খুরশীদ শাম্মী : ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহরে ধরা পড়ে করোনাভাইরাস। তবে বিষয়টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার চায়না অফিস প্রথম অবগত হয় ৩১ ডিসেম্বরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিষয়টি অবগত হওয়ার আগেই সে এক থেকে দুই, দুই থেকে চার, চার থেকে আট—এভাবে বংশবৃদ্ধি শুরু করে দেয়।
হ্যাঁ, করোনাভাইরাস নিয়ে বলছিলাম, করোনাভাইরাস সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অবগত হওয়ার আগেই বংশবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এক-পা, দুপা করে যাত্রাও শুরু করে দেয় এবং তা অব্যাহত রাখে। পায়ে হাঁটা তো আর খুব সহজ কাজ নয়! খামোখা ঘাম না ঝরিয়ে সে মানুষের দেহকে ব্যবহার করে বাহক হিসেবে। কোনো পরিশ্রম ছাড়াই সে এক দেহ থেকে অন্য দেহ, এক পরিবার থেকে একাধিক পরিবার, এক শহর থেকে ভিন্ন শহরে যাতায়াত করে। শুধু চলাচলের মধ্যে থাকলে তো ক্ষতি ছিল না। সে শুরু করে মাস্তানি। তার আক্রমণে দুর্বল, রোগা মানুষগুলো জ্বরে কেঁপে কেঁপে ওঠে, বেইমান ভাইরাস ঘর বাঁধে মানুষের গলা, বায়ু চলাচলের পথ ও ফুসফুসে। তারপর তারা ফুসফুস দখল করে কারখানা বানিয়ে ফেলে রাতারাতি। মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধক শ্বেত রক্তকণিকাগুলো ঢাল-তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ চালায়। কিন্তু সবক্ষেত্রে তারা জয়ী হতে পারে না। হেরে যায় বেইমান ভাইরাসের কাছে। মানুষ মৃত্যুকে বরণ করে নেয়। জানুয়ারি থেকেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা চলে রাতদিন গবেষণাগারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চালিয়ে যায় আলোচনা। ২০২০ সালের জানুয়ারির প্রথম তৃতীয়াংশে চায়না ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল নববর্ষ আয়োজন নিয়ে। কিন্তু তত দিনে ভাইরাসটি কোনো অর্থ ব্যয় ছাড়াই উঠে বসে উড়োজাহাজে। ছড়িয়ে পড়ে সে এক দেশ থেকে ভিন্ন দেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ১৩ জানুয়ারি চায়নার বাইরে থাইল্যান্ডে প্রথম ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। ২২-২৩ জানুয়ারি তারা নিশ্চিত করে যে ভাইরাসটি জাপান, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মহামারি আকার ধারণ করেছে। চায়না তাদের দুই সপ্তাহ থেকে মাসব্যাপী নববর্ষ আয়োজন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
২৮ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয় যে চিকিৎসা ও প্রতিরোধক ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বিশ্বের অভিজ্ঞজনেরা চীনে এসে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে এখানকার প্রতিলিপিগুলো বুঝে নেবে এবং একত্রে কাজ করবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে এই প্রাদুর্ভাব রোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হয়। তখন থেকেই শুধু চীনে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে যাচ্ছেন। নিশ্চিত করে কিছু আবিষ্কৃত হয়নি এখনো। তবে আশাবাদী আমি আশায় বুক বেঁধে আছি, চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের চেষ্টা এবারও ব্যর্থ হবে না।
ওদিকে, করোনাভাইরাসের পেছনে ফিরে দেখার সময় নেই একটুও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৈঠক, আলোচনা, পরামর্শ, চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রম, লাখো মানুষের জীবন—কোনো কিছুর জন্যই তার মায়া কিংবা ভয় হয় না; বরং তার চলার গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয় দিন দিন। ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে ফেব্রুয়ারিতেই তারা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ভ্রমণ শুরু করেছে। বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
করোনাভাইরাসের গতি ও শক্তির চাপে ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯কে বিশ্বব্যাপী মহামারি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। তারপর থেকে বিশ্বের অনেক দেশেই হাসপাতাল, ক্লিনিক, খুব জরুরি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানপাট ও অফিস ব্যতীত সাধারণ অফিস–আদালত, দোকানপাট, স্কুল-কলেজসহ সবকিছু বন্ধ রাখা হচ্ছে। তবু কমছে না আক্রান্তের সংখ্যা কিংবা মৃত্যুর সংখ্যা; বরং প্রায় প্রতিদিনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশের তালিকায় যোগ হচ্ছে নতুন কোনো দেশ।
এই লেখা লেখার সময় পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যায় ইতালি ও স্পেন প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে এখন ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সব থেকে বেশি এবং মৃত্যু সংখ্যায় তৃতীয় স্থানে। ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে সেখানে এক লাখ থেকে দুই লাখ চল্লিশ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এখনই যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে রোগীদের নিয়ে। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কসহ অনেক রাষ্ট্রে নির্মিত হচ্ছে অস্থায়ী হাসপাতাল। মৃতদেহ রাখার জন্য তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত শিপিং কনটেইনার ব্যবহার করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় কানাডার অবস্থা এখনো কিছুটা ভালো। তবে মানুষের ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষামূলক উপকরণ সহজলভ্য না হলে এবং জনগণ নিয়ম মেনে না চললে তা যেকোনো সময় ভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে কানাডার শুধু অন্টারিও প্রদেশে ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার লোক মারা যেতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন অন্টারিওর প্রিমিয়ার ডাগ ফোর্ড ও স্বাস্থ্য বিভাগ। শুধু এপ্রিল মাসেই অন্টারিওতে প্রায় ১ হাজার ৬০০ মানুষ মারা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ফেসবুকের নিউজফিডে ভেসে ভেসে আসে খুব পরিচিত মানুষদের হাসপাতালে ভর্তির খবর, মৃত্যুর খবর। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যদি এই অবস্থা হয়, তখন চিন্তায় প্রাণের দেশ বাংলাদেশের নাম এলে ঘুম হারাম হয়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে দ্বিগুণ হয়।
এমনিতেই যখন দেশের কথা ভাবলে দম বন্ধ হয়ে আসে, তখন শত শত গার্মেন্টস শ্রমিকের কাজের তাগিদে গ্রাম ছেড়ে দল বেঁধে হেঁটে এবং ট্রাকে করে ঢাকায় আসার দৃশ্য খুব নিরাশ ও আহত করে তোলে। এ জন্য অবশ্য পোশাক ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাসহ ব্যবস্থাপনা–সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তার অপরিকল্পিত নির্দেশনার সমালোচনা করি। জরুরি প্রয়োজনে পিপিই তৈরির জন্য গার্মেন্টস খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা হওয়া উচিত ছিল পেশাদারি ঘোষণার মাধ্যমে। আমি মনে করি, যেখানে বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে, সেখানে তাঁরা ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটির ঘোষণা আগেই দিতে পারতেন। জানা যায়, অনেক শ্রমিক তাঁদের বর্ধিত ছুটির খবর জেনেছেন ৫ এপ্রিল কাজে যাওয়ার পর। এমন ঘটনা বিজিএমইএর নিম্নমানের ব্যবস্থাপনা প্রমাণ করে।
হ্যাঁ, বিজিএমইএ সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে, শ্রমিকদের ব্যাপারে তাদের গাফিলতি প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ জনগণের অবহেলাকে গ্রহণ করব কীভাবে? এখনো শুনছি, বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে ছুটিতে মানুষ মামাবাড়ি, নানাবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে। মসজিদে নামাজ পড়তে যাচ্ছে। তাবলিগে যাচ্ছে।
এটাই সত্যি, বাংলাদেশের লাখো মানুষ এখনো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে না। জনসংখ্যা ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করছে না। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করছে না। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাব্যবস্থার কথা ভাবছে না। তারা অপেক্ষা করছে, নিজের চোখে আরও একটু বিস্তারিত দেখার জন্য। তারা ধারণাই করতে পারছে না যে এই ভাইরাস খুব মারমুখী, ধ্বংসাত্মক। একজনের ভুলের কারণে উজাড় হয়ে যেতে পারে একটা পরিবার, একটা গ্রামের অধিকাংশ। দেশের জনগণের কাছে অনুরোধ, দয়া করে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ঘরে থাকুন। ভাইরাস না ছড়াতে যা যা করণীয়, তা মেনে চলুন। দেখুন, আমাদের (প্রবাসীদের) শিকড়টা এখনো বাংলাদেশেই গাঁথা। আমরা ফিরে এসে আপনাদের সবাইকে সুস্থ দেখতে চাই। আমাদের রক্ত, নাড়ি ও প্রাণের বন্ধনগুলো আমাদের ভাবায় প্রতিটি মুহূর্তে।
শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে আমাদের সবার আপনজনেরা। প্রযুক্তির বদৌলতে সব দেশের খবরাখবর পাই প্রতি মুহূর্তে। ভাবনাগুলো সে জন্যই স্তূপ হতে থাকে। মনের দুয়ারে কড়া নাড়ে, এযাত্রা কি বেঁচে থাকতে পারব আমি, তুমি, সে, আপনি, আমরা? প্রিয়জনের সঙ্গে হবে তো আবার দেখা?
খুরশীদ শাম্মী, টরন্টো, অন্টারিও, কানাডা