ডঃ বাহারুল হক : *** সুখ নিরবচ্ছিন্ন এমনটা ভাবার কোন কারণ নাই। কখন যে মনের চালে দুঃখের বৃষ্টি ঝুম ঝুমাইয়া পড়তে শুরু করবে কেউ জানে না।
——মোটবী
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কিছুদিন ফেনী নদীর পারে দুর্গম এক জনপদ মোটবীতে ছিলাম। বর্ষাকাল। রাস্তা বলতে একটা কাঁচা রাস্তা। সে রাস্তার মাটি ভয়ানক পিচ্ছিল; ফলে রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটা মুসকিল। মুহুর্তে মুহুর্তে পা পিছলে দড়াম করে পড়ে যাওয়ার সমুহ সম্ভাবনা। রাস্তা আর বাড়ি ঘর ছাড়া সবই পানিতে ডুবা। পানি কোথাও হাঁটু পর্যন্ত কোথাও পানির গভীরতা আর একটু বেশি। সে পানিতে ডুবে আছে সদ্য কাটা ধানের নারা। নারা থাকাতে আর পানির শ্রোত না থাকায় সে সব নারা হয়ে গেল জোঁকের প্রজনন স্থল। জোঁকে জোঁকে জোঁকারণ্য।
মোটবীতে শরণার্থী হিসেবে শুধু আমরা যে ছিলাম তা নয় আরও অনেক পরিবার ছিল। শরণার্থীরা মোটবীতে হিন্দু বাড়িগুলোতেই আশ্রয় নিয়েছিল, কারণ হিন্দুরা ভারতে চলে যাওয়াতে ওদের বাড়ি ঘর খালি পড়ে ছিল। পাকিস্তানী সৈন্য আর রাজাকারদের চলাচল আছে সেরকম এলাকার লোকজনই নিজেদের বাড়ি ঘর ছেড়ে শরণার্থী হয়েছে মোটবীর মত দুর্গম জনপদগুলোতে। অন্যদের মত আমরাও ছিলাম মোটবীতে এক হিন্দু বাড়িতে। এখানে বলে রাখি, ফেনী থেকে ডাঃ আতাউর রহমানও আমাদের মত শরণার্থী হয়ে মোটবী এসেছেন। থাকেন আমাদের বাড়ি থেকে দুরে এক বাড়িতে। তিনি সেখানে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করে সে সময় মানুষের সেবা করেছেন।
৫২ বছর পর গত ডিসেম্বরে আমেরিকা প্রবাসী আমার ভাই তার ফিল্ম ডাইরেক্টর (হলিউড) ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিল মোটবী। সেই ঘর সেই বাড়ি সেই পুকুর সেই রাস্তা সবই আছে। তার ফিল্ম ডাইরেক্টর ছেলে শুটিং করেছে সেখানে। ’৭১-এর পর আমি আর কোন দিন যাইনি মোটবী। অথচ আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনার একটি ঘটেছে এই মোটবীতে। আগেই বলেছি তখন ছিল বর্ষা কাল। আমার ১৪ বছর বয়সী ছোট ভাই কামাল এসেছে আমাদেরকে দেখতে। মাগরিবের নামাযের ওয়াক্ত শেষ হয়েছে।সুর্যের শেষ আলোটুকুও আর নেই। চারি দিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। এই অন্ধকারের মধ্যে দেখি কামাল খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ির উঠানে। হিন্দু বাড়িতে ঢুকার ঠিক আগে রাস্তায় সামুকের উপর পা পড়ায় কামালের পায়ের তালু মাঝখানে মারাত্মক ভাবে কেটে যায়। প্রবল ধারায় রক্ত পড়ছে। কাপড় দিয়ে পা বেঁধেও রক্ত পড়া বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমি আর আমার মা অস্থির; কি করা যাবে- রক্ত পড়াতো বন্ধ করা যাচ্ছে না। রক্ত এভাবে পড়লেতো সে শিগ্র রক্ত শূণ্য হবে, তাকে বাঁচানো যাবে না। তাকে ডাঃ আতাউর রহমানের কাছে নিতে হবে। তার পা সেলাই করতে হবে। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কেমন করে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। অন্ধকার রাত, গ্রাম্য পিচ্ছিল মাটির রাস্তাটা ছাড়া রাস্তার দুই পাশের সব পানির নিচে। পানিতে সাপ আর জোঁক। রাস্তা দিয়া হাঁটলে ডাক্তারের বাড়ি অনেক দুর। কিন্তু পানি, সাপ, জোঁক ভরা কিত্তা দিয়া কোনাকোনি হাঁটলে পথ কম হবে; দেড় দুই কিলোমিটারের বেশি হবে না। কামালের পক্ষে তো হাঁটা সম্ভব না। সে সময় কামালের বয়স ১৪ বছর। তার ওজনও কম নয়। আমি তার ৪ বছরের বড়। আমার বয়স ১৮ বছর। বসে বসে ভাববার সময় কোথায়? তাড়া তাড়ি সিদ্ধান্ত নিলাম- আমার ভাই, ভাইকেতো মরে যেতে দিতে পারি না। যত কষ্ট হোক যত ভারি হোক আমার ভাইকে আমি নেব, আমি আনবো। যেহেতু কামাল ওজনে ভারি এবং তাড়াতাড়ি নিতে হবে তাকে ডাক্তারের কাছে তাই রাস্তা দিয়ে না গিয়ে পানি ভেঙ্গে কোনাকোনি যাব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। পরিকল্পনা করলাম – কামাল তার পা দুটো আমার বুকের উপর ঝুলিয়ে আমার কাঁধে বসবে। তাকে কাঁধে নিয়ে আমি হাঁটবো। হেঁটে হেঁটে যাব এবং হেঁটে হেঁটে আবার ফিরে আসবো। এবার আমি আমার লুঙ্গিতে গোছ মারলাম। জোঁকে যাতে না ধরে সে জন্য পায়ের তলা থেকে রান পর্যন্ত কেরোসিন মাখলাম। তারপর কামালকে কাঁধে নিলাম। কামালকে কাঁধে বসিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। অন্ধকার রাত কিছু ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় তাকে কাঁধে নিয়া পানি ভেঙ্গে হাঁটতে থাকলাম ডাক্তারের বাড়ির দিকে। পৌঁছে গেলাম ডাক্তারের বাড়ীতে। কামালকে শোয়ানো হলো। তারপর ডাক্তার পা সেলাই করে দিলেন। আবার তাকে কাঁধে নিয়া আগের মত অন্ধকারে পানি ভেঙ্গে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম। সে রাতের কথা মনে পড়লে আমি বিহব্বল হয়ে যাই। আবার খুশিও হই এই মনে করে যে সেদিন সে অবস্থায় আমি আমার ভাইয়ের সঠিক চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে পেরেছি। পরে আমার দুলাভাই এই ঘটনা শুনে অবাক। দুলাভাইর এক কথা- বাহার, তুমি কামালকে কাঁধে নিয়ে কিভাবে ডাক্তারের কাছে গেলে আসলে? আসলে প্রয়োজনে বুকের মধ্যে আপনা আপনি শক্তি উৎপাদিত হয় এবং মনের সে শক্তি আপনা আপনি দেহে সঞ্চারিত হয়। মনটাই আসল।
*** এখানে এসে ইএপি (ইংলিশ ফর একাডেমিক পারপাসেস)- এর উপর একটা কোর্স করেছিলাম। শিক্ষক ছিলেন মিসেস মার্ক ফরটিন। তিনি একবার হুম ওয়ার্ক দিলেন। লিখে জমা দিলাম। তিনি দেখলেন সবার লেখা। ক্লাসে এসে তিনি তার মার্কস-মন্তব্য সহ লেখা ফেরত দিলেন। আমাকে ভালো মার্কস দিলেন, কিন্তু খাতার উপর বড় করে মোটা কলমে লিখে দিলেন ‘কিস’। আমিতো এমন মন্তব্য জীবনে দেখি নাই, শুনি নাই। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ইনজিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের এক প্রফেসরকেও সে কোর্সে সহপাঠি হসেবে পেয়েছিলাম। তিনি আমার খাতাটা নিলেন, লেখাটা পড়লেন তারপর হেসে বললেন- আপনার খাতার যে চেহারা তাতে কিস না দিয়ে পারা যায়? ক্লাস শেষে গেলাম মিসেস মার্ক ফরটিন এর কাছে। আমার প্রশ্নের উত্তরে মিসেস মার্ক বললেন- এটা একটা এক্রোনেম। বাক্যের প্রত্যেক শব্দের প্রথম অক্ষর নিয়ে হয়েছে কিস আর বাক্যটি হলো- “কিপ ইট শর্ট এন্ড সিম্পল’। আমার লিখতে কোন অসুবিধা হয় না। যে কোন কিছু নিয়ে আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যেতে পারি। এরপর থেকে মিসেস মার্কের জন্য লিখতে পুর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করেছি। তাকে আর কোন দিন আমার খাতায় কিস লিখতে হয়নি। ওটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম এবং শেষ কিস।
**** হাম্বার একটা নদীর নাম। সে কালে কানাডার লেঃ গভর্ণর ইংল্যান্ডের হাম্বার বে- এর নাম স্মরণে এনে এ নদীর নাম রাখেন হাম্বার। উৎপত্তি স্থল থেকে প্রায় ১০০ কিঃ মিঃ দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এ নদী পতিত হয়েছে লেক অন্টারিওতে। টরন্টো সিটি কতৃপক্ষ নদীর মোহনায় তৈরি করেছে একটি অতি সুন্দর সাসপেনশন ব্রিজ, হাম্বার ব্রিজ। তৈরি করেছে একটা পার্ক, কাসিমির জোস্কি পার্ক। হাম্বার টরন্টোনিয়ানদের অতি প্রিয় এক নদী। তাইতো হাম্বারের নামে আছে হাম্বার কলেজ, হাম্বার রিভার হসপিটাল, হাম্বার লাইব্রেরী, হাম্বার রিয়াল এস্টেট, আরো কত কি! হাম্বার কলেজে একটা এডুকেশন প্রোগ্রাম আছে ‘হাম্বার রিয়াল এস্টেট এডুকেশন প্রোগ্রাম’। এ প্রোগ্রামের উপর ভিত্তি করে যে সার্টিফিকেট দেয়া হয় তার নাম ‘হাম্বার রিয়াল এষ্টেট সার্টিফিকেট’।
*** স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড কথা বলার মানুষগুলো সমাজে কম-বেশি অপ্রিয়। কারণ এভাবে কথা বলে বিধায় মানুষ এদের মধ্যে প্রচলিত ‘এটিক্যাট’ ‘ম্যানার’ এসবের ঘাটতি দেখে আর যাদের মধ্যে ‘এটিক্যাট’ ‘ম্যানারে’র ঘাটতি দেখা যায় অন্যদের কাছে প্রিয় হওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। স্থান কাল পাত্র এসব বিবেচনা করা কথা বলতে হয়। স্থান কাল এবং পাত্র যদি অনুমোদন না করে তাহলে উচিত কথা বলতে যাওয়া ঠিক নয়। সময় সুযোগ হলে অন্য একদিন বলা যাবে তাও বলতে হবে ভদ্রভাবে সুন্দরভাবে; কর্কষ ভাষায় অপ্রিয় ভঙ্গীতে এখনই বলতে হবে কেন? সমাজ উচিত কথা বলতে যেমন উৎসাহিত করে তার চেয়ে বেশি উৎসাহিত করে নম্র হয়ে ভদ্রভাবে ইতিবাচক ভঙ্গীতে কথা বলতে।
*** আমার মা অটোয়া (কানাডা) আসলেন আমার ভাইয়ের বাসায়। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আমার বাসায়। অটোয়া পৌঁছার ২ সপ্তাহ পর একদিন মাকে বললাম- “তুমি কি পান খাও”? মা বললো- “হাঁ, খাইতো”। আমি বললাম- “অটোয়ায় পান আছে”? মা বললো- “কত পান! পানের কোন অভাব নাই। মানিক কে বললেই সে নিয়া আসে”। আমি বললাম- “পান যে খাও মানিকের কত টাকা যায় জান? সেখানে একটা পানের দাম ৫০ টাকা। ২টার দাম ১০০ টাকা”। মা শুনে অবাক; তারপর বললো- “অমা, আমিতো জানি না পানের যে এত দাম। এত টাকা দিয়া পান খাওনের কি দরকার”! বুঝলাম মা এবার পান ছাড়বে। বুঝে আমি খুব খুশি হলাম। কারণ পান ছাড়তে দেশের ডাক্তার বহু বার বলেছে কিন্তু মা পান ছাড়ে না। এবার যদি ছাড়ে! ছেলের টাকা যাচ্ছে দেখে এবার মা পান ছাড়ার পাকা সিদ্ধান্ত নিলেন।মা ছেলেকে ডেকে বললো- “পান আর আনিও না। এদেশের পান স্বাদ নাই। কষ কষ লাগে। পান আমি আর খাবো না”। আসলে কষ মষ স্বাদ টাদ কিছু না। ছেলের টাকা খরচ হচ্ছে দেখে মা পান ছেড়ে দিলেন।
*** প্রফেসর ডঃ শ্রীনিবাস কীষাণরাও সাইদাপুর, আমার শিক্ষক, যার অসীম আন্তরিক তত্বাবধানে চলেছিল পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের লক্ষ্যে আমার সকল গবেষণা কার্যক্রম। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত ভারতীয় শিক্ষকদের জন্য সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস পুরস্কার, শান্তি স্বরুপ ভাটনগর (এস এস ভাটনগর পুরস্কার) পুরস্কার প্রাপ্ত কর্ণাটক বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র প্রফেসর। পরে তিনি কর্ণাটক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের পদও অলংকৃত করেছিলেন। স্যার আমার পরিচয় দিতে গেলে মুখে হাসি টেনে বলতেন- “আমার বাঙালী ছাত্র”। একদিন আমি বললাম- “আমি খেয়াল করেছি, আমার পরিচয় দিতে গেলে তুমি আমার বাঙালী পরিচয়টা তুলে ধরে বেশ আনন্দ পাও, কেন”? উত্তরে স্যার বলেছিলেন – “তুমি জান না? সর্ব ভারতীয় জন গোষ্ঠি জানে বাঙালীরা অত্যান্ত মেধাবি এবং দুরদর্শী। তাই তোমাকে ছাত্র হিসেবে পেয়ে আমি খুব খুশি, কারণ তুমি বাঙালী। স্যারের সে দিনের কথায় আমার মধ্যে বাঙালী হিসেবে নতুন এক বোধের জন্ম হলো। স্যারের অত্যান্ত ঘনিষ্ট বন্ধু প্রফেসর নিয়োগী একদিন আমার পিঠ চাপড়ে বললেন- তুমি সাইদাপুরের জন্য সৌভাগ্য বয়ে এনেছ। তুমি জয়েন করার পর সাইদাপুর ভাটনগর এওয়ার্ড পেল। প্রসংগক্রমে বলে রাখি কর্ণাটক বিশ্ববিদ্যালয় একটি পোষ্ট গ্র্যাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়; এর বিপুল সংখ্যক রিসার্স স্কলারের মধ্যে বাঙালী ছিল শুধু একজন, এই বাহারুল হক।