মণিজিঞ্জির সান্যাল : সব মানুষই সবদিক দিয়ে একদম ঠিকঠাক, তার কোনো ভুল নেই তা তো হতে পারে না। আমরা মানুষ, প্রতিদিনের জীবনে, প্রতিদিনের চলার পথে আমরা অনেক ভুল করি। কিছু ভুল আবার আমাদের জীবনকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যায়। সেই ভুলের মাশুল আবার আমাদের কখনো দিতেও হয়। তাই সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, আবার যেন ভুলের খেসারত দিতে না হয়, নিজেদের ভুলগুলো সম্পর্কে যেন আমরা সবসময়ই সজাগ থাকি।
তাই আমরা অন্যের সমালোচনা কিংবা ভুল না ধরে, নিজের সমালোচনা করে নিজেকে ঋদ্ধ করতে পারি অনায়াসেই। আর জীবনের একটা ছোট ভুল ও অনেক সময় জীবনটাকে ছারখার করে দিতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।
আমরা অন্যের ভালো-মন্দের বিচার যেভাবে করতে পারি, সেভাবে নিজের ভালো-মন্দের বিচার করতে পারি না কিংবা করি না। কাউকে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয়, অপর একজন ব্যক্তির দশটি দোষ খুঁজে বের করতে, দেখা যাবে তিনি হয়তো ওই ব্যক্তির হাজারটা দোষ খুঁজে বের করে ফেলেছেন। আমরা অন্যের চলাফেরা, কথাবার্তায়, কাজকর্মে ও সার্বিক দিক বিবেচনা করে অনেক দোষ বা ভুল ধরতে পারি।
অনেকেই আছেন অন্যের ভুল বা দোষ নিয়ে একে অপরের সঙ্গে সমালোচনা করছেন। ভেবে দেখুন তো এটা কি ঠিক? এটা কি একদমই অনুচিত ও গর্হিত কাজ নয়? আমরা অন্যের ভুল বা দোষ খুঁজে বের করে তাকে সংশোধন করতে অনেক পরামর্শ দিয়ে থাকি, কিন্তু সেটা উচিত? ছিল নিজের জন্য করা। নিজের সমালোচনা করাই হচ্ছে আত্ম সমালোচনা।
আমরা তো মানুষ, আর এই মানুষই যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। অনেক সময় মনে হতেই পারে কেউ কি কারও ভালো চায় না? সবসময় সমালোচনা করা, অন্যের ত্রæটি খুঁজে ধরা, ভালো কি করল তা দেখে কজন? খারাপটা নিয়েই সবসময় পড়ে থাকা। যদিও সবাই এমনটা নয়, ব্যতিক্রমী নিশ্চয়ই আছেন।
কে কেমন করে হেঁটে গেলো! বা ওই মহিলার শাড়িটা রংটা কি অদ্ভুত? এই রংটা ওর গায়ের রংএর সঙ্গে মানায় না। এত্তো বাজে দেখাচ্ছে, ছি! ছেলেটি কেমন যেন মেয়ে মেয়ে। বা বোকা বোকা। এই হচ্ছে ঘরোয়া কথাবার্তা।
এরপর আসা যাক অফিসিয়াল কথাবার্তায়, ও আসলে কাজই জানে না, কিভাবে যে এই অফিস চলবে আমি তাই-ই বুঝি না- এই ধরনের কথা একমাত্র তারাই বলেন যারা নিজেকে বড় করতে, নিজের সুবিধাটাকে টিকিয়ে রাখতে এই রকম পরিবেশ তৈরী করেন।
লেখার জগত,অভিনয়, চিকিত্সা, শিল্প সংস্কৃতি অর্থাত ঘরে বাইরে প্রতিটি জগতের মানুষের মধ্যেই এমন ধরনের মানুষ মিশে আছেন।
সব জায়গাতেই এই ধরনের লোক থাকে। তারা চেষ্টা করেন কিভাবে নিজে বড় হয়ে অন্যদের ছোট করা যায়,অপমান করা যায়। এই ধরনের লোকজন আসলে যে নিজেদেরকেই ছোট করছেন, তারা এটাই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেন না।
আজকাল এ ধরনের মন্তব্য করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কে, কী করল? কার কী দোষ আছে? তা যাচাই বাছাই করা ইত্যাদি। আজকাল অনেক মানুষই আছেন যারা কারণে-অকারণে অন্যের দুর্বল দিকগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করে খুব মজা পান। কিন্তু নিজের সমালোচনা ক’জনই বা করেন?
এই শ্রেণীর মানুষের উচিত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজের বিবেককে প্রশ্ন করা। অন্যকে নিয়ে যে সমালোচনা করছেন, আসলেই কি তা ঠিক হচ্ছে? বিবেক ঠিকই সঠিক উত্তর দিবে। কারণ বিবেক সবসময় সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়।
আমরা যে অন্যের সমালোচনায় মত্ত থাকি, আমরা নিজের সম্পর্কে কতটাই বা জানি? নিজেকে আগে এই প্রশ্নগুলো করে দেখুন- ব্যক্তি হিসেবে আমি কতোটা পারফেক্ট? আমাদের কি কি দোষ ত্রæটি রয়েছে? তাহলেই দেখবেন একে একে নিজের খুঁত বা দুর্বলতা বের হয়ে আসছে এবং খুঁজে বের করাও কিন্তু খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তাহলে নিজের ইম্পারফেকশনগুলো খুঁজে নিয়ে তা সমাধান করতে আমাদের খুব একটা কষ্ট হবে না।
নিজের দোষগুলো খুঁজে বের করে তা সমাধানের দিকে নিয়ে আসা একটু কঠিন হলেও অসম্ভব কিছু তো নয়! কেননা, আমরা নিত্য নৈমিত্তিক অন্যের যে দোষ ত্রæটি দেখি বা শুনে থাকি, সেগুলো থেকে নিজেকে বিরত রাখাই হচ্ছে নিজের সমালোচনা করার প্রথম ধাপ।
অন্যের সমালোচনা প্রকাশ্যে বলে বেড়ানো কি ঠিক? মনে মনে নিজের বিবেককে প্রশ্ন করলেই চলবে। এতে বিবেক যেদিকে রায় দেবে না, সেদিকে না চললেই হবে। আর এটাই হচ্ছে আত্ম সমালোচনা, যা নিজেরই সমালোচনার ফলাফল।
ভালো একজন মানুষ হতে হলে অবশ্যই নিজেকে আগে জানতে হবে। আর যে নিজের সমালোচনা করতে পারে, সেই তো আসল বুদ্ধিমান। কারণ সে নিজেকে জানে, নিজের দোষ ত্রুটির খবর রাখে। অন্যকে জানার আগে নিজেকে জানা কি গুরুত্বপূর্ণ নয়?
প্রতিদিন আমাদের আত্ম সমালোচনা করা উচিত। এতে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হবে। কমে আসবে অপরের সমালোচনা। বর্তমানে আত্ম সমালোচনা না করার কারণে পরের সমালোচনাতেই আমরা ব্যস্ত। আর এতে সমাজ ও রাষ্ট্রে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।
আত্মসমালোচনার আভিধানিক অর্থ ‘নিজের সম্পর্কে সমালোচনা করা, নিজের কাজ সম্পর্কে আলোচনা করা। ইংরেজিতে একে বলা হয়, সেলফ ক্রিটিসিজম বা সেলফ অ্যাকাউন্টিবিলিটি অর্থাত আত্মসমালোচনা।
আসলে একজন মানুষকে চিন্তা করতে হবে, আমি কি আত্মনির্ভর, আমি কি নিজের কাজগুলো নিজে ঠিকঠাক পালন করতে পারছি? কারো কাছে কোনো বিষয়ে হাত পাতছি কি? আরো একটি বিষয়, সবাইকে নিয়ে চলতে হলে সবার আগে নিজেকে নিজের কাছে কিছু ক্ষমতা অর্জন করার কৌশল রপ্ত করতে হবে। সবার আগে নিজেকে জানতে ও চিনতে হবে। এরপর বাইরের দুনিয়াকে জানার পালা। অন্যের সমালোচনা করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলে সমাজও সুন্দর করা সম্ভব হবে।
আরো একটি বিষয় রেগে গেলে চলবে না। রেগে যাওয়া মানেই কিন্তু হেরে যাওয়া। একমাত্র আত্ম সমালোচনার মাধ্যমে নিজের আত্মশুদ্ধি সম্ভব। তাই পরিশুদ্ধ মানুষ হতে হলে আত্ম সমালোচনার কোনো বিকল্প নেই।
যারা সত্যিই নিজের আত্মসমলোচনা করতে চান তারা রাতে যখন ঘুমাতে যাবেন তখম সব চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাবুন। যেমন —
(১) আজকে সারাদিন কি করলেন।
(২) গতকালটি কেমন ছিল।
(৩) এই সপ্তাহে কি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন?
(৪) এই মাসে কোন কিছু কি মনে চাঞ্চল্যর সৃষ্টি করেছিল?
এইভাবে এক, দুই, তিন করে ডায়রিতে লিখলে খুব ভাল হয়।
তখন দেখবেন অনেক কিছু মনে পড়বে। একের পর এক ঘটনা বা দৃশ্য বা মুহূর্ত আপনাকে ভাবিয়ে তুলবে, তখন চিন্তা করবেন যে কাজটি কেমন ছিল। আবার যদি এরকম ঘটে তাহলে কি আগের মতই কাজটি করবেন নাকি অন্য কিছু।
এভাবে দেখবেন অনেক কিছুই আপনার সঠিক মনে হবে! আবার অনেক কিছু মনে হবে, “না, এরকম না করলেও চলত!” এভাবে নিজের সমালোচনা করে নিজের ভুল ত্রুটিগুলো নিজেই শোধরাতে পারবেন, আবার অনেক কিছু সুন্দরভাবে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার ধারণাও পেয়ে যাবেন। তবে কোন কারণেই অতিরিক্ত ভাবতে যাবেন না, সবকিছুই সীমার মধ্যে থাকা ভালো।
আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের কাজকে, বিশেষ করে নিজেকে অন্তরে এবং বাহ্যিক দিক দিয়ে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে পারেন অনায়াসেই।
মণিজিঞ্জির সান্যাল: লেখিকা, শিলিগুড়ি, দার্জিলিং
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ