সাজ্জাদ আলী : সেকালের পোষ্টার
ইলেকশনের আর সপ্তাহ দুয়েক বাকি। এখনও কোনো পোষ্টার ছাপনো হয়নি। অবশ্য তাতে যে ভোটের কিছু ক্ষতি হয়েছে তা না। প্রার্থী তো নেতা না। তিনি ভোটারদেরই একজন। নিজেদের লোককে ভোট দিতে ভোটারদের পোষ্টার লাগবে কেন? অবশ্য ভোটে তিনি দাঁড়াতেও চাননি। দলীয় প্রার্থী হিসেবে কাশিয়ানি থানা আওয়ামী লীগ তার নাম সুপারিশ করেছিলো। নমিনেশন বোর্ড সেই মতো তাকে টিকিট দিয়েছে। প্রার্থী লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরা সাদামাটা মানুষ। পাজামা একটা আছে বটে, আদালতে যাওয়ার সময় সেটা পরেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচন পূর্ব সময়ের কথা বলছি। কাশিয়ানি থানা থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচনে আক্তারউদ্দিন মিয়া আওয়ামী লীগের নমিনেশন পেয়েছেন। পেশায় তিনি গোপালগঞ্জ মহকুমা আদালতের মোক্তার। লোকে তাকে আক্তার মোক্তার নামেই চেনে। টাকা পয়সা নাই। আর থাকবেই বা কী করে? সারাটা জীবন যত না মোক্তারি করেছেন, তার থেকে অনেক বেশি করেছেন আওয়ামীলীগ। দল অন্তপ্রাণ তার। যতটুকু মোক্তারি করেছেন, তার মধ্যে অধিকাংশ মক্কেলই আবার আওয়ামী লীগের সমর্থক। দলের লোকের জন্য ফাও ফাও মামলা লড়তে হয়।
প্রার্থী বেশ জানেন যে মানুষ তাকে ভোট দেবে, তিনি জিতবেন। কারণ দুটো। এক, তার মার্কা নৌকা। আর দুই, তিনি ভোটারদের আপনার লোক। কিন্তু তিনি এই ভোটভুটি নিয়ে বড়ই অস্বস্তিতে আছেন! সবাই মিলে তাকে দাঁড় করিয়েছে। এখন তো মহা ফ্যাসাদ! জিতলে নাকি ঢাকায় গিয়ে পার্লামেন্টে হাজিরা দিতে হবে। সেখানে লুঙ্গির চল আছে কিনা কে জানে?
একদিন ভোর বেলা হাঁটতে হাঁটতে তিনি আমাদের বাড়িতে হাজির। খবর পেয়ে চাষাভু‚ষারা দলেবলে তাদের হবু এম.এল.এ কে দেখতে আসছে। বেলা বাড়ে ভিড়ও বাড়ে। ভেতর বাড়িতে দাদীর সাথে সাক্ষাৎ সেরে মোক্তার সাহেব কাচারী ঘরে বসেছেন। ততক্ষণে লোকে লোকারণ্য। ঘর ছাপিয়ে বাড়ির মস্ত উঠোন ভরে গেছে লোকে। গগনবিদারী ¯েøাগানে মুখরিত গাঁয়ের আকাশ বাতাস। জয় বাংলা, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, মোক্তার সাবের মার্কা নৌকা নৌকা ইত্যাদি সব শ্লোগান। কানের কাছে মুখ নিয়ে আব্বা বললেন, ভাইজান দরজায় দাঁড়াইয়া লোকজনের উদ্দেশ্যে দুইডা কতা কন।
আমি কী কবো টিপু মিয়া যা কওয়ার তুমি কইয়া দেও, নিচু গলায় বললেন মোক্তার সাহেব।
ভাইজান আইজ তো কতা কওয়াই লাগবি। জনগন তো আপনার কতা শুনতিই আইছে।
আইচ্চা, তুমরা কী আমারে নেতা বানাইয়া ছাইড়বা, বিরক্ত জিজ্ঞাসা মোক্তার সাহেবের।
ওঠেন, উইঠা পড়েন তো ভাইজান, দরজায় চলেন, আব্বা ঠেলেঠুলে মোক্তার চাচাকে দরজায় এনে দাঁড় করালেন।
কী যে অস্বস্তির সাথে চাচা দরজায় এলেন তা তার মুখের চেহারা না দেখলে আন্দাজ করা যাবে না। হ্যান্ড মাইকটা মুখের কাছে নিয়ে উপস্থিত সহ¯্র জনতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আসসালামু ওয়ালাইকুম। আপনারা দয়া কইরা ¯েøাগানে আমার নাম কইয়েন না। শ্যাখ সাবের নাম কন, আর নৌকা মার্কার কথা কন।
ব্যাস, ওইটুকু শুনতে পেরেই জনতা মহা খুশি। দুপুর নাগাদ দশ গাঁয়ের গণ্যমান্য জনেরা সব এসে পড়লেন। কাচারী ঘরের কোনো চেয়ার আর খালি নাই। রাজপাটের সিরাজকে খবর পাঠানো হয়েছিলো, সে তার ক্যামেরা নিয়ে চলে এসেছে। ঘরের পশ্চিম পার্শ্বের বেড়ার সাথে শতরঞ্জি টাঙানো হয়েছে। তার সামনেই একখানা চেয়ার পাতানো। এটাই ফটো স্টুডিও। মোক্তার সাহেবের ছবি তোলা হবে। তা ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল, তবুও ছবির শট নেওয়া গেল না। মোক্তার চাচা রাজী না। ছবি সে তুলবে না। আব্বা বোঝচ্ছেন, ভাইজান পোষ্টারে আপনার ছবি দেওয়া লাগবি। দুইডা মিনিট, খালি একটু বাইরে আসেন। ক্যামেরাম্যান রেডি আছে।
আমার ছবি লাগবি ক্যান? তুমি আমারে যন্ত্রণা কইরো না তো। ছবিটবি তোলবো না, বলে চাচা আবার লোকজনের সাথে কথায় ফিরে গেলেন।
আব্বা হাল ছাড়লেন না। ক্যান্ডিডেটের ছবি ছাড়া পোষ্টার হয় কী করে? একটু পরে আবারো বললেন, ভাইজান ওঠেন তো, ছবিডা তুইলা ফালাই। আক্তার চাচা কথাটা যেন শুনেও শুনলো না। অগত্যা আব্বা উপস্থিত গণ্যমান্যদের স্মরণাপন্ন হলেন। সবার অনুরোধই বিফল হলো। মোক্তার সাহেব মাথা নিচু করে বসে রইলেন। ওদিকে অনুরোধের চাপ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলো। এক সময়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে চাচা বললেন, আইচ্চা তুমাগো কি মনে হয় যে আমার ছবি দেইখ্যা লোকে ভোট দিবি? আমি কিডা? পোষ্টারে তুমরা শ্যাখ সাবের ছবি দেও। আর নৌকার ছবি দিয়ো।
একালের পোষ্টার
একটা নমুনা বলি তবে। তাকিউদ্দিন আমার ফেসবুক মেসেঞ্জারে পোষ্টারের একটা ছবি পাঠিয়েছে। ঢাউস সাইজের রঙিন পোষ্টার। বোঝা যায় বেশ খরচাপাতি করে ডিজাইন করিয়েছে। পোষ্টারটির কোনো মূল বক্তব্য নেই। তাকিউদ্দিন শুধু এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। তবে কেন বা কী কারণে সেই “শুভেচ্ছা” তার কিছু লোখাজোকা নেই। দুই একটি ¯েøাগান অবশ্য খুব ছোট্ট করে লেখা। এই যেমন, “জয় বাংলা”, “জয় বঙ্গবন্ধু”, “পরিচ্ছন্ন রাজনীতি যুবলীগের প্রতিশ্রুতি”—এগুলো। পোষ্টারের প্রকাশক বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। যুবলীগের অফিসিয়াল মনোগ্রামসহ একেবারে নিচে সে কথাটি লেখা আছে।
বক্তব্য না থাকলেও পোষ্টারে ছবি আছে মোট নয়টি। তাকিউদ্দিনের ফটো সব থেকে বেশি জায়গা জুড়ে। তা অর্ধেক তো হবেই। তারপরেই গুরুত্ব পেয়েছে স্থানীয় সাংসদের ছবি। আরো আছে যুবলীগের বর্তমান সভাপতি, সম্পাদক এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতির ছবিও। ব্যবসায়ীদের শীর্ষতম সংগঠনের সভাপতির (এফবিসিসিআই) ছবিও আছে পোষ্টারে। এক কোনায় ছোট্ট করে শেখ রাসেলের মুখখানাও দেখা যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর ছবির সাইজ তাকিউদ্দিনের থেকে অন্তত পাঁচগুণ ছোট। নয়টি ছবির মধ্যে সব থেকে ছোট ছবি বঙ্গবন্ধুর। আর ডিজাইনের অলঙ্করণে সে ছবি অতীব গুরুত্বহীনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আসলে এত সব বর্ণনা না লিখে যদি পোষ্টারখানার ছবি সেটে দিতাম, তবে পাঠক বন্ধুরা নিমিষে সব বুঝে যেতেন। কিন্তু সে কাজটি আমার শোভন মনে হয়নি।
এ ধরণের পোষ্টারে এখন বাংলাদেশ সয়লাব। রাস্তাঘাটে, দেয়ালে, ভবনে, গাছে, বাসে, লঞ্চে, নৌকায় সব জায়গায় এমন সহ¯্র পোষ্টার শোভা পাচ্ছে। এ সব এখন মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে। তাকিউদ্দিনের পোষ্টারও আমার মনোযোগ পায়নি। কিন্তু সে তো পণ করেছে ‘মনোযোগ’ পাইয়ে ছাড়বে। চার দিনের ব্যবধানে তিনবার মেসেঞ্জারে মেসেজে পাঠিয়েছে, ভাইয়া আমার পোষ্টার কেমন দেখলেন? জবাব না পেয়ে সেদিন ফোন করেছে, আসসালামু ওয়ালাইকুম, হ্যাপি নিউ ইয়ার! কেমন আছেন?
ওর পোষ্টার নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করতে ভাল লাগছিল না। কিন্তু দেশের ছেলে বারে বারে নক করছে, মনটা দুর্বল হলো। ফোন ধরে বললাম, বেশ আছি, তুমি কেমন আছ তাকি?
ভাইয়া ভাল আছি। আপনার দোয়া, আল্লার রহমত।
বল, তাকিউদ্দিন আর কী খবর?
ভাইয়া আমার পোষ্টারখান দ্যাখছেন?
হাঁ, অনেক খরচ করে ডিজাইনটা করিয়েছ তুমি।
জ্বী ভাইয়া, এর পরেরখানাও ছাপাবো তাড়াতাড়ি ইনশাআল্লাহ। ভাবলাম তার আগে আপনার পরামর্শ নেবো।
দেখ আমি দুই যুগেরও বেশি দেশ ছাড়া। রাজনৈতিক পরামর্শ আমি কী ভাবে দেবো বলো? তুমি বরং তোমার দলের সিনিয়র নেতাদের মত নাও।
ভাইয়া ওনারা সবাই নিজেগো স্বার্থ নিয়া কথা কয়। কয় যে আমার ছবি তো দেও নাই!
আচ্ছা ঠিক আছে, যাদের ছবি দিয়েছো তাদের সাথে কথা বলো।
তাকিউদ্দিনের বিষণœ জবাব, তারা হইলেন কত্ত বড় নেতা, আমি কি ওনাগো কাছে ঘ্যাঁষতে পারি!
আহারে বেচারা! বড় নেতাদের কাছে ঘেঁষার কী আপ্রাণ চেষ্টা! কী জানি কী লাভ তাতে? বুঝি কম। হয়তো নেতার সুনজর পেলে সে ডিজিটাল বাংলাদেশের “ডিজিট” হয়ে উঠবে। ছেলেটার জন্য বড় মায়া হলো। বললাম তাকি, তোমার এই পোষ্টারের উদ্যেশ্যটা ঠিক বুঝতে পারিনি। কিছু যদি মনে না করো তো দু-একটা প্রশ্ন করি? মন চাইলে উত্তর দেবে, না দিলে নাই।
ভাইয়া আপনার অনুমতি লাগবি ক্যা? কন কী জানতি চান?
আচ্ছা প্রথমে বলতো, তুমি এমন একখানা পোষ্টার ছাপলে কেন?
নেতাগে চোখে পড়ার জন্যি ভাইয়া। বড় নেতারা মাঝেমাঝেই বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত করতি টুঙ্গিপাড়া আসে। খবর পাইলি আমিও যাই। সেই যাওয়া আসার পথ পোষ্টারে ছাইয়া দিছি। শহরও ভইরা দিছি পোষ্টারে। চোখে না পইড়া যাইবো কই, তাকিউদ্দিনের সরল জবাব।
আচ্ছা ধরো তুমি নেতাদের চোখে পড়লে। তাতে তোমার লাভ কী তাকি?
ভাইয়া যে কী কন? যুবলীগের কমিটিতে ঢুকতি পারলি আমারে আর পায় কে? ব্যবসা, বাণিজ্য, ক্ষমতা, সবইতো তখন কব্জায়!
তা বেশ বলেছো, আজকাল রাজনীতি তাহলে ব্যবসা ও ক্ষমতার ভিত্তি। আচ্ছা তাকিউদ্দিন বলতো তোমার পোষ্টারে বঙ্গবন্ধুর ছবিটা সব থেকে ছোট রাখলে কেন?
ভাইয়া উনি হলেন জাতির পিতা, দ্যাশ স্বাধীন করছেন। উনি মারা গ্যালেও উনার ছবিতো বাদ দেওয়া যায় না। কী কন, ঠিক না?
এই ছেলেকে কী বলবো? একে তো কিষাণ কিনে পেটানো দরকার! নিজেকে সামলে নিলাম। মনে হলো আরো একটু কথা বলে আজকালকার রাজনৈতিক দল ও কর্মীদের মননটা একটু বুঝে নেই। জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা তাকি এই পোষ্টারটা তো তোমার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাছিলের জন্যই। বলতো, যুবলীগ কেন এমন একখানা পোষ্টার প্রচারের দায়িত্ব নিলো?
না ভাইয়া প্রচার তো আমি করছি। ছাপাইছি আমি, লাগাইছি আমি, খরচাপাতি সবই আমার। দল তো কিচ্ছু করে নাই, তাকিউদ্দিনের তড়িত জবাব।
বল কী? তাহলে পোষ্টারের নিচে যে লেখা, “প্রচারেঃ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ”!
ভাইয়া ম্যালা বছর বিদ্যাশে থাইকা আপনি দ্যাশের ভাবগতি কিছুই জানেন না। সব্বাই যার যার মতো পোষ্টার ছাপাইয়া প্রচারে দলের নাম লিখে দ্যায়। এইডাই নিয়ম।
ওহ, তাই বলো! তো এতে করে তো দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে তাকিউদ্দিন। পোষ্টারে তোমরা যার যা খুশি লিখছো, যেমন ইচ্ছা তেমন ছবি ছাপছো! দেশের বৃহত্তম দল এটি। দলের কেন্দ্রীয় প্রচার-প্রকাশনা দফতর নিশ্চয়ই আছে। তবে কি তাদের কোনো নীতিমালা নেই?
ভাইয়া, দলের তো এতে লাভ। আমি তো একলা না। আমার মতো হাজার হাজার নেতা কর্মী এই রকম পোষ্টারে দ্যাশ ছাইয়া ফালাইছে। সব এলাকার এমপি থেইক্যা বড় বড় নেতাগো ছবি দ্যাশের আনাচে কানাচে। ভাইয়া, প্রচারেই প্রসার। আর এতে তো দলের এক পয়সাও খরচ নাই।
তাকি হয়তো ঠিকই বলছে। আমিই বুঝে উঠছি না। তবে এটুকু বুঝেছি যে দলে তাকিউদ্দিনদের থামানোর লোক নাই। তা বেশ, তোমরা এগিয়ে যাও। এভাবে প্রচার চালিয়ে সদলবলে প্রসারিত হও! কিন্তু একটা কথা জানো তো ভাইডি, অতি প্রচারে বিস্ফোরণ অনিবার্য!
(লেখক বাংলা টেলিভিশন কানাডা’র নির্বাহী)