খুরশীদ শাম্মী : বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। প্রবাস জীবনে বাংলাদেশিদের অবস্থান অধিকাংশ স্থানেই প্রথম প্রজন্মের টানাপোড়েন চলছে এখনও। কোথাও কোথাও দ্বিতীয় প্রজন্ম শাখাপ্রশাখা বিস্তার করছে একটু একটু। আমরা যারা উন্নত জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে একদিন দেশ ছেড়ে দূর প্রবাসে এসে জীবনযাপন শুরু করেছি, সংগ্রাম করে টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিটি মুহূর্ত। নিজেদের জীবনকে কতটুকু উন্নত করে গড়তে পেরেছি তা নিয়ে সংশয় আছে ঢের। উন্নত দেশে এসে কেউ বিশুদ্ধ বাতাস ও পানিতে ঘাস ফড়িং ও ব্যাঙাচি রূপ ধারণ করে গোল্লাছুট খেলছি, কেউ ব্যাকপ্যাক থেকে ব্যবহৃত রুমাল বের করে গন্ধ শুঁকে স্মৃতির সমুদ্রে সাঁতরিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঝিমুচ্ছি, কেউ হয়তো-বা জীবনকে ভিন্নভাবে দেখতে শুরু করেছি মাত্র, কেউ উন্নত সংস্কৃতির ভালো ও শোভনীয় বিষয়গুলো আয়ত্ত করছি পদে পদে, আবার কেউ কিচ্ছুই পারিনি ওই এক নিজের গোঁয়ার্তুমি ধরে রাখা ব্যতীত। এগুলো থেকে উত্তরণ খুব সহজ কাজ নয়। কেননা ওগুলো আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা আমাদের ভিন্ন ভিন্ন সত্তার এক একটি সাক্ষ্য। তবে পেটের টানে, জীবনের প্রয়োজনে আমরা সবাই-ই হয় সরকারি ভাতা তুলে মৌলিক চাহিদা পূরণ করছি, নয়তো শ্রম ও মেধা বিক্রি করে দিব্বি পার করছি দিনগুলো। আমাদের দুই প্রজন্ম থেকেই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার পাশাপাশি রাজনীতিতেও সম্পৃক্ত হচ্ছি।

আমি ওই সকল রাজনীতিবিদদের কথা বলছি না, যারা প্রবাসে বসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা-প্রশাখা খুলে দেশীয় রাজনীতি করছেন। আমি বলছি আমাদের মধ্যে তাদের কথা, যারা উন্নত দেশে এসে ওই সকল দেশের মূলধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের অনুপ্রাণিত করছি এবং তাদের জন্য আমার শুভ কামনা চিরন্তন। তবে, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মতো দেশগুলোতে যে বিষয়টি ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি হচ্ছে, আমরা কি আমাদের প্রচলিত দেশীয় পদ্ধতিতে মূলধারার রাজনীতি করব? অর্থাৎ নিজের সুবিধা অনুযায়ী দল নির্বাচন ও দল পরিবর্তন, নীতির চেয়ে বাহুবলের প্রাধান্য দেওয়া, ক্ষমতার অপব্যবহার, অন্ধ অনুসরণ, যোগ্যতার চেয়ে ব্যক্তি পছন্দের প্রাধান্যের মতো বিষয়গুলোকে ঘিরে রাজনীতি করব? না কি ওই সকল দেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মূলনীতি, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য জেনে ও মেনে দল নির্বাচন করে নিয়মকানুনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে রাজনীতি করব?

অনেকেই হয়তো পাল্টা প্রশ্ন করবেন যে উন্নতদেশগুলোর মূলধারার রাজনীতিতে উপরে উল্লেখিত খারাপ দিকগুলোর চর্চা কি একদমই নেই? এর উত্তর কিন্তু স্পষ্ট; আছে। তবে তুলনামূলক অনেক কম এবং অন্যায়গুলো খুব দূর পর্যন্ত যেতে পারে না, কেননা উন্নত দেশগুলোর অধিকাংশ দেশেই আইন ও বিচার বিভাগ নিরপেক্ষ। আইনকানুনগুলো সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। বিচারের প্রতি নির্ভর করা যায় বলে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস সকল নাগরিকের সমান। অধিকাংশ জনগণ ও রাজনৈতিক কর্মীরা তাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, দলীয় উদ্দেশ্য, দর্শন ও পরিকল্পনা বিবেচনা করে দল সমর্থন করে থাকেন। নির্বাচন কালে সাধারণ জনগণ দল ও প্রার্থীর যোগ্যতা বিবেচনা করে নেতা নির্বাচিত করেন। নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্রের চারপাশে প্রার্থীদের কিংবা তাদের কর্মীদের জনগণের উপর অযথা কোনো প্রকার চাপ সৃষ্টি করতে দেখা যায় না।

তারপরও, রাজনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাণিজ্যে পরিণত হয়। পণ্য বিপণন স্লোগানে ক্রেতা বৃদ্ধির মতো আকর্ষণীয় বক্তব্যে ভোট ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যানিজ্য। হ্যাঁ, রাজনৈতিক নেতারা মূলত তা-ই বলেন, যা শুনতে চায় লোকজন। একজন নেতা জনগণের অধিকার ও প্রয়োজনের কথা বলে বলে তার অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেন এবং নির্বাচনে জিতে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তবে একজন সৎ নেতা সামগ্রিক কল্যাণ বিবেচনা করে উন্নয়নমূলক ও গুরুপূর্ণ কাজ করেন। আবার, একজন দুষ্ট নেতা তা-ই বলেন যা শুনতে চায় দুষ্ট চিন্তার লোকজন এবং তাদের জন্য অভয়ারণ্য গড়ে তোলেন জনসম্মুখে। উদাহরণ স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তুলে ধরা যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার চার বছর শাসনামলে যতটুকুন ভালো কাজ করেছেন, তার থেকে অনেক অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবহেলা করেছেন, এমন কি দৈনিক হাজার হাজার জনগণের মৃত্যুও তাকে টলাতে পারেনি তার স্বেচ্ছাচারিতা থেকে। তিনি নিজ স্বার্থে বর্ণবাদীদের মনঃপূত কথা বলে বলে উস্কিয়ে দিয়েছেন, বর্ণবিদ্বেষীরা তাকে প্রভুর মতো অন্ধ অনুসরণ করে এক পর্যায়ে দেশের ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী হামলা করে বসে। সেই হামলায় পুলিশ অফিসারসহ মোট পাঁচজন প্রাণ হারায়। দু’জন পুলিশ অফিসার আত্মহত্যা করেন। ট্রাম্প প্রশাসন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে বহুল বিতর্কিত এক অধ্যায়, যা সচরাচর দেখা যায় না।

২০২১ সালের জানুয়ারি ৬ তারিখ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে নিজের দেশের দুষ্কৃতীদের দ্বারা সন্ত্রাসী হামলা হয়। এর পরপরই হাজার হাজার রিপাবলিকান নেতা ও কর্মী দল ত্যাগ করেন। কারণ, তাদের ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের ওই সময়কার ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম টার্ম শেষে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর ক্রমাগত ভিত্তিহীন আক্রমণাত্মক মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তার অনুসারীরাই ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল। সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যেসকল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীগণ দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারা সকলেই প্রমাণ করেছেন, “ব্যক্তির থেকে দল, দলের থেকে দেশ বড়।” তারা দেশের স্বার্থ ও সুনাম বিবেচনা করেছেন। তারা মনে করেছেন, এতকিছুর পরও ওই দলে থাকার অর্থ হচ্ছে, কোনো না কোনোভাবে দুষ্ট দলনেতার কুৎসিত আদর্শ অনুসরণ করা। কিন্তু আমরা যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দল ত্যাগের ইতিহাস পর্যবেক্ষন করি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আদর্শের থেকে নেতাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ, সরকারি সুযোগসুবিধা ভোগের কারণ স্পষ্ট পরিলক্ষিত।

আবার ওই ট্রাম্পই যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের সুফল গ্রহণ করেছেন। হ্যাঁ, কংগ্রেসে তার দ্বিতীয় ইম্পিচমেন্ট পাশ হলেও সিনেটে ভোটাভুটির মধ্য দিয়ে তিনি দ্বিতীয় দফায় ইম্পিচমেন্ট থেকে মুক্ত হলেন। তবুও দেশের আইনবিভাগ তাকে ছেড়ে দেবে না। তার নামে মামলা হচ্ছে বিভিন্ন স্টেট আদালতে, তার অনুসারীরাই দেশের স্বার্থে নিজেদের ভুল স্বীকার করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে তর্জনী তুলছে। সুতরাং তাকে আইনের মুখোমুখি হতেই হবে। কিন্তু বাংলাদেশে এগুলো সম্ভব হয় না। কারণ, বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীগণ কিছু চাটুকার ও মস্তান শ্রেণির লোকজন দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে সর্বদা। এছাড়াও, রাজনৈতিক কর্মীগণ ও জনগণ নেতা-নেত্রীদের অনেকটা নবী-রসুলের মতো অন্ধভাবে সমর্থন করে এবং প্রয়োজনে যুক্তি পাল্টে উচ্চস্বরে শব্দ ও পরিবেশ দূষণ করতেও ভুল করে না।

যেহেতু আমরা বাংলাদেশিরা আবেগপ্রবণ এক জাতি। হৃদয়ের আবেগ মাথায় ধারণ করি। যুক্তির থেকে আবেগের মূল্য দেই বেশি। সুতরাং স্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের ভাবনার পরিবর্তন তেমন একটা পরিলক্ষিত হয় না। প্রবাসেও কাদা আমাদের মুঠোতেই থাকে, নিজে কিংবা নিজের দল ব্যর্থ হলেই হাতের কাদা প্রতিপক্ষের দিকে ছুড়ে মারি। এই আমাদেরই একদল প্রবাসে এসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বাক-স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করি কেবল নিজ স্বার্থে। কিন্তু কখনো বিস্তারিতভাবে ভেবে দেখি না যে রিপাবলিকান দলের অনেক নেতারাই তার ভোট চুরির অন্যায় দাবি মেনে নেয়নি। জর্জিয়াসহ কয়েকটি স্টেটে একাধিকবার ভোট গণনা তার প্রমাণ। সেই আমাদের পক্ষে কি সম্ভব এখানকার নিয়মকানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে, পরস্পরের প্রতি সম্মান দেখিয়ে মূলধারার রাজনীতি করা? যদি সেটি না-ই করতে পারি, তবে তো আমাদের দ্বারা এখানকার রাজনীতিতে আমাদের দেশের রাজনীতির কলুষিত ধারা গুলিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সুতরাং আমরা যারা প্রবাসে মুলধারার রাজনীতি করতে ইচ্ছুক, সর্বপ্রথম আমাদের নিজেদের ভাবনা-চিন্তাগুলোকে পরিবর্ধন করা জরুরি। প্রয়োজনে পরিবর্তন করার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। নতুবা, মূলধারার রাজনীতিতে আমরা দ্রুত গ্রহণযোগ্যতা হারাব। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে সাদা ও কালোর মাঝে আমরা বাদামি চামড়ার মানুষ, সংখ্যায়ও অত্যন্ত কম, স্রোতের বিপরীতে নিজেদের স্থান নির্মাণ করার জন্য রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুনের প্রতি আমাদের খুব শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে, জনগণের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। প্রতিপক্ষকে হেয় করে নয়, তাদের প্রতি সম্মান রেখে নিজেদের কাজ করে যেতে হবে।
খুরশীদ শাম্মী, টরন্টো, অন্টারিও