হিমাদ্রী রয় : উত্তরের আকাশ নীল, জেগে উঠেছে শারদ আলো। অনন্তনীল আকাশ জুড়ে স্মৃতিরা ডানা মেলে দেয় ভেসে চলা মেঘেদের বুকে, ছুটে যায় আবীর রঙা সন্ধ্যায় মুখ দেখবে বলে সেই খালের জলে।
যেখানে কাশবনের পাড় ঘেসে শুভ্র মেঘ কাশফুলে মেঘবালিকার মতো নৃত্য করে, যেখানে ভরা ভাদর শেষে শরত আসে শিউলি বিছানো পথে। ভোরের আকাশ রাঙানো সূর্যের কিরণে চিল্কায় সকাল, সবুজ ধানের ক্ষেতে।
সেই কবেকার ফেলে আসা শরতের বিন্দাস ভাবনাগুলো অন্টারিও লেকের জলে মুখ রাখে পড়ন্ত বিকালে। যান্ত্রিক যাপনে, বিলাসে বৈভবে, সংসার সংঘাতে, পার্থিব সুখে কিংবা শোকে সেই ভাবনারা কখনো আমাকে ছেড়ে যায়নি যা গিয়েছে তা হলো সময়। তাই ঋতু চক্রের পরিক্রমায় যখন শরত আসে ভাবনার “দূর বিদর্ভ নগরে” নাগরিক ভিড়ে আমি পেছন ফিরে তাকাই। জীবনানন্দ হয়ে ফিরে যাই মাটির কাছে, ফিরে যাই সবুজ ঘাসের কাছে।
“মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর; দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকী কখন নিভে যায়, দেখিব না আর পরিচিত এই বাঁশবন”।
আমাদের সেই দিনগুলি একেবারেই গেছে, তবু শরত আসে, বর্ষা যাই যাই দিনে মেঘ সরানো কনে দেখা আলোয় ভেসে ওঠে ছেলে বেলার কত রঙ করা মুখ, ফুল, পাখি আর জোছনা। এরা সবাই আমার আত্মীয় হয়ে উঠেছিল একদিন। আশ্বিনের অলস দুপুর জানে কতবার ছুটে গেছি বাঁশি পালের নিবিষ্ট মনে গড়া প্রতিমায় চোখ ফোটানোর তুলির টানে। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ আমাকে পথ দেখিয়েছে, জোছনার প্লাবন ধরে আমি হেঁটেছি অনেক বছর, কাঁঠালের শাকে বসা ভেজা জোড়া শালিক আমাকে জানে, কোকিলের কুহুতান কতবার আমার হৃদয়ের খুশির কপাট খুলে দিয়েছে, হিজলের বন আর মাছের ঘের, পদ্মফুটা ঝিল আমাকে চিনতো আমি সেই অসহিষ্ণু শৈশবের দুরন্ত কিশোর যার ছিল ফুসফুস ভরা হাসি আর এক পৃথিবী স্বপ্ন।
এখন সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয় হাসতে ভুলে যাই, স্বপ্নেরা ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলায়। এই বড়বেলায় বড় মনে পড়ে ট্রাংকের ভিতরে পুরানো কাপড়ে নেফথালিং এর গন্ধ, আশ্বিনের রোদ কাটিয়ে দিত সেই গন্ধ।
মনের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা কিশোর আজো ঘুড়ি উড়ায়, স্কুল পালানো দিনে শালুক তুলতে যায়, সিলেবাস ভুলে সন্ধ্যায় শারদীয়ার চাঁদা তুলতে বের হয়, এখনো রাত জেগে “পাঁচ পয়সার পৃথিবী” যাত্রার মহড়া দেয়, এখনো মনের গহীন ভিতরে শরতের শিশির ভোরে, কালের সাক্ষী পুরাতন রেডিওটি সচল, সুর তুলে অপেক্ষার প্রহর শেষে ‘বাজলো তোমার আলোর বেনু’ সুরের আবেশে অবশ হই, সম্বিত ফিরে পাই শাশ্বত স্বরে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জির’।
বুকের মধ্য বেজে ওঠে দ্রিম দ্রিম, শান্তি সমৃদ্ধি আর মঙ্গলের উৎসব, প্রিয়জনের কাছাকাছি, সার্বজনীনতার কাছাকাছি আসার তাগিদ-
‘আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম ছন্দে বেজে ওঠে রুপ লোক ও রস লোকে আনে নব ভাব মাধুরির সঞ্জীবন’।
মায়ের হাতে শিশির ভেজা শিউলি তলার দুব্বো আর পদ্মের নৈবেদ্যের থালা, জানি এই দিনগুলো কেউ আর আমাকে ফিরিয়ে দেবে না। এমনই শিশির ভেজা হাওয়ায় মা মা গন্ধ নিয়ে পূজা এসেছিল সেবার। টেলিফোনের ওপর প্রান্ত থেকে মা বলেছিলেন ‘সামনের পূজার আগে আইতে নানি আমরে হরিদ্বার লইয়া যাইস’ মা হরিদ্বার যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু সময়ের ঘড়ি আমাকে সেই সুযোগ দেয়নি।
সুনীল বাবু আমিও কথা রাখতে পারিনি। সেবার দেবী দুর্গা বিসর্জনের কিছুদিন পর মাও চলে গেলেন অমৃতলোকে অনন্তের পথে।
এখন প্রতিবছর শারদীয়া আসে আকাশবাণীতে শুনি আগমনীর আবাহনী সুর। চোখের আকাশের সজল মেঘ আর বুকের ভিতরের গঙ্গা একসাথে মেশে নেমে যায় হরিদ্বারের দিকে। ষষ্ঠীতে বোধন দেবী প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়, উৎসব আসে উৎসব যায়, আড়ম্বর সারা পৃথিবীময়, কেবল আমার পুণ্যতিথি বিসর্জনের ঢাক বাজায় গর্ভধারিণী দুর্গার জন্য যে একদিন হরিদ্বার যেতে চেয়েছিলেন।
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমো নমঃ।