ড: বাহারুল হক : (১)
আমরা সবাই প্যারোলে আছি। কেউ মুক্ত বা স্বাধীন নই। প্যারোলে আছি বলে ডেইলি পাঁচ বার হাজিরা দিতে হয়। হাজিরা দিয়ে নিজের অবস্থা জানান দিতে হয়। প্রতি বার বলতে হয়, “তুমি আমাদেরকে চালিত করো সঠিক পথে, তাদের পথে যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছ”। যা ইচ্ছা তা করার, যা ইচ্ছা তা বলার, যা ইচ্ছা তা দেখার, যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাওয়ার কোন অনুমতি নাই। এই ব্যবস্থার কোন বিকল্প নাই; এর বিরুদ্ধে আপিল করারও কোন সুযোগ নাই। কারণ যিনি এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন তার উপরে কেউ নাই। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বময়, সর্বেসর্বা, সর্বকালীন, সর্বদর্শী, সর্বনিয়ন্তা, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বজ্ঞ, এবং সর্বোত্তম।
(২)
নির্দেশ ২টি: (১) কায়েম / পালন কর (২) বর্জন করো।
কায়েম করো: নামায । বর্জন করো: মিথ্যা বলা।
নামায কায়েম করা বিষয়ে বিকল্প আছে। স্বাভাবিকভাবে না পারলে বসে, বসে না পারলে শুয়ে, শুয়ে না পারলে ইঙ্গিতে। মিথ্যা বলা বিষয়ে কোন বিকল্প নাই; বর্জন করতেই হবে এবং শতভাগ। কোথাও বলা হয়নি- আচ্ছা ঠিক আছে, একেবারে ছাড়তে না পারলে কম কম বলিও বা আচ্ছা ঠিক আছে, মা-বাবার সাথে বলিও না বা আচ্ছা ঠিক আছে, জুমার দিন (শুক্রবার) বলিও না।
পালন করো: হজ্ব। বর্জন করো: ঘুষ খাওয়া।
হজ্ব করা বিষয়ে বিকল্প আছে। তুমি নিজে যেতে না পারলে অন্য কাউকে পাঠাও তোমার পক্ষ থেকে। ঘুষ খাওয়া বিষয়ে কোন বিকল্প নাই। বর্জন করতেই হবে এবং শতভাগ। কোথাও বলা হয়নি- আচ্ছা ঠিক আছে, খাও, তবে বেশি না; একটা লিমিটের মধ্যে থাকিও বা আচ্ছা ঠিক আছে, খাও তবে আত্মিয়-স্বজনদেরকে ছাড় দিও। আমরা ‘করো’ বিষয়ে সিরিয়াস, কিন্তু ‘বর্জন করো’ বিষয়ে একেবারে উদাসিন। কেন?
(৩)
ছোট বেলায় মা- কে যে কি যন্ত্রণা দিয়েছি! পিঠা দিলে বলতাম- খাবো না, গোল হয় নাই কেন? ডিম দিলে বলতাম- খাবো না, কুশুম ভাঙ্গা কেন? মাছ দিলে বলতাম- খাবো না, এই মাছে ডিম নাই কেন? মাংস দিলে বলতাম- খাবো না, এটাতো রানের মাংস নয়। গভীর রাতে ঘুম থেকে জাগলে বলতাম – ঘুমাবো না, সেমাই খাবো। এই রকম করা ছিল আমার স্বভাব। এ জন্য মা, আব্বা, বা দাদু কেউ কখনো রাগ করেছেন, বকা দিয়েছেন, এ রকম কিছু মনে পড়ছে না। মানুষ দেখি সন্তানদের কড়া শাসনে রাখে; অন্যদেরকে শিখায়- আস্কারা দেবেন না, উচ্ছন্নে যাবে। কারো মুখে এরকম শুনলে অমনি আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।
(৪)
প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় রচিত ছোট গল্প ‘ফুলের মুল্য’ পড়েন নি এমন বাঙালী কম। ঐ গল্পে লেখক ইংরেজ বালিকা ম্যাগির সৌন্দর্য বোধের পরিচয় তুলে ধরতে ম্যাগির সাথে তার একদিন বিকালে কিছু পথ হাঁটার একটা ঘটনা বলেছেন। একটা গন্তব্যে পৌঁছতে দুজনে হাঁটছিলেন। এক পর্যায়ে লেখক ম্যাগিকে বললেন- “চল আমরা এ পথ দিয়ে ঋই যাই, তাহলে কম পথ হেঁটে কম সময় ব্যয় করে গন্তব্যে পৌঁছে যাব”। ম্যাগি রাজি হলেন না লেখকের প্রস্তাবে। ম্যাগি বললো- “না, এই পথটা নোংরা। আমি এই পথে হাঁটি না”। লেখক ম্যাগির কথা শুনে লজ্জা পেলেন এবং তার সৌন্দর্যবোধ যে ম্যাগির মত প্রখর নয় সেটা ভালোভাবে অনুভব করলেন। সেদিন আমার অবস্থাও প্রভাত কুমারের মত হয়েছিল। স্ত্রী সহ ট্রেনে উঠলাম। আমি তিন চেয়ারের একটা সিটে বসতে চাইলাম কিন্তু আমার স্ত্রীর আপত্তিতে আর বসা হলো না। শেষে আমরা দুই চেয়ারের একটা সিটে বসলাম। বসে আমি আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলাম ওখানে না বসার কারন কী? স্ত্রী বললেন- “সেগুলো লম্বা সিট এবং মাঝে মাঝে আমি দেখি ছেঁড়া অত্যান্ত নোংরা কাপড় পরা অসুস্থ বা মাতাল লোক ওরকম সিটে শুয়ে আছে। আমি তাই লম্বা সিট গুলোতে বসি না। এগুলো দুই চেয়ারের সিট, লম্বা নয়। ফলে এগুলোতে কারো শোয়ার কোন সুযোগ নাই এবং ট্রেনে আমি এ রকম সিটে বসি”। আমি আর কী বলবো? প্রভাত কুমারও সেদিন লন্ডনে ম্যাগিকে কিছু বলতে পারেন নাই।
(৫)
তাকে চিনি না। তার নাম ও জানি না। টরন্টোর হাই পার্কে দেখা। সেটাই প্রথম এবং সেটাই শেষ দেখা। কিছুক্ষণের পরিচয়, দেখা ও কথা বলা। ঢাকা কিছুদিন থেকে কিছু বাংলা শিখেছে। তবে সবচেয়ে বেশি শিখেছে ভদ্রতা। সে জন্যই আমাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে নি আমি হিন্দু না মুসলিম। একেবারে বিদায় নেয়ার সময় বললো- আমি কী এখন স্লামালাইকুম বলবো নাকি বলবো নমস্কার? ওর প্রশ্নটা শুনেই বুঝলাম ও জানতে চায় আমি হিন্দু নাকি মুসলিম। অথচ জানার কৌশলটা কি চমৎকার, পরিশুদ্ধ, নির্মল!! ভারতে শিক্ষিত ভদ্র হিন্দুরা প্রথমেই জেনে নিত আমার ভালো নাম। বিনয় সহকারে প্রশ্ন করতো- ইউর গুড নেম , প্লিজ? মে আই আস্ক ইউর গুড নেম প্লিজ? মে আই আস্ক ইউর নেম, স্যার? আসলে জেনে নিত আমি হিন্দু না মুসলিম। শেষে আমি দুষ্টামী করে পিকিউলিয়ার একটা নাম বলতাম। আমার নাম জানতে চাইলে বলতাম- মাইহান রাওফুন বসুনিয়া। নামটা তৈরী করেছি তিন জনের নাম দিয়ে। ১ম খন্ড এসেছে ভাগিনা মিহান- এর নাম থেকে; ২য় খন্ড এনেছি ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরসিমা রাও থেকে; শেষ খন্ড এনেছি ছাত্র নেতা বসুনিয়া থেকে। তিন খন্ড একত্র করে বানিয়েছি আজব এক নাম- মাইহান রাওফুন বসুনিয়া। কারো বাপের সাধ্য নাই নামটা শুনে আমার ধর্ম বুঝে।
(৬)
নরওয়েজিয়ানদের কাছে ‘সাসপেনশন’ একটি অতি পরিচিত শব্দ। এটা মুলতঃ একটা পলিসির নাম। ক্ষুধার্ত কিন্তু কিনে খেতে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য হোটেল-রেষ্টুরেন্টে খাবারের দাম অগ্রিম পরিশোধ করে রাখাকে বলে ‘সাসপেনশন’। কেউ ডিনার প্যাকেট নিল ৬টি, দাম দিল ৮টির। ‘সাসপেনশন’ হলো ২ প্যাকেট। এখন দুর্দশাগ্রস্থ কেই এসে ‘ডিনার সাসপেনশন’ আছে কিনা জানতে চাইলে তাকে ১ প্যাকেট দিয়ে দেয়া হবে। ‘সাসপেনশন কফি’র ছ্ড়াছড়ি সর্বত্র। কেউ ১ টা কফি খেলে দেখা গেল ২টা কফি ‘সাসপেনশন’ দিয়ে রেখেছে। ১০ট কফি নিজেরা খেল, কিন্তু ৬টা রাখলো ‘সাসপেনশন’। ঠান্ডার দেশ, তাই কফিতে তাদের চুমুক সর্বদা। দাতা গ্রহিতা সবাই সবার কাছে অপরিচিত। কেউ কাউকে দেখে না। কি মহত্ব, কি উদারতা! আমি একদিন এক রেষ্টুরেন্টে গেলাম কফি খেতে। ক্যাশের মেয়েটা আমার থেকে দাম নিতে চায়না। টাকা সাধলে সে বলে- ‘তোমাকে দাম দিতে হবে না’। বুঝলাম, আমি সাসপেনশনে পড়েছি। আমি মৃদু হেসে বললাম- ‘তুমি দাম রাখ। আমার কাছে টাকা আছে। তুমি বরং যে দাম দিতে পারবে না তাকে দিও’। ভাবলাম এই সাসপেনশন পলিসি কি বাংলাদেশে চালু করা যায়? উত্তর আমার কাছে পেলাম। না চালু করা যায় না। কেন যায়না তা ব্যাখ্যা করার কী কোন দরকার আছে?
(৭)
বিশ্ববিদ্যালয়ে চুরির মত ঘটনা ঘটেনি একথা বলার কোন উপায় নাই। ঘটেছে এবং অনেক। কিন্তু আমার রুমের ঘটনা মনে পড়লে মনে হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় একান্তভাবে সৎ মানুষের একট দেশ যেখানে কোন চোর নাই। সম্ভবত ২০০৪ এর ঘটনা। আমার টেবিলের উপর লাখ টাকা দামের ক্যামেরা। আমি রুমের দরজা বন্ধ না করে বৃহস্পতিবার রাতে বাসায় চলে এসেছি। শুক্রবার শনিবার ছুটির দিন। রবিবার সকালে রুমে গিয়ে দেখি রুম খোলা এবং সে সাথে টেবিলের উপর ক্যামেরাটাও পড়ে আছে। যদি চুরি হতো তাহলে এ ক্যামেরা নিজের টাকা দিয়ে কিনে ডিপার্টমেন্টকে দিতে হতো। কারণ, ওটা ছিল ডিপার্টমেন্টের ক্যামেরা। এ ঘটনার পর আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (মাত্র একজন ব্যতিরেকে), কর্মকর্তা, কর্মচারী, ছাত্র, ছাত্রীরা নয় শুধু এলাকার চোররাও আমার ব্যাপারে বেদরদী হয় না।