হাসান গোর্কি : “মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়- প্রেম নয়- কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!”
(বোধ, জীবনানন্দ দাশ )
আমরা সবাই মাঝে মাঝেই জলের মতো ঘুরে ঘুরে নিজের সাথে কথা বলি। আমার এক ছাত্রীর কাছে শুনেছি, সে ছোটবেলায় গ্রামে নানাবাড়ি বেড়াতে গেলে গাছদের সাথে কথা বলতো। চলে আসার সময় প্রত্যেক গাছকে আলাদা করে বলতো, “এই আম গাছ আমি চলে যাচ্ছি। এই জাম গাছ আমি চলে যাচ্ছি। কোন মন খারাপ নেই। আমি আবার আসবো।” এখন সে কোপেনহেগেনে থাকে।

ইউনিভার্সিটিতে যাওয়া আসার পথে বাসার কাছে কয়েকটা বার্চ আর ওক গাছের সাথে একা একা কথা বলে। জার্মান মনোবিজ্ঞানী উইলহেম ওয়ান্ড্ট (মূলত পদার্থবিজ্ঞানী, দার্শনিক) মনে করেন মানুষের এই আচরণের মূলে রয়েছে অজ্ঞাত নিয়ে অমীমাংসিত হতাশা (আনসলভড ফ্রাস্ট্রেশন কনসারনিং দ্য মিস্ট্রি)।

এই মহাবিশ্বের মহা-কর্মযজ্ঞ কীভাবে এবং কবে শুরু হলো সেটা আমাদের সবার জানতে ইচ্ছা করে। প্রথম প্রশ্নটা হলো, সময়ের শুরু কবে? বিজ্ঞানীদের ধারণা, বিগ ব্যাং থেকে টাইম এবং স্পেসের শুরু। এর আগে ছিল ‘সিঙ্গুলারিটি’ যা আমাদের বোধের অতীত। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ল, আমার একমাত্র সন্তান গোর্কি শিশুকালে আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতো, “আকাশের শেষ কোথায়?” আমি বলতাম, “আকাশের কোন শেষ নেই।” তাতে সে সন্তুষ্ট হতো না। কোন কিছু চিন্তা করার সময় সে বাসার ফ্লোরে ঘুরপাক খেতো; সোজা হাঁটত না। সে একদিন ‘অমীমাংসিত হতাশা’ থেকে বাঁচার সমাধান বের করে ফেললো- “পাপা, সবগুলো গ্যালাক্সি পার হবার পর ডায়মন্ডের একটা দেয়াল আছে। সেটা দুই কিলোমিটার পুরু। এটা একটা ফুটবলের মতো। সব গ্যালাক্সি তার মধ্যে আছে। এর বাইরে কি আছে সেটা জানা যাবে না।” সে ডায়মন্ডের দেয়াল দিয়ে অসীমতাকে ঢেকে দিতে চাচ্ছে, যাতে প্রান্তহীন ঐ অকুল চিন্তার অত্যাচার থেকে বাঁচা যায়। আমার মনে হলো ‘সিঙ্গুলারিটি’র ধারণা আর এই ডায়মন্ডের দেয়ালের মধ্যে খুব মিল আছে। বিজ্ঞানীরা টাইম এবং স্পেসের অসীমতার ভালো ব্যাখ্যা দিতে না পেরে ‘সিঙ্গুলারিটি’র দেয়াল তুলে গোর্কির মতো আপাত সন্তুষ্ট আছেন। আইনস্টাইনের মতো কেউ এসে হয়তো ভবিষ্যতে এসবের ভাল সমাধান দেবেন।

প্রথমে সময়ের কথা বলা যাক। সময়ের কি শুরু ছিল? আইনস্টাইনের ভাষায় সময় হলো একটা বিভ্রম। এর কোন অগ্র-পশ্চাৎ নেই। ফলে এর শুরু থাকা- না থাকার অর্থ একই। ধরা যাক, আমাকে একটা কক্ষে রেখে বাইরে থেকে দরজা জানালা সীল করে দেওয়া হলো। ভেতরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। আমাকে এমন একটা কিছু খাইয়ে দেওয়া হয়েছে যে এক বছর আমার খাওয়া-দাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস, ঘুম, গোসল, শরীরের রক্ত চলাচল, কিছুরই দরকার হবে না। প্রথম দিকে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও কিছুদিনের মধ্যে আমি সময়ের হিসাবটা ভুলে যাবো। কারণ আমি সূর্য দেখি না; অথবা এমন কোন ঘটনা দেখিনা যা নির্দিষ্ট সময় পর পর ঘটছে। দিনে তিনবার খেতে হলে তা দিয়েও সময় গণনার একটা সুযোগ থাকতো। শ্বাস নিলেও বুঝতে পারতাম সময় বয়ে যাচ্ছে। সেসব কিছুই নেই। আমার মনে হবে সবকিছু থেমে আছে। তবে সময় যে বয়ে যাচ্ছে সেটা আমি অনুমান করবো আমার আগের মুক্ত জীবনের অভিজ্ঞতা ধার করে। কিন্তু জন্মগ্রহণের পর থেকে আমি যদি এই ঘরটাতেই থাকতাম তাহলে সময় বিষয়ে আমার ধারণা তৈরি হতো না। দ্বিতীয় আর একটা চিত্র কল্পনা করা যাক- আবির্ভূত বা উদ্ভূত হবার পর থেকে আমরা পৃথিবী পৃষ্ঠে পাথর খণ্ডের মতো বসে আছি। সূর্যটা যেখানে আছে সেখানেই স্থির। বায়ু আছে, প্রবাহ নেই। বৃক্ষরাও পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বড় হয় না; তাদের পাতা ঝরে না। বৃষ্টিপাত, ঝড়-ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ¡াস, ভূমিকম্প নেই। ধরে নেওয়া যাক জৈবিক কোন বৈশিষ্ট্য না থাকলেও আমাদের চেতনা কাজ করে। তখন কি আমাদের কাছে সময় বলে কিছু থাকবে? না। কারণ সময়ের ধারণা আমাদের মধ্যে তৈরি হয় সচলতা থেকে। স্টিফেন হকিং মনে করেন সময়ের তীর চলে বিশ্লিষ্টতার দিকে। অন্য কথায় পদার্থের বিশ্লিষ্টতার ধরণ ও ধারাবাহিকতা থেকে আমরা সময়ের দৈর্ঘ্য মাপি। একটা ট্রেন যখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যায় তখন এই সচলতার দৈর্ঘ্য ও ধরণ থেকে আমরা ধারণা করি সময় বয়ে যাচ্ছে।

বিগ ব্যাং এর পর থেকে সময় (বা সময় নামক বিভ্রান্তির) শুরু।, সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর, এডিংটনরা মনে করেন টাইম এবং স্পেস স্থানে অসীম। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর!” কোন কিছু কি স্থানে অসীম হওয়া সম্ভব? হ্যাঁ, সেটা সম্ভব। একিলিসের সাথে কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার কথাটা ভাবুন। অথবা ভাবুন এক থেকে দুই এর গাণিতিক দূরত্বের কথা (সম্রাট ও পেয়াদার গল্প, প্রান্তরে তেপান্তরে-৪)। এ দুটি ক্ষেত্রে আমরা সময় ও দূরত্বের অসীম সংখ্যক মান পাই। তার মানে যাকে আমরা সীমা ভাবছি সেটাও অসীম। একটা পরমাণুকেও তাত্তি¡কভাবে অসীম সংখ্যক ভাগে ভাগ করা যায়। এর এক হাজার ভাগের এক ভাগের মান যদি ১ ধরা হয় তাহলে এই প্রত্যেক ভাগের এক হাজার ভাগের এক ভাগের মান হবে ০.০০১। এই ইউনিটকে আবার এক হাজার ভাগে ভাগ করলে প্রত্যেক ভাগের মান হবে ০.০০০০০১। এভাবে ভাগ করতে থাকলে মান কমতে থাকবে; কিন্তু অসীম সংখ্যক বার ভাগ করলেও মান শূন্য হবে না।

সময়ের অগ্র-পশ্চাৎ নেই কেনো? বিজ্ঞানীরা বলছেন সময়ের তল বক্র বা জিওডেসিক। একটা সহজ উদাহরণ থেকে আমরা বিষয়টা বুঝতে পারবো। ধরুন, পৃথিবীর যে কোন বিন্দু থেকে আমি সরল পথে হাঁটতে শুরু করলাম এবং শুরুর বিন্দুতে ফিরে এলাম। সেক্ষেত্রে আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না যে আমি একটা বৃত্তের ওপর দিয়ে হেঁটে এসেছি। পৃথিবীর তলের বক্রতা আমার শরীরের তুলনায় এতটা নগণ্য যে সেটা আমি অনুভব করতে পারিনি। আবার বক্র তলের যাত্রায় কোন শুরুর বিন্দু নির্বাচন করা যায় না।

ধরা যাক ভূপৃষ্ঠকে বেষ্টন করে (ছবিটিতে বৃত্তের পরিধির ওপর দিয়ে) এমন একটা রাস্তা তৈরি করা হলো যার সব অংশ দেখতে এক রকম। অ বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে অ বিন্দুতে ফেরত এলে আপনি বুঝতে পারবেন না যে এটাই আপনার যাত্রা শুরুর বিন্দু ছিল, যদি না আপনি সেখানে কোন চিহ্ন রেখে যান। ফলে আপনি বৃত্তটিকে বারবার প্রদক্ষিণ করতে থাকলে এক সময় মুল শুরুর বিন্দুটিকে আর খুঁজে পাবেন না। কিন্তু এই বৃত্তের পরিধিকে একটা সরলরেখার রূপান্তর করে অ বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে শেষ মাথায় গিয়ে যদি আপনি ফেরত আসেন তাহলে আবার অ বিন্দুতে পৌঁছাবেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আপনার যাত্রা শুরু এবং শেষের বিন্দুগুলো সুনির্দিষ্ট। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার মতো সময়ও একটা ডাইমেনশন যার তলও বক্র। তবে উচ্চতর অভিকর্ষীয় ক্ষেত্র ছাড়া সময়ের বক্রতার মান এত ক্ষুদ্র হয় যে তা অনুধাবন করা যায় না। অভিকর্ষের মান যতো বাড়বে সময়ের গতিও ততো শ্লথ হবে। যেমন কোন নক্ষত্রের আলো যদি একটা বø্যাক হোলের টানে তার দিকে ছুটে যেতে থাকে তাহলে তার সময় শ্লথ হতে থাকবে। আর ভেতরে ঢুকে গেলে ঐ আলোর কাছে সময় থেমে যাবে।

গানে-কবিতায় আমরা সময়কে বহতা নদীর সাথে তুলনা করি। তুলনাটা ভুল। সময়কে বরং একটা ফুটবল বা বাতাবি লেবুর সাথে তুলনা করা চলে, যার গায়ে হেঁটে বেড়ানো একটা পিঁপড়া শুরু আর শেষ বিন্দু খুঁজে পায় না। তাহলে সময়ের কি একটা শুরু ছিল না? থাকার সম্ভাবনা অনেকটাই, যদি সিঙ্গুলারিটির ধারণা নির্ভুল হয়। সিঙ্গুলারিটি এমন একটি বিন্দু যেখানে মহাকর্ষ বলের মান অসীম এবং ফলে সেখানে সময়ের অস্থিত্ব নেই। বিন্দুটি তাহলে কোথায় ছিল? স্থান কাল ফেব্রিকেই তো থাকার কথা! না। সংজ্ঞা অনুযায়ী বিন্দুর অবস্থিতির জন্য কোন স্থানের দরকার নেই। বিন্দুর অবস্থিতি আছে; কিন্তু দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, বেধ নেই। বিন্দুর অস্তিত্ত¡ অনেকটা ধারণার মতো। আমরা ত্রিভুজ আঁকতে তিনটি বিন্দুকে সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করি। এতে বিন্দুর ভূমিকা শুধু নির্দেশকের। আবার সময়ের শুরুর একটা বিন্দু যে থাকতেই হবে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না।

এমনও হতে পারে যে সিঙ্গুলারিটি মহাকালের মধ্যে একটা দশা। এরকম আরও দশা থেকে থাকতে পারে। বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্ব স¤প্রসারিত হচ্ছে এবং একটা সময় (বা সময়ের ধারণা) তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে আমরা বাস করছি। এরপর বিগ ক্র্যাঞ্চ (মহা সংকোচন) থেকে আবার একটা সিঙ্গুলারিটি তৈরি হবে এবং শর্ত (অসীম শক্তির পুঞ্জীভূত রূপ) পূরণ হওয়ায় আবার বিগ ব্যাং ঘটবে। তখন আর শুরুর বিন্দু খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেভাবে উপরের চিত্রের বৃত্তের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় আপনি শুরুর বিন্দু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এক একটা বিগ ব্যাং হয়তো এক একটা নতুন ও স্থানিক সময়ের জন্ম দিচ্ছে। মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে অন্য বিগ ব্যাং হয়তো অন্য স্থানিক সময়ের জন্ম দিয়ে রেখেছে। অনন্ত সময় ধরে হয়তো সেটাই ঘটে চলেছে।

তাহলে শেষের বিন্দু কোনটি? এ প্রশ্নের উত্তর উপরের অনুচ্ছেদেই আমরা পেয়েছি। মহা সংকোচনকে আমরা আমাদের জানা মহাবিশ্বের জন্য আপাত শেষ ধরতে পারি, যা নিশ্চিতভাবেই একটা নতুন শুরুর জন্ম দেবে। এর পরের বিগ ব্যাং থেকে নতুন মহাবিশ্ব তৈরি হলে তার প্রকৃতি কেমন হবে সেটা অনুমান করা যায় না। কারণ সেক্ষেত্রে প্রত্যেক বিস্ফোরণে সংখ্যাতীত সম্ভাবনার একটা করে ঘটবে।

মহাবিশ্বের শুরু আর শেষ নিয়ে তো একটা অস্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল! অথবা যে ধারণা ছিল তা আরও ঘোলাটে হয়ে গেল। (মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি বিষয়ে এই লেখাটা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। আগ্রহীরা এই লিংক থেকে পড়তে পারেন। https://roar.media/bangla/main/science/the-ultimate-fate-of-the-universe-by-jn-islam)

শিল্পীর কল্পনায় মানুষের সম্ভাব্য বিলুপ্তির ১০০ বছর পরের শহর

আপাতত এ প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া যাক এবং অল্প করে নিজেদের কথা ভাবা যাক। জীব বিজ্ঞান বলছে সকল প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে সমুদ্রে- এক কোষী প্রাণী থেকে। বিলিয়ন বছর পর তারা ধীরে ধীরে ডাঙায় উঠে এসেছে। অনেক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রাইমেট থেকে বুদ্ধিমান মানুষ এসেছে। তাদের মধ্যে আবেগ- অনুভূতি, কল্পনা- সৃষ্টিশীলতা, ঈর্ষা- ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। গুহা, গাছের ডাল বা পাহাড়ের ঢালে বাস করা আমাদের আদি পুরুষরা হয়তো ছন্দ মিলিয়ে শব্দ উচ্চারণ করতো, ভাব বিনিময় করতো, কৌতুক করতো (বানররা যেভাবে করে), জ্যোৎস্না দেখতো,বনানীর মর্মর, নদীর কলধ্বনি শুনে শান্তি পেতো। কয়েক সহস্র জেনারেশন পেছনে গেলেই এরা আমাদের পরম আত্মীয়। তাদের ধারাবাহিকতায় আমরা পৃথিবীতে আছি। কিন্তু নৃবিজ্ঞানের বইয়ে তাদের ফসিল দেখে আঁকা কোন ছবি দেখলে তাদের অন্য এক প্রাণী মনে হয়। আমার প্রপিতামহর প্রপিতামহ যে আমার খুব কাছের কেউ সেটা মনে হয় না। এরকম প্রবল ব্যস্ততা নিয়ে মানব সভ্যতা কোথাও একটা যাচ্ছে। শেষটা কেমন হতে পারে?

পৃথিবী কক্ষচ্যূত হয়ে ধ্বংস হয়ে গেলে আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাবো। সেরকম কিছু না ঘটলে আমাদের শেষের দিনগুলো খুব বিমর্ষ কাটবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা পৃথিবী আরও ৫০ কোটি বছর প্রাণের জন্য উপযোগী থাকবে। যদি সেরকম হয় তাহলে বৈরী পরিবেশের কারণে মানুষের সংখ্যা কমতে থাকবে। পুরো পৃথিবী জুড়ে মানুষ কমে এক লাখ, এক হাজার, একশ, দশ- এরকম করে শেষ মানুষটা মরে যাবে। মরে যাবার সময় শেষ মানুষটি হয়তো জানবে না যে মানুষ নামের এই প্রজাতির প্রবল প্রতিপত্তিমূলক এক বর্ণাঢ্য অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো।

প্রাণীবৈচিত্র রক্ষায় কাজ করা বেসরকারী সংস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচারের এক হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। যেমন, স্বাদুপানির অন্যতম প্রাচীন জলজ প্রাণী ইয়াংজি রিভার ডলফিনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় ২০০৬ সালে। বিলীন হওয়া পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে নামী পাখি ডোডো। এদের বাস ছিল মরিশাসে। ১৯ শতকের শেষ সময় পর্যন্ত আফ্রিকায় বাস করতো কোয়াগা। এদের শরীরের সামনের অংশ জেব্রার মত ডোরাকাটা এবং পেছনের অংশ কিছুটা ধূসর ছিল। এরাও বিলুপ্ত হয়েছে। আমরা ভাবছি প্রযুক্তি করায়ত্ত করার কারণে পৃথিবীতে টিকে থাকার ক্ষেত্রে অন্য প্রাণীর তুলনায় আমরা বেশি যোগ্য। বিষয়টা উল্টাও হতে পারে। এই কৃত্রিম জীবন প্রণালীই একসময় প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রে মানুষের যোগ্যতাকে এতোখানি দুর্বল করে দিতে পারে যে তা মানুষের বিলুপ্তির কারণ হবে।

কোন অনিরাময়যোগ্য মহামারিতে যদি পৃথিবীর সব মানুষ এখন মরে যায় তাহলে কেমন হবে? সমস্ত বিল্ডিং, বাড়ি ঘরে শ্যাওলা জমবে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোতে মরিচা পড়বে, এয়ারপোর্টগুলোতে নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকবে মরিচা ধরা এয়ারক্রাফট। বন্দরে-সমুদ্রে ভাসতে থাকবে মালবাহী জাহাজ। কল্পনা করুন, ক্রুইজ শিপের রুমগুলোতে জীবিত মানুষ নেই; কিছু কংকাল পড়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, টরোন্টর ড্যানফোর্থ, কোলকাতার গড়ের মাঠ, আমাদের গ্রামের বাজার জনশূন্য। এরকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা অনেকখানি। কোন অতি সংক্রামক ও অতি শক্তিশালী ভাইরাসের আবির্ভাবেই এটা ঘটতে পারে।

আবার প্রলয়ঙ্করী কোন যুদ্ধের মাধ্যমেও ঘটতে পারে। আমার বিশ্বাস মানুষ নিয়ন্ত্রণ হারাবে এবং বিষম বিস্ময় ও হতাশা নিয়ে নিজেদের বিলুপ্ত হয়ে যেতে দেখবে। সেটা হতে পারে এই শতাব্দীতে বা তৃতীয় সহস্রাব্দ শুরু হবার আগেই কোন এক সময়। প্রকৃতির সাথে মানুষের যে বৈরিতা সভ্যতার উন্মেষ কালে শুরু হয়ে বেড়ে চলেছে তা আসলে আগুন নিয়ে খেলা। এর অবসান ঘটাতে চাইলে আমাদের অরণ্যে ফিরে যেতে হবে, যা স্বেচ্ছায় আমরা কখনই করবো না। আপনি যদি পৃথিবীতে বেঁচে থাকা শেষ মানুষটি হোন তাহলে শেষ দিনগুলোতে কী করবেন সেটা দেখে নিতে পারেন এই ভিডিও থেকে- https://www.youtube.com/watch?v=fdCDQIyXGnw
hassangorkii@yahoo.com
মার্চ ১৭, ২০২২। রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা।