের অস্বস্থিকর অবস্থায় পড়তে হবে না, কারণ আমিতো কনকর্ডিয়ার হয়ে কোনো বিতর্কে অংশ নিবো না। ফলে আমার সাবলীল ভংগিতে আমার যেভাবে বলা উচিত আমি সেভাবেই বলা শুরু করলাম। সেই কক্ষের সবার কাছেই আমি ছিলাম সম্পূর্ণ এক অপরিচিত একজন আর আমার সম্পর্কে কেউ কিছুই জানতো না। সম্ভবত আমার সেই ধরনের কোনো চাপ না থাকায় আমি সেদিন খুব ভালোই বলেছিলাম। আমি সবাইকে আমার যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চাইছিলাম, ব্রিজ করার ধারণাটা সত্যিই চমত্কার, আমি বলে যাচ্ছিলাম, যেহেতু সরাসরি ‘বেলে আইল’ এর পানির প্রবাহকে বাধা দিলে সেটা উত্তর আটলান্টিকের উপসাগর এর স্রোতকে কানাডার দিকে প্রবাহিত করতে সাহায্য করবে, যা আমাদের পূর্ব উপক‚লে ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়া এনে দিবে। আমি অন্যদের দাবী খণ্ডন করে জোর দিয়ে বলেছিলাম, ‘বিষয়টা তোমরা একটু ভালোভাবে ভেবে দেখো,’ আবার আমি সবার উদ্দ্যেশে জোর দিয়ে বলেছিলাম, ‘আমাদের নোভা স্কোশিয়ার অলিভের কথাও ভাবতে হবে!’

আমাদের সেই বিতর্ক শেষে আয়োজকরা আমাকে বিতর্ক দলে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমি একটু নীরবেই মাথাটা ঝুঁকিয়ে শুধু বলেছিলাম, ‘আমিতো কনকর্ডিয়ার দলে যেতে পারছিনা’। তখন আমি স্বীকার করার ভংগিতে বলেছিলাম, ‘এতক্ষণ যা হলো সেটা যাই হোক না কেনো, আমার নাম কিন্তু জেসন ট্রেম্বলে নয়।’ আমি কখনোই আমার আসল পরিচয় লুকাতাম না, কিন্তু কিছু মুহূর্তের জন্য নিজের পরিচয় থেকে এই ধরনের পালিয়ে থাকাটা খুবই চমত্কার এক ব্যাপার ছিল।

আমার জীবনে আমি শুধু একবারই আমার নকল নাম ব্যবহার করেছিলাম। ব্যাপারটা কয়েক বছর পরে ঘটেছিল যখন ক্লাব দ্য বক্সে চ্যাম্পিয়ন এর পূর্ব প্রান্তের একেবারে শেষেরটায় আমি বক্সিং শুরু করেছিলাম। ওটা ছিল সত্যিকারের কোনো এক বক্সিং জিম যেখানে বক্সিং শেখার এক চমত্কার পরিবেশ ছিল। জিমটা ছিল কিন্তু খুব কঠিন নিয়ম কানুনের জায়গা, যেখানে আমি আমার বক্সিং যোগ্যতা না দেখিয়ে শুধুমাত্র প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে একটা জায়গা করে নিতে পারবো, এমন কিছু ভাবার অবকাশ ছিল না। সেই কারণে সেখানে যোগ দেবার সময় আমি আমার নাম ব্যবহারে একটু বুদ্ধি খাটিয়েছিলাম। আমি আমার মা’য়ের নামের একটা অংশ ব্যবহার করে আমার নাম রেখেছিলাম, জাস্টিন সেন্ট ক্লেয়ার। আসলে আমি প্রথম থেকেই আমার কাজ ও আমার দক্ষতায় সবার কাছে পরিচিত হতে চেয়েছিলাম, কখনোই আমার পিতা-মাতার পরিচয়ে নয়।

প্রায় এক বছর পর আমার কোচ সিলভেইন গ্যাগনন আমার আসল নামটা জেনে গিয়েছিলেন, কিন্তু ততদিনে আমি নিজেকে সেই জিম এর একজন খুব ভালো সদস্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিলাম আর বক্সিং রিং এ আমি ভালোই করছিলাম। ফলে নামের বিষয়টা তখন আর কোনো ব্যাপারই ছিল না। এবং সত্যি বলতে কি, আমি আসলে আমাকে ওভাবেই দেখতে চাইতাম। প্রথমে মানুষজন আমাকেই জানুক বা চিনুক, আর এর পরে আমার নামের শেষ অংশটা জানলেও সেটা কোনো ব্যাপার ছিল না।

বক্সার জাস্টিন ট্রুডো

মাঝে মধ্যেই মানুষজন আমার নামের শেষ অংশের জন্য আমার প্রতি আকর্ষিত হতো এবং বিশেষ সুবিধার চিন্তা মাথায় রেখে বা কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই আমার সামাজিক গণ্ডির সাথে এক হতে চেষ্টা করতো। বিগত বছরগুলোতে সেই বিষয়টা মাথায় রেখেই আমার যেভাবে চলা উচিত বলে ভাবতাম, আমি সেভাবেই তাদের সাথে আমার ব্যবহার চালিয়ে যেতাম। এ ব্যাপারে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আজও আমাকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে।
আমার নামের জন্য আমার প্রতি অন্যদের ব্যবহার বা আগ্রহ ভালো বা খারাপ যায় হোক না কেনো, আমার কখনো ভালো লাগে না যখন কেউ শুধু আমার নামের জন্য বিতর্কে কি বলবো বা বক্সিং রিং কেমন পারদর্শিতা দেখাবো তার একটা পূর্ব ধারণা নিয়ে ফেলে। যে কোনো ক্ষেত্রেই সেটা হোক না কেনো, যেমন আমার প্রতিপক্ষ আমাকে বক্সিং এ মেরে একেবারে বিধ্বস্ত করার চিন্তা করুক বা আমাকে একটু সমীহের চোখে দেখুক। আমি স্বাভাবিকভাবেই সেই বিষয়টায় শিখেছিলাম, সব ক্ষেত্রেই আমাকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। আমি যে কোনো সামাজিক পরিবেশে যার সাথেই মিশেছি, আমি সব সময় চেষ্টা করেছি আমার স্বকীয় ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যে তাদের সাথে মিশতে, যাতে আমার নাম ব্যবহার করে আমি তাদের প্রতি যেনো কোনো রকম প্রভাব খাটানোর কোনো রকম চেষ্টা না করি বা আমার নাম জানার পূর্বে তারা আমাকে যেভাবে ভেবেছে, আমার নাম জানার পর তাদের সেই ধারণার যেনো কোনো রকম পরিবর্তন না ঘটে।

অবশ্যই এই ‘ট্রুডো’ নামের এই চাপ বা বিড়ম্বনাটা শুধু আমাকেই মোকাবেলা করতে হয়নি, ঠিক আমার মত আমার দুই ভাইকেও এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। তবে আমাদের তিন জনের ব্যক্তিত্বের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের জন্য এবং বাবার সম্পর্কের ধরন অনুযায়ী আমরা ব্যাপারটা আমাদের মত করে দেখতাম। শাসার ব্যক্তিত্বে ছিল বাবার বুদ্ধিমত্তা আর নিয়ম শৃংখলার কঠোরতা, সেজন্য সে সব সময় এ ব্যাপারে নিজেকে অন্যদের থেকে সরিয়ে রাখতো আর তার নিজস্বতায় কারো হস্তক্ষেপ কখনো করতে দিত না। অন্যদিকে মিশেল ছিল একেবারে আলাদা। সে কখনোই তার জীবনে বাবার প্রভাব মানতে পারতো না এবং একেবারেই সেই পরিচয় ছাড়াই সে নিজের জীবন চালাতে চাইতো। গ্রাজুয়েট হবার পূর্বে মাইক তার প্রথম সামার ক্যাম্প এর জন্য গিয়েছিল পূর্বের ডালহৌসী’তে এবং শেষ পর্যন্ত সে পশ্চিম’কেই তার ঘর বানিয়েছিল। আমি ছিলাম এ দুজনের মাঝামাঝি। আমার ‘ট্রুডো’ পরিচয় আমার কাছে ছিল আমার এক বড় গর্বের বিষয়, কিন্তু আমি সব সময় চাইতাম আমি যেনো আমার নিজের গুণ ও প্রতিভায় সবার কাছে পরিচিত হতে পারি, আমি সব সময় এমন একজন, যে সব সময় তার আবেগের ধরণ আর বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে তার বাবার থেকে আলাদাভাবে দাঁড়াতে চেয়েছে।

একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে, যেখানে আমার পারিবারিক নামটা আমার কাছে কৌতুকপূর্ণ আর পরাবাস্তবিকতায় ধরা দিয়েছিল। প্যারিসে আমার এক ভ্রমণের সময় ব্যাপারটা ঘটেছিল, বুলভার্ড সেন্ট-মিশেল এ এক আমেরিকান অধ্যাপকের সাথে আমার কথা হচ্ছিল। অধ্যাপনা থেকে অবসরে যাওয়া সেই অধ্যাপক ইতোমধ্যে রবার্ট ফ্রস্ট এর কবিতা ফরাসীতে অনুবাদ করে খুব নামডাক করেছিলেন। তিনি খুবই চমত্কার এক মানুষ ছিলেন। আমি যখন তাঁকে জানিয়েছিলাম যে আমি কানাডা থেকে এসেছি, তখন তিনি খুবই আগ্রহ নিয়ে আমাকে বলতে লাগলেন, ‘সত্তর দশকে তোমাদের দেশে এক চমত্কার সুন্দর প্রধানমন্ত্রী ছিল, তাঁর খুব সুন্দর বউ ছিল যে তাঁকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।’

আমি তাঁকে অন্যভাবে কিছু না বলে শুধু বলেছিলাম, ‘আপনি কি আমার মা’কে বুঝাচ্ছেন?’
আরেকটা মনে রাখার মত ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯২ সালে, যখন ইউকুন ও উত্তর ব্রিটিশ কলম্বিয়ার তাতসেনশিনী নদীতে বাবার সাথে আট দিনের এক নৌকা ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সেই ভ্রমণের মূল কারণ ছিল সেই অঞ্চলের তামার খনি পরিবেশে যে ভয়ংকর বিরূপ প্রভাব ফেলছে সে ব্যাপারে সচেতনতা তৈরী করা।

বাইকার জাস্টিন ট্রুডো!

বাবা আর আমার দেখা হবার কথা ছিলো হোয়াইটহর্সে। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী আমার নিজের মত করে দেখার জন্য আমি কয়েক দিন আগেই সেখানে গিয়ে পৌঁছেছিলাম। আমার সামাজিকভাবে সবার সাথে মেলামেশার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ফলে গ্রীস্মের মটর সাইকেল র?্যালীর এক দলের সাথে খুব দ্রুতই আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তারা সত্যিই খুব সুন্দর ভালো মনের ছিল, কিন্তু তাদেরকে দেখে মনে হচ্ছিল খুবই কঠিন ও বেপরোয়া ধরনের। তাদের চাল চলন দেখে মনে হচ্ছিল তারা শুধুমাত্র আনন্দের জন্য অবলীলায় দুই চাকায় চড়ে খোলা আকাশের নীচে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারে। আমি বিগ জন নামে এক বাইকার এর সাথে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম। পিটসবার্গ এ তার হারলে-ডেভিডসন এর ডিলারশীপ ছিল। আমি বিগ জন আর তার বন্ধুদের আমার নামের শেষ অংশটা বলিনি। আমার মনে হয়েছিল, আমেরিকান হিসেবে, এই নামটা তারা নাও জানতে পারে বা এমন বিষয় তাদের কাছে আমলে আনার মত বিশেষ কোনো বিষয়ও নয়।
আমার বাবা কয়েক দিন পর সেই শহরে এসেছিলেন। যখন আমরা দুজন হোয়াইটহর্সের একটা মানুষে গিজগিজ করা এক শুড়িখানায় ঢুকছিলাম, তখনই দূরের এক কোনা থেকে ভরাট ঝাঁঝালো কণ্ঠ আমার কানে এলো, ‘অই, তুমি ! তোমার মত কাউকে তো আমরা এখানে কখনো প্রত্যাশা করি না।’ দেখলাম, বিগ জন তার টেবিল থেকে মিছেমিছি রাগের ভংগিতে আমার দিকে তেড়ে আসছে। এই অবস্থায় আমার বাবা একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি ভেবেই বসেছিলেন যে, সে আমাদের অপমান করার জন্য কথা শুনাতে আসছে, অথবা আরো খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। বাবার এটাও মনে হয়েছিল, সে তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়ের কোনো ভোটার, বাবা সেই সময় তার প্রত্যাশিত মত কাজ না করায় সে বাবাকে এক হাত দেখিয়ে দিতে আসছে।

আমি বাবাকে বিগ জন আর তার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম, এবং যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে বিগ জন আসলে আমার দিকে তাকিয়ে ওভাবে কথা বলেছে তখন তিনি ব্যাপারটা খুবই হাসির সাথে নিলেন। তিনি এ ধরনের মানুষদের সাথে খুব ভালোভাবে মিশে যেতে পারতেন।

যখন আমরা বাড়িতে ফিরেছিলাম, বাবা আমার মাকে আমাদের ভ্রমণের সব কিছু বিস্তারিতভাবে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি কি জানো, আমি কখনো ভাবতেই পারিনি যে মানুষের সাথে জাস্টিনের সম্পর্ক এতো ভালো!’
(চলবে…)
মনিস রফিক ঃ চলচ্চিত্রকর্মী, টরন্টো, কানাডা