ইউসুফ কামাল : তখন হিউষ্টন এর এলজিস রোডের চ্যান্ডলার পার্ক এ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা আমি। চারিদিকে বাউন্ডারী গ্রীল দিয়ে ঘেরা আনুমানিক দশ একরের মতো জায়গা। একেবারে নিজস্ব মালিকানায় চ্যান্ডলার পার্ক কোম্পানীর গোটা পনেরোর মতো বিল্ডিং। প্রতিটা বিল্ডিং এ বারোটা করে ফ্ল্যাট। চারিদিকে খোলামেলা, বিল্ডিং ছাড়া ভিতরের পুরো এলাকাটি সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই করা, এক কথায় বলা চলে এপার্টমেন্টগুলো ভালোই বাসযোগ্য। বাইরে থেকে গেট দিয়ে ঢুকতে হলে গাড়িতে বসেই রিমোর্টে নির্দিষ্ট সংখ্যা টিপলে স্বংক্রীয়ভাবে গেট খুলে যাবে। আবার বের হবার সময়ও একইভাবে নির্দিষ্ট কোড দিয়ে গেট খুলতে হয়। সুন্দর ও সুরক্ষিত ব্যাবস্থা। কাছেই সমুদ্র যার কারণে সমগ্র এলাকার আবহাওয়া সমুদ্রের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভরশীল। সমুদ্রের তাপমাত্রার উপর গোটা হিউষ্টন শহরের তাপমাত্রা নির্ভর করে। বৃষ্টি হলে মনে হয় যেন বৃষ্টির ধারায় সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। এদের ড্রেনেজ ব্যাবস্থা এত ভালো যে সারাদিন মুসল ধারায় বৃষ্টি হলেও পাঁচ মিনিট পরে আর বৃষ্টির পানির দেখা মেলে না। যখন মুসল ধারায় চারিদিক অন্ধকার করে বৃষ্টি হতো, বাসার বারান্দায় প্লাস্টিকের ফোল্ডিং চেয়ারে বসে বৃষ্টির শব্দ শোনা আমার এক রকম নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। সামনে ফাঁকা জায়গা, উপর থেকে বৃষ্টির বড় বড় ফোটাগুলো অদ্ভুতভাবে ছন্দপতন না ঘটিয়ে ঝরতে থাকে। মনে হয়, না জানি কত দুর্দান্ত আকর্ষণে ছুটে আসে নীচে আপন জনের সাথে মিলিত হতে।

বারান্দার লাগোয়া ঝাকরা চুলের মতো দেখতে নাম না জানা মাঝারী আকারের ঘন পাতার একটা গাছ ছিলো। দুপুর বেলায় দেখতাম একটা কাঁঠ বিড়ালী গাছ বেয়ে বারবার উঠা নামা করতো আমি কয়েকদিন ধরে খেয়াল করেছি বারান্দার রেলিংয়ের উপর বসে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে, ও সুন্দর গোল গোল চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে পরিমাপ করতে চেষ্টা করতো। আমিও খুব মনোযোগ দিয়ে ওর গতিবিধি লক্ষ্য করতাম। প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি ওর উদ্দেশ্য। শুরুতে একটু শংকা বোধ করতাম, ওটা আবার লাফ দিয়ে আমার গায়ে পরবে না তো! পরে একদিন ছোট একটা বিস্কুট ওর দিকে ছুড়ে দিলাম আর সেটা ওর লুফে নেওয়ার ভাবে বুঝলাম ও কি পরিমাণ ক্ষুধার্ত! তার মানে বুঝলাম খাবারের জন্যই ওর ছুটে বেড়ানো। পরে প্রায় প্রতিদিনই যেন একটা অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিলো ওর সাথে আমার সখ্যতার। দুইটা করে বিস্কুট ওর জন্য বরাদ্দ থাকতো।

হিউষ্টনে বড় বড় তেল কোম্পানীর প্রধান কার্যালয়। একটু দূরে গ্যালভেস্টনে সমুদ্রের লম্বা সী বীচের বিপরিতে সারি সারি অপরিশোধিত জ্বালানী তেলের পরিশোধনাগার। সী বীচের বিপরীতের সমান্তরাল লম্বা সড়কের এক পাশ জুড়ে অগণিত তেল পরিশোধনাগার। সমুদ্রের মধ্যে সারি সারি প্রকান্ড বড় সব তেলবাহী জাহাজ, অপরিশোধিত তেল খালাস করতে আসা জাহাজগুলোকে দূরে সমুদ্রের মধ্যে আলোকজ্বল হয়ে ভাসতে দেখা যায়। সমগ্র এলাকাটা রাতের বেলায় বিদ্যুৎ এর আলোয় মনোরম দৃশ্যের রুপ নেয়। হিউষ্টনকে বলা হয় মহাকাশ গবেষণা (নাসা) ও আমেরিকার তেলের শহর। অনেকগুলো তেল কোম্পানীর সদর দপ্তরও এখানে। ৯ নাম্বার বিল্ডিং এর তিন তলায় সরাসরি ঠিক আমার উপরের এ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা ছিলেন ভারতের অন্ধ প্রদেশের বাসিন্দা, প্রায় মধ্য বয়সী অরবিন্দ সেন। আমেরিকার প্রসিদ্ধ তেল কোম্পানী কনকোফিলিপ্সস এর হিউষ্টনের কার্যালয়ে চাকুরী করেন সুদীর্ঘ সাত বছর ধরে।

কথাচ্ছলে একদিন জানলাম কনকোফিলিপ্স কোম্পানীর লসএ্যান্জেল্স অপিস থেকে বদলী হয়ে সাত বছর আগে হিউষ্টন এর প্রধান কার্যালয়ে এসেছেন, হিসাবরক্ষণ বিভাগের প্রধান হয়ে। চেহারা দেখেই বোঝা যায় অরবিন্দ সেন করিৎকর্মা মানুষ, সব সময় ধোপদুরস্ত হয়ে থাকেন। নিঃসন্তান অরবিন্দ সেনের স্ত্রী জয়া সেন তার স্বভাব সুলভ হাসি খুশী দিয়ে সবার সাথে মিলে মিশে থাকতেই যেন পছন্দ করেন। একটা সন্তানের জন্য অনেক রকম চিকিৎসা করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছেন সেন দম্পতি। মনের কষ্টটা মনেই লুকিয়ে রেখে সবার সাথে হাসি খুশী দিয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। কেন জানিনা অরবিন্দ আমাকে খুবই পছন্দ করতেন, নিজে চালাতেন ‘অডি’ গাড়ি আর তার স্ত্রী চালাতেন বি এম ডবিøউর নতুন ভার্সন।

পাঁচ ডিজিট সংখ্যার ডলারের বেতন, উপরন্ত অফিস থেকে অনেক রকম সুবিধা তো ছিলোই। পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্থিক নিরাপত্তা যে মানুষের মনে পরিপূর্ণ শান্তি আনতে পারে না অরবিন্দ সেনের মনের হাহাকার সেটার প্রমাণ। সন্তান সন্তানাদি না থাকায় চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর নিজের থেকেই দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। বল্লেন, এ দেশে থেকে আমার আর কি লাভ? দেশেই ফিরে যাব বাপ দাদার নিজস্ব ভিটায়। এ দেশে এসে মানুষ সন্তানাদির ভবিষৎ এর চিন্তা করে যত কষ্টই হোক না কেন থেকে যায়, সে চিন্তা যখন নাই তখন বাপের ভিটায় ফিরে যাওয়াই উচিত। অরবিন্দের দুঃখ তার নিজের কোন বংশধর রইলো না। ওর স্ত্রীর অভিমতও একই, স্বামীর চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর সেও দেশে ফিরে যেতে চায়।

অরবিন্দ ছুটির দিনে আমাকে নিয়ে মাঝে মাঝে লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়তেন। কোন দিন সুন্দর শহর অস্টিন, কোন দিন কেটি আবার কোন কোন দিন গ্যালভেষ্টনের সী বিচের বেঞ্চে বসে দু’জনে স্মৃতিচারণ করতাম। তবে আমি ভালো শ্রোতা হিসেবে প্রশংসনীয় ভ‚মিকা রাখতাম। অরবিন্দ নিজের দেশের কথা বলতে যেয়ে মাঝে মাঝেই উদাস দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতো গালফ্ অব মেক্সিকোর দিকে, বলতো আমার শহরও বংগোপসাগরের তীরে। প্রচন্ড রকমের ঝড় বৃষ্টি প্রবন এলাকা অন্ধ্র প্রদেশের সমুদ্র তীরবর্তি এলাকার মানুষ সে। মৌসুমী সামুদ্রিক ঝড়গুলো সাধারনতঃ অন্ধ্র প্রদেশ, ওড়িষ্যা ও বাংলাদেশের উপর দিয়েই প্রবাহিত হয়। অরবিন্দ যোগ করলো মাঝে মাঝেই মনে হয় ফিরে চলে যাই, আমার দেশ অন্ধ্রপ্রদেশের জেলা শহর অনন্তপুরে। পরম শান্তিতে ভরা বাড়ির দোতলার পূব পাশের ছোট্ট ঘরটিতে। মনে হয় সারা জীবনের পরম শান্তির স্থল যেন আমার ঐ একটাই। এখানে এলেই যেন আমার মা বাবার মায়াবী স্পর্শ টের পাই। ঐ বাড়িতেই আমার জন্ম আর জন্মের পর থেকে ঐ রুমই ছিলো আমার সব কিছু। বলা চলে আমার পৃথিবী, জীবনের বৃহত্তর পরিবেশে ঢোকার টার্নিং পয়েন্ট।

গালফ্ অব মেক্সিকোর মতই বংগপোসাগরও আমার কাছে একই রকম মনে হয়। উভয়েরই কুল কিনারা পাওয়া কঠিন। উভয় সাগরের উভয় প্রান্তগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ধর্ম চরিত্রের মানুষদের বসবাস।

প্রচন্ড জলরাশি নিয়ে এই মহা সমুদ্রগুলো যেন মানুষকে মানুষের কাছ থেকে যোজন যোজন দূরে সরিয়ে রেখেছে। এই মহা সাগরগুলোই যেন হাজারো মাইল দূরের একেক দেশের কৃষ্টি ও চালচলনকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
(চলবে)
ইউসুফ কামাল : লেখক, লালমাটিয়া, ঢাকা