ইউসুফ কামাল : আমার টরেন্টো ভ্রমইের কয়েকটা দিন বন্ধু বিদ্যুৎ, আরতি বৌদি আর ওদের একমাত্র কন্যা ঝিলিকের আন্তরিকতার ছোঁয়া আমাকে ও আমার স্ত্রীকে নতুন করে দুর্বল করে দিলো। ওদের আতিথেয়তার ছোঁয়া সারা জীবনের জন্য আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ডেনফোর্থের কফি শপ আর আজকাল পত্রিকা অফিস ছিলো আমাদের রোজকার বৈকালিক আড্ডা স্থল। বিদ্যুৎ এর ১০ মেসি বাসার পেছনের সাবওয়ে ষ্টেশন থেকে ট্রেনে করে ড্যানডাস স্কয়ারসহ আরো নতুন কিছু স্থান ঘুরে ঘুরে দেখলাম কয়েকটা দিন, বলাই বাহুল্য ঝিলিকই আমাদেরকে এসব ঘুরে দেখানোর গাইড হিসেবে দায়িত্ব পালন করলো। ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার ‘গ্রেহাউন্ড’ বাসের ফিরতি ট্রিপ ধরে রওনা দিলাম আমেরিকার উদ্দেশ্যে। দেশে দেশে এখন মানুষের বসবাসের ধরন যে কত খানি পরিবর্তিত হয়ে গেছে বাস্তবতার মুখে, সেটা দেখলাম নতুন করে, যাত্রা পথে তামিলনাড়ু‘র হরিশ নাগালিংগম এর সাথে পরিচয় হবার পর। দশ মিনিটের মধ্যে ভদ্রলোক আমাকে খুবই আপন করে নিলেন।
কানাডা আর আমেরিকা পাশাপাশি দুই দেশ কিন্তু ওদের রক্ত প্রবাহ চলমান দুই দেশেই এক সাথে। সমগ্র পৃথিবীটাই এখন যে গ্লোবাল ভিলেজ এ রুপান্তরিত হয়ে গেছে সেটা হরিশের পরিবার আমাকে নতুন করে দেখিয়ে দিল। আড়াই ঘন্টার দূরত্বই ওদেরকে যেন আলাদা করে রেখেছে। তাছাড়া সব কিছু এক সাথেই চলে। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী ড্রাভিং লাইসেন্স, কিছু ব্যাংকের লেনদেনের সুবিধাসহ আরো বেশ কিছু সুবিধা আছে। তামিলনাড়ুর হরিশ মূলত ভারতীয় আমেরিকান নাগরিক, সাইরাকাসে তার পিতামাতার সাথেই বসবাস করতো, ওখানেই তার জন্ম। আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হরিশের সাথে ভারত থেকে পড়তে আসা অনুরাধার পরিচয় এবং পরবর্তিতে প্রণয়। হরিশ এখন চাকরীর সূত্রে সে স্ত্রীসহ কানাডাতেই থাকে। বৃদ্ধা মা’কে ওয়াশিংটন ভায়া সাইরাকাসগামী বাসে তুলে দিতে এসে আমার সাথে পরিচয়। আমার চেহারা দেখে এশিয়ান গোত্রের মনে করে জানতে চাইলেন, আমি ভারতীয় কি না? পরিচিত হবার পর বল্লেন পিতার মূল দেশ ভারত হলেও পরবর্তিতে আমেরিকান নাগরিক হবার পর সাইরাকাসেই এখন আমাদের পরিবারের সবাই বসবাস করে। গাড়ী ছাড়ার ঠিক দুই ঘন্টা ত্রিশ মিনিট পর গাড়ী ওখানে পৌঁছাবে, আমার বাবা সাইরাকাস বাস স্ট্যান্ডে মা’কে রিসিভ করতে আসবেন। মা বৃদ্ধ মানুষ দয়া করে একটু বাস থেকে নামতে সাহায্য করবেন। বুঝলাম একেবারে মন থেকেই সাহায্য কামনায় করলেন ভদ্রলোক। বল্লাম চিন্তা করবেন না যতটুকু সম্ভব সাহায্য আমি করবো। হরিশ পকেট থেকে নিজের ভিজিটিং কার্ড বের করে দিয়ে বল্লেন আবার এলে ফোন দিবেন অবশ্যই। অনেক খুশী হবো।
গাড়ী চলা শুরু করে দিলো, সন্ধ্যা পার হয়ে রাতের অন্ধকার ভেদ করে গাড়ী ছুটে চল্লো তার নিজস্ব গতিতে। হয়তো বাসের চলার ছন্দে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম গাড়ী থেমে যেতেই ঘুম ভেংগে গেলো চোখ খুলে সামনে তাকালাম। বুঝলাম এটাই সাইরাকাস। পাশের সীটের হরিশের মা দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। দাঁড়িয়ে বল্লাম চলুন। বুঝলাম আমার সাহায্য চাইছেন হাত ধরে গেটের দিকে তাকিয়ে বল্লাম আসুন। সযত্নে বৃদ্ধা মহিলাকে ধরে নীচে নেমে এক পাশে দাঁড়াতেই মনে হলো এক ব্যক্তি আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। হরিশের মা মৃদু হাসি দিয়ে আমাকে দেখিয়ে কিছু একটা বল্লেন, বুঝলাম ইনিই হরিশের বাবা বাসের অপেক্ষাতেই ছিলেন। ভদ্রলোক হরিশের মায়ের হাত থেকে ছোট ব্যাগটা হাতে নিলেন। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন। হাসি মুখে বল্লেন, অনেক ধন্যবাদ আপনার মহানুভবতার জন্য। ওদেরকে বিদায় নিয়ে আবার বাসে উঠে বসলাম, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম ভদ্রলোক স্ত্রীর হাত ধরে ধীরে ধীরে গেটের দিকে এগিয়ে চলেছেন। স্বামীর বাস স্ট্যান্ডে প্রতীক্ষা পরবর্তি শেষ দৃশ্যটা দেখে আমার মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল, ঠিক এই বয়সেই মানুষের অবলম্বনটা বেশি দরকার। হাতে হাত রেখে চলার জন্য নির্দিষ্ট কোন সময় ও বয়স লাগে না , আর সারাটা জীবন ও হয়তো তার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু অবলম্বনের জন্য এমনি একটা হাতের খুবই প্রয়োজন।
টরেন্টো থেকে চলে আসার আগের দিন সি এন টাওয়ারে চড়ে টরেন্টো শহরের বেশ খানিকটা দেখে ফেল্লাম। সিএন টাওয়ারের সুপার স্পিড লিফট্ এর গতির মধ্যে একটা ভিন্নতা খুঁজে পেলাম। প্রতি ঘন্টায় প্রায় ২২ কিলোমিটার গতি সম্পন্ন সুপার স্পীড লিফট্ ে১,১২০ ফুট উচ্চতার অবজারভেশন টাওয়ার গ্লাস ফ্লোরে পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র ৫৮ সেকেন্ড। সিএন টাওয়ারের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর স্থান হলো এর গ্লাস ফ্লোর, যেখান থেকে নীচে তাকালে যে কোন মানুষের বুকের ভিতর ধরফর করবে। আমি দুর্বল চিত্তের মানুষ অনেক চেষ্টা করেও গ্লাসের উপর দাঁড়ানোর সাহস করতে পারি নাই। কাচের ফ্লোরের উপর দাঁড়ালে প্রায় ১,১২০ ফুট নীচের ছোট ছোট রাস্তা আর ফুলের বাগান পরিস্কার দেখা যায়। এক পাশে দেখলাম বিমান ওঠানামা করার ছোট্ট একটা এয়ার পোর্ট, উপর থেকে দেখতে আরো ছোট মনে হয়। অবজারভেশন টাওয়ারের ভিতর দিয়ে চারপাশটা ঘুরে মোটামুটি টরেন্টো শহরের প্রায় সবটুকুই দেখে ফেল্লাম। এরই মধ্যে একটা ট্রেন মাটির উপর দিয়ে চলতে চলতে আমার চোখের সামনেই আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে গেলো। বুঝলাম শহর এলাকার ভ‚মির সদ্বব্যাবহার এরা খুব ভালো ভাবেই করতে শিখেছে। সারারাত বাস চলে ভোর ছয়টার দিকে এসে পৌঁছালো ডিসি’র গ্রেহাউন্ডের নিজস্ব বাস ষ্ট্যান্ডে। (চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, ডেলসিটি, ভার্জিনিয়া, ইউএসএ