আলমগীর খান : অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো তাদের যৌথভাবে রচিত পুওর ইকোনোমিকস বইতে সমাজে ও জাতীয় জীবনে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব, প্রত্যাশা ও সীমাবদ্ধতার ওপর অন্তর্ভেদী আলো নিক্ষেপ করেছেন। এছাড়াও তারা আলোচনা করেছেন উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে।
শিক্ষা-সরবরাহওয়ালারা যে সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য ঘোষণা করেছিলেন তাতে শিশুর বিদ্যালয়ে কিছু শেখার আবশ্যকতা ছিল না, কেবল বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শিক্ষাচক্র সম্পন্ন করলেই তাদের আশা পূরণ হলো। এমডিজি-কালে বাংলাদেশ, ইকুয়েডর, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পেরু ও উগান্ডার বিদ্যালয়ে শিক্ষক অনুপস্থিতির হার ছিল বেশ উঁচুতে। অভিজিৎ ও দুফলোর মতে “দেখা গেল তৃতীয় বিশে^র দেশসমূহে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে যারা বাবা-মার দোকানপাটে বসে তাদেরকে সাহায্য করে তারা জটিল হিসাবনিকাশে বিদ্যালয়ে-ভর্তি ছেলেমেয়েদের চেয়ে পটু।”
অন্যদিকে শিক্ষা-চাহিদাওয়ালাদের মতে “শিক্ষা একরকমের বিনিয়োগ।” অতএব অর্জিত শিক্ষা থেকে যদি লাভসহ টাকা উঠে না আসে কেউ এতে বিনিয়োগ করবে না। চাহিদাওয়ালাদের নীতি হলো ‘না-শিক্ষা নীতি।’
তারা বলছেন, “শিক্ষার লাভ কেবল অর্থে নয়: শিশুমৃত্যুর হার কমাতে তাইওয়ান কর্মসূচির বড় ভূমিকা ছিল। মালাউইতে টাকা পাওয়ায় যে মেয়েশিশুরা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েনি তারা অনাকাক্সিক্ষত গর্ভবতী হয়েছে কম। কেনিয়াতেও একই ফল দেখা গেছে।”
তবে কোথাও কোথাও দেখা যায়, ব্যক্তিমালাকানাধীন বিদ্যালয় সরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে ভাল শিক্ষা প্রদান করে। যদিও তারা আরও ভাল করতে পারত। বিদ্যালয়ে পড়া শেষ হওয়ার পর যেসব বিষয়ে শিশুশিক্ষার্থীরা দুর্বল সেইসব বিষয়ে আলাদা করে সংশোধনমূলক শিক্ষা অনেক ভাল ফল দিতে পারে। আর বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময়ের বাইরে এই বাড়তি শিক্ষা দিতে তেমন উচ্চশিক্ষার দরকার হয় না। স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অল্প বা মাঝারি শিক্ষাপ্রাপ্ত যে কেউ এটি করতে পারেন।
তারা পিতামাতার ‘প্রত্যাশার অভিশাপ’ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এরকম একটি প্রত্যাশা হলো, বাবামায়ের চোখে শিক্ষা প্রাথমিকভাবে তাদের সন্তানের জন্য সম্পদ আহরণের একটা পথ। সবচেয়ে সোজা পথটা হলো কোনো একটা সরকারি চাকরি লাভ যা বাগিয়ে নিতে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করে থাকেন। এভাবে শিক্ষার মৌল উদ্দেশ্যটাই বিপথগামী হয়ে যায়।
আরেকটা ব্যাপার হলো: “বাবামা হরহামেশা নিজের সন্তানদের প্রতি তাদের সামনেই ‘নির্বোধ’ ও ‘চালাক’ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করতে সবসময় উদগ্রীব থাকেন যা বিজয়ী বাছাই করার বিশ^দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ (যেখানে পরিবারের বাকি সবাই বিজয়ী সন্তানকে যারপরনাই সহায়তা করে থাকে)। যদিও বেঁচে থাকার ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির সংগ্রামে এ হচ্ছে একটা পারিবারিক কৌশল, এই প্রতিযোগিতায় যারা ‘বিজয়ী’ নয় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় একই ঘটনা ঘটে বিদ্যালয়ে যা সমগ্র জাতির জন্য ক্ষতিকারক।”
এ পরিস্থিতিতে বড়লোকি স্কুলব্যবস্থা গড়ে ওঠে। লেখকগণ ঔপনিবেশিক শাসকদের স্বার্থে কিছু কেরানি ও স্থানীয় প্রভুদের প্রতি বশংবদ একটা গোষ্ঠী তৈরির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, “নতুন নতুন শিক্ষার্থী অনেক আসা সত্তে¡ও শিক্ষকেরা এখনও সেই পুরনো অভ্যাসের জায়গাতেই পড়ে থাকেন এই ভেবে যে তাদের একমাত্র কর্তব্য হলো সেরা শিক্ষার্থীগুলোকে কঠিন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করে তোলা।” যা তাদের পরবতী জীবনে সুখ-সমৃদ্ধির দরজা খুলে দিবে। ইতিমধ্যে আধুনিকায়নের নামে শিক্ষার নতুন নতুন বিষয় বিদ্যালয়ে যুক্ত হতে থাকে আর পাঠ্যবই হতে থাকে স্থূল ও ভারি। ফলশ্রæতিতে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সমস্ত মনোযোগ চলে যায় সিলেবাস ও পাঠ্যবিষয় শেষ করার দৌড়ে, যা শিক্ষার পথে এক বিরাট বাধা।
এসব অঞ্চলে বিদ্যালয় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় কারণ “বিষয় ও শিক্ষাদান দুইই তৈরি করা হয় বড়লোক ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে, যারা নিয়মিত সাধারণ শিক্ষার্থী তাদের জন্য নয়।” উদ্দেশ্য হলো “অগ্নিপরীক্ষাতুল্য পরীক্ষার জন্য সেরা শিক্ষার্থীদেরকে আলাদা করা যাতে তারা জীবনে আরও উপরে লাফিয়ে ওঠার সুযোগ পায়, যার জন্য প্রয়োজন বিরাট সিলেবাস ও পাঠক্ষমতা আহরণ।”
এরকম শিক্ষাব্যবস্থায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর পিছনে পড়ে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং অনিবার্র্য। এ ব্যবস্থার গোপন এজেন্ডা হলো “প্রতি বছর মোটা দাগে তলার শ্রেণি থেকে অনেককে সেঁচে ফেলা যাতে অগ্নিপরীক্ষাটা যখন আসবে তখন পাসের শ্রেষ্ঠ রেকর্ড হস্তগত করা যায়।”
এই কাঠামোর সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে প্রচলিত ইংরেজি শিক্ষাটাও খাপ খায়। বাবা-মা সন্তানকে ইংরেজি শিক্ষা দিতে চান, কিন্তু বুঝতে পারেন না বিদ্যালয়ে সেটি ঠিকমত দেয়া হচ্ছে কিনা। বাড়িতে সন্তানকে সাহায্য করার মত যদি কেউ না থাকে তবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয় ইংরেজিসহ বিরাট পাঠ্যতালিকা শেষ করার চাপ, শিক্ষার কিছু হোক বা না হোক।
তবে ধনীর সন্তানেরা এই সমস্যা পাশ কাটিয়ে যেতে পারে ব্যক্তিমালিকানাধীন স্কুলের সাহায্যে। যেখানে শিক্ষার্থীদেরকে তুলনামূলকভাবে বেশি যতœ নিয়ে পড়ালেখা করানো হয়। অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না হতেই একটা বার্তা পেয়ে যায়: “তারা এখানে কাক্সিক্ষত নয় যদি তারা মেধার কোনো বিশেষ ঔজ্জ্বল্য দেখাতে না পারে।”
যার ফল হয় একসময় তাদের অনেকেরই স্কুল থেকে ঝরে পড়া। এভাবে “উন্নয়নশীল দেশসমূহের শিক্ষাব্যবস্থা দুটি মৌলিক লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়: প্রত্যেকের জন্য ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীর প্রতিভার দিক খুঁজে বের করা।”
এ দুটি লক্ষ্য পূরণ কেবল যে সম্ভব তাই নয়, সহজও। তারা উল্লেখ করেছেন বিদ্যালয়ের পরে বিভিন্ন সংশোধনমূলক শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করার কথা। এসব শিক্ষাকার্যক্রমে কোনো বিষয়ে দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীকে আলাদাভাবে বাড়তি শিক্ষাদান করে সক্ষম করে গড়ে তোলা যায়।
এ ব্যাপারে তাদের একটি পরামর্শ হলো ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির বা গ্রেডের মাঝে সীমান্তদেয়াল না তোলা। যাতে যে শিশুটি বয়সের কারণে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে তার যদি দ্বিতীয় শ্রেণির উপযোগী কোনো বিষয়ে ভাল করে পড়া ও দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন হয় সে যাতে তা পায় বিব্রত না হয়েই।
অভিজিৎ ও দুফলোর পরামর্শ হচ্ছে “প্রত্যাশা কমানো, ন্যূনতম দক্ষতার ওপর জোর দেয়া ও প্রযুক্তি ব্যবহার” ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন। যে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা দরিদ্রদেরকে ঠকানো ছাড়া কিছু নয় যা “বিরাট সংখ্যক শিশুকে বলতে গেলে কিছুই দেয় না।”
এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে “বিদ্যালয়গুলোকে সেইসব শিক্ষার্থীর জন্য কাজ করতে হবে যেসব শিক্ষার্থী তাদের আছে, যাদের পেলে তারা খুশি কেবল তাদের জন্য নয়।” আর সেইসঙ্গে প্রত্যেক শিশুকেই ন্যূনতম দক্ষতা অর্জনের ও নিজস্ব মেধা বিকাশের সুযোগ করে দেয়া।
অভিজিৎ ও দুফলোর অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গি সেইসব দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে যেখানে শিক্ষার ঘোষিত লক্ষ্য ও প্রত্যাশিত ফল আর যাই হোকÑ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদেরকে বঞ্চনা ছাড়া বলতে গেলে কিছুই দেয় না। তাদের পরামর্শ নিঃসন্দেহে কিছু কাজ দিবে। তবে তা সীমিত। তাদের আলোচনা মূলত এসব দেশের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রমকে কীভাবে আরও ফলপ্রসূ করা যায় আর মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা এ থেকে কী কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তা নিয়ে।
তারা দেখেছেন শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষা-সহায়ক/সহায়িকাদের (প্যারাটিচার) ওপর নজরদারি বাড়িয়ে ও তাদেরকে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে শিক্ষক অনুপস্থিতি হ্রাস করা যায়। এর ফলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমে মূলধারার বিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তি বাড়ে। তবে ক্যামেরা-নজরদারি রাজনৈতিক কারণে সরকার পরিচালিত বিদ্যালয়ে সম্ভব নয় বলে তারা এখানে স্বল্পমেয়াদী চুক্তিভিত্তিক প্যারাটিচার যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন।
কিন্তু প্যারাটিচার দিয়ে সংশোধনীমূলক শিক্ষা বা রেমিডিয়াল টিউটরিংয়ের যে পরামর্শ তারা দিয়েছেন তা মূল সংকটের সমাধান নয়। পুওর ইকোনোমিকস উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষায় অনেক ফাঁকি ধরিয়ে দেয় ঠিক। তবে কেবল নোবেলজয়ী অভিজিৎ ও দুফলোর কথা শুনলে এসব দেশ কখনও শিক্ষায় উন্নত দেশের সমকক্ষ হতে পারবে না।
শিক্ষকতা বিশেষত প্রাথমিক পর্যায়ে হতে হবে অত্যন্ত সম্মানজনক ও গুরুত্বপূর্ণ পেশা। শিক্ষক সংকট দূর করতে শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে, আরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে, বেতন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, দায়িত্ববোধ ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে এবং আরও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া যেসব দেশে উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা রয়েছে, তাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে অবশ্যই।
লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি