হোসনে আরা মণি : হোসনে আরা মণি-র জন্ম ও বেড়ে ওঠা হিমালয় থেকে নেমে আসা উন্মুক্ত, অমলিন মধুমতি-ফটকি-গড়াই-নবগঙ্গা-চিত্রার কল্লোলিত স্রোতধারায় বাহিত পলি মাটিতে। বাবার এবং নিজের চাকরির সুবাদে বাস করেছেন রাজধানীসহ দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলে। তাই তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস পড়লে আমরা দেখতে পাই স্মৃতি-বিস্মৃতির বাতায়ন ঘুরে তিনি কাহিনির পারম্পর্য তুলে এনেছেন তাঁর দেখা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও জীবনবোধ থেকে। একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে মানুষ মননশীলতা ও মানবিকতার যে খরায় পড়েছে তা থেকে উত্তরণের জন্য চাই মনোজাগতিক পরিবর্তন। হোসনে আরা মণি তাঁর উপন্যাস প্রবহমান- এ মানবমনের এই নিগুঢ় সংকট নিয়ে ব্যতিক্রমী কাজ করেছেন: তুলে এনেছেন মানবিক ও মানবীয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পূর্ণতা-অপূর্ণতা, আকাক্সক্ষা-দুরাকাক্সক্ষার কথা, রাজনীতি-সমাজ-সংসারের অগ্রন্থিত কাহিনিমালা। আজকের বাঙলা সাহিত্য প্রেম-পরিণয়, দারিদ্র্য-ক্ষুধা, আকাক্সক্ষা-অনাচার বা সমাজ-সভ্যতার ছকবাঁধা ও কষ্টকল্পিত কাহিনির পৌনঃপুনিকতায় কিছু মাত্রায় আক্রান্ত। জীবনের চিরচেনা নিবিড় আখ্যান বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে বিরল না হলে সংখ্যায় লক্ষণীয়ভাবে কম। বিপরীতে আঙ্গিকের ভিন্নতা, নৈর্ব্যক্তিক ব্যঞ্জনা, পটভ‚মি, চরিত্র চিত্রণ এবং কাহিনি বিন্যাসে ভাবাবেগহীন স্বতঃস্ফূর্ততা হোসনে আরা মণি-র এই উপন্যাসটিকে স্রোতস্বিনীর মতো প্রবাহিত হতে দিয়েছে। তাঁর এই উপন্যাসের চরিত্রগুলো ‘হাজার বছর ধরে’ নিজেদের মতো বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে হেঁটে চলে। দিন শেষে পাঠকই বিচারক। সম্পাদক হিসেবে তাঁদের কাছে ‘বাংলা কাগজ’-এর এই নতুন ধারাবাহিক উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।
মনিস রফিক, সম্পাদক
(৮)
পূবিতে সূয্যি ওঠে পশ্চিমিতে চান
ঘরে আমার মানিক জ্বলে আসেন দেহে যান।
সুনার তৈয়ার পুতুল আমার হীরের ঝলক রূপ
সুনায়-হীরেয় রাখব মুড়ে কে বা দিবি দুখ!!
নাতিনের গায়ে ঘানিভাঙ্গা সর্ষের তেল ডলতে ডলতে আকিমন গান গায়। রওজান বিবি চেয়ে চেয়ে দেখে আর হাসে। মনে তার বড় আনন্দ। আজ কত কত বছর পর এ বাড়িতে একটা ছোট্ট শিশু হাত-পা ছুঁড়ে খেলে, খলখলায়ে হাসে, আর ট্যাঁ ট্যাঁ করে কাঁদে!
হিরণবালা মেয়েরে মাই দিতে চেষ্টা করে। পয়লা পোয়াতি সে। সময়মত মাই টানাতে না পারায় বুকে দুধ ঠিকমত আসেনি। মেয়ে তাই মায়ের বুকে অস্বস্তিতে কাঁদে। আকিমন এসে নাতিনেরে কোলে তুলে নেয়। ‘ও আমার সুনা বুবু, মানিক বুবু রে, ও আমার ঘরের আলো আলতা বুবু রে’ বলে দোল দিয়ে দিয়ে কান্না থামাতে চেষ্টা করে। বাচ্চাটা একটু থামে, আবার কাঁদে। আকিমন এবার কাপড় সরায়ে নাতিনের পেট টিপে-টুপে দেখে হিরণবালার উদ্দেশ্যে বলে, তুমার দুধি আমার নাতিনির প্যাটের কুনাও ভরে না। এত যে কালিজিরে খাও, ভালোমন্দ খাও, তারপরও মাইয়ে দুধ আসে না। তারপর বিড়বিড় করে রাগতস্বরে বলে, দুধ কী অইরে আসপি! সুয়ামি যদি আঁতুড় ঘরে মাইয়েলোকের কাছে যায়, তালি কি আর সেই পুয়াতির বুহি দুধ থাহে! পুয়াতির দুধ সুয়ামি’র পা’র তলায় পড়লি তিন দিনিই শুহোয় যায়।
মেয়ের দুধ না পাওয়ার কষ্টে নাকি এই খোঁটায় হিরণবালার চোখে পানি চলে আসে। সে কি আঁতুড় ঘরে শুয়ে সোয়ামি’র সোহাগ চাইছিল? সে কি খবর দিয়ে শরাফতরে তার চাচার বাড়ি আনছিল? একুশটা দিনও পার হতি দেয়নি, লোকটা একদিন যাইয়ে হাজির। বলে কিনা ঝামার আড়ং দেখতি আইছি। তা ঝামার আড়ংয়ের নৌকাবাইচ তো এ তল্লাটে বিখ্যাত। কত কত দূর গাঁও থেকে মেয়েরা এসময় নাইওর আসে! জামাইরাও আসে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতি আর আড়ং দেখতি। নতুন জামাইগেরে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়। আর পুরনো জামাইয়েরা আপনি আসে। তা জামাই নতুন-পুরোন যাই হোক, আড়ংয়ে যেয়ে ঠিকই কেনে শালার জন্যি বাঁশি, শালীর জন্যি পুতুল আর শাশুড়ির হাতে তুলে দেয়ার উদ্দেশ্যে এক হাঁড়ি মিঠেই। সেই আড়ংয়ে শরাফত এবার গেছিল দাওয়াত ছাড়াই। মাত্র কয়দিন আগে মনির শাঠুরের আয়োজনে যা খরচ হইছিল তা সামলাতেই চাচার অবস্থা কাহিল, এর মাঝে আবার জামাইরে দাওয়াত করে ভালোমন্দ কী খাওয়াবি! অবশ্য গেল দুই সাল চাচা এমনিতেও জামাইয়েরে আড়ংয়ের দাওয়াত দেয়নি। দশ বচ্ছর হয় বিয়ে হইছে হিরণবালার। এখন তো তার সুয়ামি পুরনো জামোই, নাকি?
রমিজ মিঞা এত্তেলা পায়। আকিমন তারে ভেতর বাড়ি ডাকে। ও পাড়ার খয়বরের সাথে খলাটে দাঁড়ায়ে রমিজ মিঞা হাটে গরুর দরদাম বিষয়ে আলাপ করছিল। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর গরু-বাছুরের দাম ফের উঠতে শুরু করছিল। এখন নাকি বন্যার আগের চেয়েও বেশি দাম চড়ছে। আর চড়বে নাই বা কেন? বন্যার সময় অনেক গিরস্থই গরু পালতে না পেরে নাওয়ে গরু চড়ায়ে নিয়ে গঞ্জের হাটে বেচে দিছিল। অনেকে বেচছিল পেটের জ্বালায়। তা রমিজ মিঞা কষ্টে-সৃষ্টে হলেও গরুগুলোরে ঠিক পেলে-পুষে রাখছে। এখন বাজারে দাম চড়ায় সে দুয়েকটা গরু বেচতে চায়।
রমিজ মিঞা ঘরে এলে আকিমন বলে, আধসের-তিন পোয়া দুধ দেয় এমন এট্টা ধাড়ি ছাগলের খোঁজ করেন, মনির জন্যি দুধির ব্যবস্থা অরা দরকার।
রমিজ মিঞা অবাক স্বরে বলে, ক্যা, মনি দুধ পায় না?
দুধ পালি কি আর আপনেরে ছাগলের কতা কই? আকিমন ঝাঁঝিয়ে ওঠে। রমিজ মিঞার মুখে আন্ধার ঘনায়।
নাহ্! টাকা হাতে এলে তা ধরে রাখার কপাল রমিজ মিঞার নয়। এই কেবল গরু বেচে কিছু নগদ টাকা পাওয়ার স্বপ্নে তার মনটা একটু খুশি খুশি বোধ করছিল, এমন সময় আরেক খরচের পরস্তাব। তয় ছাগলের দাম এই বাজারে এমন কিছু বেশি নয়। বন্যার পরে গরুর দাম যেমন চড়ে ছাগলের তেমন না- এই যা ভরসা।
ছাগীর দুধ শিশুর পেটে সহনীয়, মায়ের দুধ না পেলে শিশু ছাগীর দুধ খেয়েই বড় হয়। এ দুধ খেয়েই হিরণবালার কইন্যা চান্দের কলার মতন বাড়তে থাকে। এখন সে এক পা-দু’পা করে হাটে। তার পায়ে রুপোর মল ঝমঝমায়ে বাজে।
দুধে-আলতা গায়ের রঙ শরাফতের মেয়ের। নামও তার আলতা। নাকটা তার একটু চ্যাপ্টা। তাই নিয়ে আকিমনের শরিকী জায়েরা রঙ্গ করে কত কথা কয়! এ বংশে সবার নাকই বেশ খাড়া আর লম্বা। হিরণবালার নাকও তো বাঁশির নাহাল। সে তুলনায় বোঁচা নাকী আলতা সবার মনেই কৌতুকরসের জন্ম দেয়। রওজান বিবি সেসব কৌতুকের জবাব এভাবে দেয় :
উঁচা কপাল, বুঁচা নাক
আলাই-বালাই দূরে যাক।
উঁচা কপাল, বুঁচা নাক
গোলা ভরা ধান থাক।
উঁচা কপাল, বুঁচা নাক
মানিক আমার বাঁইচে থাক।
বোঁচা নাকী আলতা সবার দোয়ায় বেঁচে থাকে।
বোঁচা নাকী আলতা বড় হতে থাকে।
পুতুলের বিয়ে দেয় আলতা। পাশের বাড়ির নওয়াব মিনের সাইজে মাইয়্যের কুচকুচে কালা ছাওয়াল পুতুলটার সাথে তার সোনার বরণ কইন্যার বিয়ে। বিয়ে হয়, ভোজ হয়। বর-বৌ কোলে চড়ে নওয়াব মিনের গোয়ালঘরে গিয়ে ওঠে। ঐ গোয়ালের এক কোনায় সাইজে মাইয়্যের পুতুল খেলার ঘর। কইন্যার বিয়ে দিয়ে আলতা কাঁদে। একদম সত্যিকার মায়ের মতই যেন সে কাঁদে। এমন সময় মা তারে ডাক দেয়। চোখ মুছে ধীর পায়ে মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে অবাক। মায়ের হাতে লাল মলাটঅলা কী একটা বই!
মুখ্যুর বংশ তো নয়- এ বংশে পড়ালেখার চল আছে। পুরুষরা অনেকেই মক্তব-মাদ্রাসায় পড়েছে, কেউ কেউ গেছে নহাটা ইশ্কুলে। তবে মেয়েদের মধ্যে আলতাই প্রথম ইশ্কুলে যায়। বাড়ির পাশেই ইশ্কুল বসছে। ছাত্রদের সাথে দুয়েকটা ছাত্রীও যুক্ত হয়েছে। আলতা তাদের সাথে সুর করে পড়ে……..
স্বরে অ, স্বরে আ, হ্রস্বই, দীর্ঘঈ……
কর খল ঘট
জল ধন নখ
পথ ফল ভয়…….
ঐক্য বাক্য মাণিক্য
মুখ্য অখ্যাতি উপাখ্যান
ভাগ্য যোগ্য আরোগ্য…….
সদা সত্য কথা বলিবে।
মিথ্যা বলা মহাপাপ।
চুরি করা অপরাধ।
গুরুজনে মান্য কর।
লেখাপড়া করে যেই
গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই।
গোপাল বড় ভাল ছেলে। তাহাকে যাহা দেয়া হয়, তাহাই খায়।
আলতা পড়ে। হিরণবালা শোনে। পড়া শুনতে তার কী যে ভাল লাগে! আলতার পরিত্যক্ত বর্ণ পরিচয় প্রথমভাগ বইটা সে উল্টেপাল্টে দেখে। আলতার শিশুহাতের অযত্ন আর বছরখানেক ব্যবহারের দরুণ মলাট ছেঁড়া ন্যাতানো দশার বইটা সে বড় যত্নে খুলে চোখের সামনে মেলে ধরে কতক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। আশ্চর্য! এমন বই আলতা কত অনায়াসে গড়গড় করে পড়ে যায়! অথচ তার চোখে সব লেখা কথা হয়ে ধরা দেয় না। আলতার পড়া দেখে দেখে তার বর্ণ পরিচয় কতকটা হয়েছে কিন্তু সেই পরিচয় কাজে লাগিয়ে বই পড়া আর হয়ে ওঠে না। সংসারে কত কাজ! এর মাঝে আলতার পড়া কানেই শোনা হয়, চোখ দিয়ে মিলিয়ে নেয়ার ফুরসৎ মেলে কই?
(৯)
‘মাইয়েরে কি তুমি জজ-ব্যারেষ্টার বানাবা বৌ?’
ওপাড়ার ফালুর দাদীর মুখ বাঁকায়ে করা প্রশ্ন। ফালু আলতার সাথে পড়ে।
হিরণবালার হয়ে কথার জবাব দেয় আবদুর রউফের মা। ঢেঁকিশালে আতপ চাল কুটতে কুটতে একথা সেকথায় এসে পড়েছিল ইশ্কুল-মাস্টার-পড়া প্রসঙ্গ। ফালুর দাদী পাড়াবেড়ানি। পাড়া বেড়াতেই সে আসছে মিঞাবাড়ি। চমক লাগানো গল্প ঝাড়তে ফালুর দাদীর জুড়ি নেই। নানা ঘরের হাঁড়ির কথাও তার ঝুলিতে বিস্তর। কার ব্যাটার বৌ শাউড়ির সাথে গাছকোমর বেঁধে কোন্দল করে, কোন মাগী ব্যাটার বৌয়েরে ভাত দেয়ার আগে প্যাট পুরে পানি খাওয়ায় নেয়, কোথায় কোন ঠাকুরের বিধবা মাইয়্যে ছয় মাসের প্যাট খালাস করতে যেয়ে মর মর, পাড়ায় কার বিবি কার সাথে আশনাইয়ে মত্ত; এসব তার নখের আগার খবর। কাজেই ফালুর দাদীর কথার জবাবে মুখ খোলা হিরণের সাধ্যি নয়। আবদুর রউফের মা বয়সে ফালুর দাদীর কাছাকাছি, বংশীয় সম্পর্কে সে হিরণের বড় জা। আকিমনের কাছে পান খাওয়ার নামে বেড়াতে এসে সে বসে গিয়েছিল চাল কোটার কাজে হাত লাগাতে। চালের আটা টেকতে টেকতে সে বলে, জজ-ব্যারেষ্টার কী কও বুজি, আলতা মা আমাগার হাউশ করে ইশ্কুলি যায়। আর কয়দিন বাদে তো বিয়ে হয়েই যাবি। যদ্দিন তা না হয় তদ্দিন ইশ্কুলি গিলি এট্টু চোখ-কান ফুইটলি চিঠি-পত্তরডা যদি পড়তি শেহে…….
‘কিডা তুমাগেরে অত চিঠি-পত্তর ল্যাহে? আর বাড়ির মিনসেরা কি পত্তর পড়তি পারে না?’
তাতো পারেই। মিঞা বংশের প্রায় সব পুরুষই লেখাপড়া জানেঅলা। শুধু আঞ্চলিক পাঠশালা-ইশ্কুলেই তাদের পড়াশুনো নয়, কোথায় কোন মহকুমার কী এক কলেজে এ বংশেরই একজন এফ এ না কী জানি পড়তে যেয়ে শেষে ফিরে আসছিল মাথা খারাপ হয়ে। লোকটা সারাক্ষণ নাকি মাথা হাঁটুর মাঝে গুঁজে দিয়ে বিড়বিড়িয়ে কী সব বকতো। সম্পর্কে নাকি তিনি হিরণের ভাসুর হতেন। তা হিরণ তারে দেখতে পায়নি। হিরণের বিয়ের তিন মাস আগে তিনি একদিন পুকুরে একা একা নাইতে যেয়ে আর ওঠেননি। আর হিরণের এক চাচাত দেওর মাহতাব উদ্দিন, সে তো বর্তমানে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। সেখান থেকে উলা পাশ করে তবেই ফিরবে। দুই ঈদ ছাড়া আর কোন পরবে তার দেখাই পাওয়া যায় না। কাজেই ভাতুরিয়ার মিঞা বংশ কোনভাবেই গ্রামের মৃধা, মিনা, বিশ্বাস ইত্যাদি বংশের তুল্যি নয়।
শ্বশুরের বংশ নিয়ে হিরণের চাপা গরববোধ আছে। এ বোধটা সে পেয়েছে শাশুড়ি ও দাদীশাশুড়ির কাছ থেকে। মিয়া বংশ কলেমা-কালাম লেখাপড়া জানা আশরাফ বংশ। আরবি-ফারসি-বাংলা, হালে একটু-আধটু ইংরেজিও এ বংশের পুরুষেরা জানে। সেই যে কবে পথ ভুল করে দুই গোরা সেপাই এসে পড়ছিল এই গাঁয়ে, তা তাদের সাথে কথা কইতে কে পেরেছিল মিঞা বংশের ছাওয়াল আবুল ফজল ছাড়া? চৈত মাসের কাঠফাটা রোদে সিপাইদের সিঁদুরে লাল মুখ হয়ে পড়ছিল যেন খয়েরলাল। সিপাইয়রা কী যেন চায়, টরটরায়ে কিসের নাম জানি কয়, গ্রামের কেউ না বোঝে। শেষে আবুল ফজল এক দৌড়ে বাড়ি ঢুকে কাঁসার গেলাস আর এক কলসি পানি নিয়ে গেলে দুই সেপাই তার পড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তিয়াস মিটলে পরে তারা আবুল ফজলের হাত ধরে কতক্ষণ ঝাঁকাঝাঁকি করে কত কী জানি কয়! শেষে ফজলেরই কাছেত্থে পথ বুঝে নিয়ে তারা শহরের পথ ধরে। সেই ঘটনার পর গ্রামবাসীর কাছে আবুল ফজলের পরিবারের সম্মান খুব বেড়ে গেছিল। তা তার পরিবারের সম্মান কি বংশেরও সম্মান নয়?
ফালুর দাদীর মুখের উপর মুখের মতো একটা জবাব দেয়ার জন্য হিরণের মুখ ফুটি ফুটি করে। কিন্তু এখনো সে বলতে গেলে বৌ মানুষ, ময়-মুরব্বীর মুখের পরে উচিৎ কথা বলাটা তার সাজে না। তাই সে চুপ থাকে। কিন্তু তার ঢেঁকিতে পার দেয়ার জোর হঠাৎ বেশ বেড়ে যায়। তবে চুপ থাকে না আকিমন। নোটে চাল আলায়ে দিতে দিতে সে বৌয়ের মেজাজ ঠিক ধরতে পারে। বৌয়ের মেজাজ তার কাছে আহ্লাদের বিষয় নয়। কিন্তু এখন যে কারণে বৌ ক্ষুব্ধ তা তার কাছেও ক্ষুব্ধ হওয়ারই বিষয়। যদিও আলতার পড়াশুনো তার কাছেও বাড়াবাড়ি ব্যাপার। কী হবে পড়াশুনো করে মেয়েমানুষের? একটু কলেমা-কালাম জানলে আর উত্তর-দক্ষিণ চিনলেই তো মেয়েলোকের কাজ চলে যায়। রান্ধা-বাড়া, ঝাড়পোচ করা কাজের জন্যি কি আর ইংরেজি পড়ার দরকার পড়ে? কিন্তু গ্রামে নতুন ইশ্কুল বসার পর মনা মাষ্টের রমিজ মিঞারে বুঝাইছে এক আজব কথা। আজকাল নাকি কোলকাতা আর কহানে কহানে মেয়েরাও ইশ্কুলে যায়। ‘তা বাপু, ইডা কি কোইলকেতা শহর যে মেয়েমানুষ জুড়িগাড়ি চড়ে হাওয়া খাতি যায়?’ এ কথার জবাব বেশ শক্ত করেই দিয়েছিল রমিজ মিঞা। আকিমনের বংশ-গোত্তরের দিকে ইঙ্গিত করেই কিনা বলেছিল, ‘ভাতুরিয়ার মিঞা বংশ নাদানের বংশ না। দুদু মিঞার বংশ আমরা। শরিয়ত-মারেফতের হকিকত বুঝে মিঞারা চলে। এ বংশের মাইয়্যেগেরে বরাবরই কুরান-হাদিস শিক্ষা করানো হয়। নাদান বংশের মাইয়্যেছেলে বৌ করে আনলি তাগেরও কিছু শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ক্যান, তুমার মনে নেই? তুমিতো ঠিকমতন দিকও চিনতে না। উত্তর ঘরে চেরাগ দিতি কলি চেরাগ হাতে মাঝ উঠোনে খাড়ায় থাইকতে। তাই কই, মাইয়্যেমানুষেরও পড়াল্যাহার দরকার আছে, শরাফতের মা। নাদান মাইয়্যেমানুষ খালি একালে না, পরকালেও বিপদের কারণ। ঠিকমতন কুরান-কিতাব পড়তি না শিখায় তারা শেরেক-বেদাত করে বেশি, সংসারে নানা ফেৎনা-ফ্যাসাদেরও জন্ম দেয়।’ এর পর কি আর কথা চলে! তবু কথা চালাতে চেষ্টা করেছিল আকিমন, ‘ক্যান, কুরান-কিতাব পড়তি কি ইশ্কুলি যাওয়া লাগে? ইশ্কুলি কি ওসব পড়ানো হয়? পড়ায় তো যত হিন্দুয়ানি….।’ আকিমনকে থামিয়েছিল রমিজ মিঞা, ‘ইশ্কুলি আরবি পড়ায় না ঠিক, পড়ায় বাংলা-ইংরেজি। তা কোরানের তর্জমা পড়তি গেলি কি ধর্মীয় দুয়েকখান কিতাব নাড়াচাড়ার জন্যি লাগে বাংলা পড়াশুনো। মাতৃভাষা শিক্ষা না করলি যে চোখ ফোটে না শরাফতের মা।’
হ, চোখ ফোটে না! চোখ ফুটায়ে মাইয়্যেমানুষ হাতি-ঘোড়া হবি। সত্যিই তো, তারা কি আর জজ-ব্যারেষ্টার হবি? তা জজ-ব্যারেষ্টার নাই হোলো, তাই বুলে কি আরাক পাড়ার মাগী আইসে কতা শুনোয় যাবি? কোইলকাতায় বংশীয় ঘরের মাইয়্যেরাই নাহি এহন ইশ্কুলি পড়তি যায়। আগে খালি হিন্দু ঘরের মাইয়্যেরা ফিরিঙ্গি ইশ্কুলি দুই-চারজন পড়তি যাইতো, এহন বাংলা ইশ্কুলও নাহি হইছে। সিবার ফজু মিদ্যার মাইয়ের বিয়েতে কোইলকাতার থে তেমনই কোন মাইয়ে নাহি আইছিল। ফালুর দাদীর কথার জুৎসই জবাব দিতে স্বভাবসুলভ ভুরুর ভাঁজ আরো গভীর করে চিবানো স্বরে আকিমন বলে, চিঠি-পত্তরের কতা না খালি বাপু, কতা একাল-পরকাল দুইকাল নিয়ে। কুরান-কিতাব পড়তিউ আইজকাল বাংলা জানা লাগে।
আকিমনের কথায় কথা বাড়াতে ফালুর দাদীর ঠিক সাহস হয় না। আকিমনের গাম্ভীর্য, চিবিয়ে বলা কথাকে পাড়ার কুঁদুলে মেয়েমানুষেরাও ডরায়। রায়বাঘিনী প্রকৃতির নারীও আকিমনের সাথে সমঝে কথা কয়। এমন না যে, আকিমন খুব ঝগড়াটে স্বভাবের। পাড়াপ্রতিবেশীদের সাথে বিবাদের ইতিহাস আকিমনের জীবনে নেই বললেই চলে। তবু যে পাড়ার মেয়েমহল আকিমনের সাথে ভাব বুঝে কথা বলে তার মূল কারণ তার রাশের ভারত্ব। (চলবে)
hamonim79@gmail.com