হাসান গোর্কি : ছোটবেলায় একটা ধাঁধা শুনতাম- ডিম আগে না মুরগি আগে! এই সমস্যার একটা সমাধান কল্পনা করতাম: বহু দূরের গভীর জঙ্গলের লতা-গুল্মে ঢাকা অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে একটা জায়গা থেকে একটা মুরগি বেরিয়ে এসে বহু পথ পাড়ি দিয়ে লোকালয়ে প্রবেশ করছে। তারপর ডিম; ডিম থেকে অনেক মুরগি। আবার ভাবতাম ওখানে হলুদ ঝরা পাতার স্তূপের মধ্যে কয়েকটা ডিম পড়ে ছিল। সবুজ পল্লবের ফাঁক গলে সেখানে সূর্যের আলো এসে উষ্ণতা ছড়ায়। ডিম ভেঙে বাচ্চা বেরিয়ে এসে পোকা-মাকড় খেয়ে বনে বড় হয়। এরপর তারা লোকালয়ে চলে আসে। মুরগি বা ডিম সেখানে এলো কীভাবে সে ভাবনাটাকে প্রসারিত হতে দিতাম না। আমাদের পাশের গ্রামে পিতৃমাতৃহীন আমার এক বন্ধুর বাড়ি ছিল। গ্রামের পেছন দিকে বেশ ঘন একটা জঙ্গল। আমরা জঙ্গলে ঢুকে আতা, সফেদা, পেয়ারা পেরে আনতাম। ইছামতির তীর ঘেঁষা ঐ জঙ্গলে বড় একটা বট গাছ ছিল। এর শেকড়ের মধ্যে মাটি খুঁড়ে সাপ, ব্যাঙ, বেজি, শেয়াল বাস করত। বর্ষাকালে এর শেকড়ের পুরোটাই পানিতে ডুবে থাকত।

আমি ভাবতাম আমার কল্পিত মুরগি বা ডিমটা হয়তো এরকম একটা উপযুক্ত জায়গাতেই ছিল যেখানে তার বিকশিত হবার সুযোগ আছে। মুরগি-ডিমের এই ধাঁধার সমাধান যে বিজ্ঞানীরা কয়েকশ বছর আগেই বের করেছেন সেটা জানার বয়স তখন আমার হয়নি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর সকল প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে এককোষী প্রাণী থেকে। মানুষ, মুরগি, হাতি, শিম্পাঞ্জি, তেলাপোকা, পিঁপড়া- সবাই এসেছে সমুদ্রে জন্ম নেওয়া তাদের আদি এককোষী প্রাণ থেকে। প্রাণীর বংশলতিকা দেখে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে সব জীবের আদি পিতা হলো ব্যাকটেরিয়া। তার অর্থ আমরাও ব্যাকটেরিয়ার বংশধর যারা প্রায় এক বিলিয়ন বছর সমুদ্রে বাস করেছে (নাকি পূর্ব-পুরুষদের সন্মানে ‘করেছেন’ বলা উচিত?)। আর এই এককোষী প্রাণীর জন্ম হয়েছে এমিনো এসিডের প্রাকৃতিক রূপান্তর থেকে।

সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে, সৃষ্টির প্রথম দিকে পৃথিবী ছিল টগবগ করে ফুটতে থাকা গলিত লাভার একটা গোলক। লাভা শীতল হয়ে তৈরি করে জিরকন, পাথর, মাটি, লোহা, নিকেল, দস্তা। বাস্প ঘনীভূত হয়ে তৈরি করে এমোনিয়া এবং ফসফরাস লবণ পূর্ণ জলের সাগর-মহাসাগর। তাতে শত কোটি বছর ধরে সূর্যের আলো, তাপ, বজ্রপাত থেকে আসা বিদ্যুৎ রাসায়নিক বিক্রিয়া করে এমিনো এসিডের জন্ম দেয়। এরপর স্বয়ং উদ্ভূত আমিষের জটিল যৌগ আরও জটিল পরিবর্তনের দিকে ধাবিত হয়ে এককোষী প্রাণের সৃষ্টি করে। বিষয়টা যত সহজে বলা গেল প্রক্রিয়াটা তত সহজ ছিল না। এর সবচেয়ে জটিল দিক হলো জড় পদার্থ থেকে জীবের উদ্ভব। আমাদের বুদ্ধিতে এটা কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হবার কথা নয়। এমিনো এসিড একটা প্রাণহীন তরল। সে কীভাবে নিজে নিজে একটা প্রাণের জন্ম দেবে? বুদ্ধি, চিন্তা এবং আবেগ তৈরি করবে? এটা আমাদের জিজ্ঞাসা। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন এই প্রাণহীন তরলের মধ্যে চেতনার সব উপাদান অবিন্যস্ত অবস্থায় ছিল; প্রাণীতে রুপান্তরিত হবার পর সেগুলো সক্রিয় হয়েছে।

এমিনো এসিডের মধ্যে প্রাণের অনেক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সেটা চেতনায় রূপ নেওয়াটাও রাসায়নিক প্রক্রিয়ার একটা স্তর। এখানে বাইরে থেকে কোন সিদ্ধান্ত, অনুমোদন বা অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হয়নি। যেমন ধরুন আপনি হাঁড়িতে একটা ডিম সেদ্ধ করতে দিলেন। চুলা জ্বালানোর পর আপনি কারো শিখিয়ে দেওয়া ডিম সেদ্ধ করার মন্ত্র পড়ে হাঁড়িতে ফু দিলেন এবং দেখলেন যে সময় মত ডিমটা সেদ্ধ হয়েছে। এই সাফল্যের পুরো বা আংশিক কৃতিত্ব যদি আপনি মন্ত্রের উদ্ভাবককে দেন তাহলে আগুন, চুলা এবং আপনার নিজের উদ্যোগের প্রতি অবিচার করা হবে। আসলে আপনি মন্ত্র না পড়লেও ডিম সেদ্ধ হতো। একইভাবে প্রকৃতির প্রাণহীন উপাদানগুলো থেকে প্রাণ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও বাইরের অতি-প্রাকৃত কোন অনুপ্রেরণা জরুরি ছিল না। তার অর্থ এটা নয় যে ‘বাইরের অতি-প্রাকৃত কোন অনুপ্রেরণা’র সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা হচ্ছে; শুধু বলা হচ্ছে ঘটনাটা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে ঘটার ক্ষেত্রে কোন বাধা নেই (যেহেতু স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটার পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রমাণ আছে)।
এই স্বয়ংক্রিয়তার পেছনেও যদি কোন রহস্য থেকে থাকে সেটা আমরা বুঝব না। কারণ, সেটা রহস্যই; বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত ইনফারেন্স ছাড়া আমাদের কাছে তার কোন প্রমাণ নেই। তাই আমাদের সীমিত বুদ্ধিতে মহাবিশ্বকে স্বয়ম্ভূ বলে বিশ্বাস করার ক্ষেত্রেও কোন বাধা নেই। যেমন, স্টিফেন হকিং বলেছেন, “মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে একজন ঈশ্বরের হাত থাকা জরুরি ছিল না।” অর্থাৎ তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বাতিল করে দেওয়াও প্রয়োজনীয় মনে করেননি; কারণ ঈশ্বর তার কাছে একটা ধারণা মাত্র। তিনি বলতে চেয়েছেন ঈশ্বর ছাড়াও মহাবিশ্ব সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। বিগ ব্যাং থেকে মহাবিশ্বের বিবর্তিত বর্তমান রূপকে বিজ্ঞানীরা একটা বিশ্বাসযোগ্য কাঠামোতে ব্যাখ্যা করেছেন যদিও যে সিঙ্গুলারিটি (অনন্যতা) থেকে বিগ-ব্যাং ঘটেছে বলে দাবি করা হচ্ছে তার ব্যাখ্যায় প্রচলিত ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্যের বেশ কিছু মিল আছে।
জড় থেকে শুধুই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমে জীবের উদ্ভব ঘটেছে আমাদের বুদ্ধি এরকম অদ্ভুত দাবি অনুমোদন করবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিষয়টা সেরকমও হতে পারে। সেটা হয়তো আমাদের বুদ্ধিতে ধরছে না, ফলে আমরা বিশ্বাস করছি না। বিচার করার ক্ষেত্রে আমরা আমাদের ভৌত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে ব্যবহার করছি। প্রসঙ্গের বাইরের অন্য একটা উদাহরণ থেকে একটা ধারণা নিয়ে আসা যাক। থিওরি অব রিলেটিভিটি অনুযায়ী কেউ আলোর গতির খুব কাছাকাছি গতিতে পৃথিবীর বাইরে কয়েকশ বা কয়েক হাজার বছর কাটিয়ে আবার বর্তমান মুহূর্তে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে। এটা আমাদের মাথায় ধরে না। তার অর্থ এই তত্ত¡ ভুল নয়। একইভাবে জড় পদার্থ কীভাবে আপনা আপনি জীবে রুপান্তরিত হতে পারে সেটাও আমাদের মাথায় ধরে না বলেই এই দাবিকে ভুল বলে বাতিল করে দেওয়া ঠিক নয়।

আইনস্টাইন বলছেন কেউ বা কিছু যত বেশি গতিতে ভ্রমণ করবে সে/তা ততো বেশি কাল প্রসারণের সুবিধা পাবে। কেউ যদি আলোর গতির ৯৯.৯৯৯৯৯% গতিতে পৃথিবী থেকে বাইরে চলে গিয়ে ভ্রমণ করতে থাকে তাহলে তার কাছে সময় প্রায় থেমে যাবে। ধরুন আপনি গরম তেলে ডিম পোঁচ করতে দিয়ে আলোর গতির ৯৯.৯৯৯৯৯% গতিতে চলে এমন একটা মহাকাশ যানে চেপে মহাকাশে গেলেন। কয়েক হাজার বছর মহাকাশে কাটিয়ে ফিরে এসে আপনি দেখবেন ডিমটা উল্টে দেওয়ার সময় হয়েছে। আইনস্টাইনের জন্ম ১৮৭৯ সালে। জন্মের বছর যদি তাকে আলোর গতির ৯৯% গতির একটা মহাকাশ যানে করে মহাকাশে পাঠিয়ে দেওয়া হতো তাহলে এখন (জুলাই, ২০২১) পৃথিবীতে ফিরে এলে তার বয়স হতো ১৭ বছর। আর ঐ মহাকাশযানের গতি যদি আলোর গতির ৯৯.৯৯৯৯৯৯৯৯% হতো তাহলে তার বয়স হতো এক দিন। সেক্ষেত্রে আইনস্টাইনের এক সেকেন্ডের দৈর্ঘ্য হতো পৃথিবীর ১৯.৬ ঘন্টা। দেখুন, অংক দিয়ে নিশ্চিত করে প্রমাণ করা যায় এমন একটা অকাট্য হিসেবও কিন্তু মানতে ইচ্ছা করছে না। নিজেকে বিশ্বাস করাতে চাইলে ভৌত জগতের অভিজ্ঞতা আমাদের বাধা দেয়। বারবার মনে হতে থাকে এই অতিরিক্ত সময়টা আসবে কোথা থেকে! আমরা বিষয়টা বিচার করতে থাকি আমাদের বোধগম্য সময়ের ধারণা দিয়ে। অর্থাৎ আমরা যা বুঝতে পারি তা-ই সব নয়। তাহলে এখন মূল আলোচনায় ফেরা যাক।

জীব ও জড় এর মধ্যে আমরা পার্থক্য করছি আত্মা থাকা এবং না থাকা দিয়ে। নোবেল পাওয়া জার্মান লেখক হেরম্যান হেস এর সিদ্ধার্থ উপন্যাসে ঘাটের মাঝি বলছে চেতনা ছড়িয়ে থাকে জীব জড় নির্বিশেষে ব্রহ্মাণ্ডের সকল পদার্থকণার মধ্যে। একজন মানুষের দেহ ক্ষুদ্রতম অংশে বিভক্ত করলে যে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন পাওয়া যাবে এক খন্ড পাথর ভাঙলেও তা-ই পাওয়া যাবে। তাহলে পাথরের একটা ক্রীয়াশীল চেতনা নাই কেন? নাই একারণে যে, যে সকল জৈব–রাসায়নিক বিক্রিয়া পারস্পরিকতা (ইন্টারএকটিভনেস) তৈরি করে, একটা পাথরের গঠন সেরকম নয়। তাহলে চেতনা কি শুধুই একটা জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া? হ্যাঁ, শুনতে বিদঘুটে হলেও ব্যাপারটা সেরকম বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করেন। পুত্রের প্রতি পিতার স্নেহ কি মস্তিস্কের নিউরোন সেলগুলোর রাসায়নিক বিক্রিয়া? হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। অনুভূতি শূন্যে ভাসে না অথবা কোন পদার্থের ওপর ভর করা ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না। পিতার শবদেহ থেকে পুত্রের জন্য কোন আবেগ নির্গত হয় না। কারণ ততক্ষণে তার মস্তিস্কের সেলগুলো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

চেতনা বস্তু-নিরপেক্ষভাবে কাজ করে না। এরকম একটা অবস্থার কথা কি আমরা ভাবতে পারি যেখানে মহাবিশ্বে কোন পদার্থকণা নেই; শুধু আমাদের আত্মারা ঘোরাফেরা করছে! কোন মানুষ যখন অনিয়ন্ত্রিত আবেগের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তখন তাকে ট্রাঙ্কুলাইজার খেতে দেওয়া হয় যাতে জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তার মস্তিস্কের সেলগুলো তথ্য আদান প্রদান করতে না পারে। চেতনার আলাদা কোন অস্তিত্ব থাকলে এ পদ্ধতিতে কাজ হতো না। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। ঢাকায় আমার এক ডাক্তার ছাত্রী যে কোন বিপদে আমার কাছে সমাধান চাইত (তাদের কোরবানির গরু হারিয়ে গেলেও চেয়েছিল!)। একদিন বিকেলে সে আমাকে ফোন করে বলল যে তার দাদির ওপর পুরনো জিনের আছর আছে। আজ তার মামি বেড়াতে এসেছেন। তাকেও জিন ধরেছে। দাদি এবং মামি একসাথে জিন দেখতে পাচ্ছেন এবং অদ্ভুত আচরণ করছেন। ছাত্রী আমার কাছে কোন জিন ছাড়ানো হুজুরের সেল নাম্বার চায়। আমি তাকে দোকান থেকে বোপাম-৩ এমজি (এটা একটা ট্রাঙ্কুলাইজার। আমি এই একটার নামই জানতাম।) কিনে এনে দুজনকেই দুটো করে খাইয়ে দিতে বললাম। জোর করে তাকে রাজি করালাম। দাদি, মামি ঘুমিয়ে গেলেন। জিন পালিয়ে গেল। এরপর থেকে দুজনই নিয়মিত বোপাম খেয়ে সুস্থ্য আছেন। তাদের ওপর আর জিনের আছর হয় না। অল্প আছর হলে বোপামের মাত্রা বাড়িয়ে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

যাহোক, ডিম আগে না মুরগি আগে সেই বিচারের রায় তো ঘোষণা করতে হবে! বিজ্ঞানীদের ধারণা পৃথিবীতে প্রাণ নামক সজীব অভিব্যক্তিটি গড়ে উঠেছে অসংখ্য নিষ্প্রাণ অণুর সমন্বিত মিথস্ক্রিয়া থেকে। ডিম বা মুরগি এদের কেউ-ই অন্যের চেয়ে আগে তৈরি হয়নি। পর্যায়ক্রমটা এরকম: এমিনো এসিড থেকে আমিষের যে জটিল যৌগ তৈরি হয় তা থেকেই এককোষী প্রাণীর উদ্ভব। এককোষী প্রাণীর কোষের মধ্যেই প্রজননের উপযোগী রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে এবং তা বিভাজিত হয়ে দুটি আলাদা এককোষী প্রাণীর জন্ম দেয় অথবা সংযুক্ত থেকে পর্যায়ক্রমে বহুকোষী প্রাণীর জন্ম দেয়। এই বহুকোষী প্রাণীর মধ্যে কিছু কোষ পুরুষ ও কিছু কোষ স্ত্রী বৈশিষ্ট্য পেতে থাকে এবং তারা শরীরের আলাদা দুটি অংশে চলে যায়। এক সময় অংশ দুটি আলাদা হয়ে দুটি পূর্ণাঙ্গ বহুকোষী প্রাণীর জন্ম দেয় যার একটা পুরুষ এবং অন্যটা স্ত্রী। (যে প্রাণীগুলোর মধ্যে এই বিভাজন ঘটেনি তারা উভলিঙ্গ থেকে গেছে। যেমন, কেঁচো, শামুক, কৃমি, জোঁক)। এভাবেই প্রাথমিক এককোষী প্রাণীরা কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে পৃথিবীর প্রান্তর পূর্ণ করেছে।
hassangorkii@yahoo.com
রয়্যাল রোডস ইউনিভার্সিটি, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, জুলাই ০৭, ২০২১।