অনলাইন ডেস্ক : ফ্রান্সের আদালতে উঠলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ। এই ইস্যুতে তৃতীয় একটি দেশ হিসেবে ফ্রান্সের এক আদালত এক বাংলাদেশিকে দেশটিতে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। ওই বাংলাদেশিকে দেশটি ছাড়ার আদেশ ছিল অন্য একটি আদালতের। এখন তাকে আর দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। ৪০ বছর বয়সী ওই বাংলাদেশির নাম জানা যায়নি। তিনি অ্যাজমায় আক্রান্ত। এ অবস্থায় তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হলে তা তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে বলে আদালত পর্যবেক্ষণ শেষে রায়ে বলেছেন। বাংলাদেশের বাতাস বিপজ্জনক মাত্রায় দূষিত।
এ বিষয়টি নতুন কোনো খবর নয়। কিন্তু যখন এই কারণে তৃতীয় একটি দেশ একজন বাংলাদেশির জীবন বিপন্ন হতে পারে বলে সেই অভিবাসীকে সেই দেশে থাকার অনুমতি দেয় তখনই এটা এক উদ্বেগজনক খবর। ফ্রান্সের বোর্ডেক্সে আপিল আদালত রায়ে বলেছেন, নিয়ম বলে ওই বাংলাদেশির দেশে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের বাতাস ভয়াবহ মাত্রায় দূষিত। এ জন্য তাকে তাড়িয়ে দেয়া যায় না। তাকে ফ্রান্সে থাকার অনুমতি দেয়া হলো। বৃটেনের প্রভাবশালী অনলাইন গার্ডিয়ান এই খবর প্রকাশ করেছে।
অ্যাজমা আর পরিবেশ দূষণ। এই দুই ইস্যুতে ফ্রান্সে প্রথমবারের মতো রক্ষা পেলেন ৪০ বছর বয়সী ওই বাংলাদেশি। তা না হলে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হতো। বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ হওয়ার পর আইনি লড়াই চলতে থাকে। তার পক্ষে অবস্থান নেন আইনজীবী লুডোভিচ রিভিয়ার। তিনি আদালতের কাছে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। জানান, তার মক্কেল অ্যাজমায় আক্রান্ত। এ অবস্থায় তাকে যদি বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয় তাহলে তার অবস্থার মারাত্মক অবনতি হওয়ার ঝুঁকি আছে। এমনকি তিনি আগেভাগে মারাও যেতে পারেন। তার নিজের দেশে ভয়াবহ মাত্রায় পরিবেশ দূষণের জন্য তিনি এমন অবনতিশীল অবস্থার শিকারে পরিণত হতে পারেন। ফলে আদালত ওই বাংলাদেশির পক্ষে রায় দেন। ফ্রান্সে এমন রায় এটাই প্রথম।
উল্লেখ্য, ইয়েল এবং কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল পারফরমেন্স সূচকে ২০২০ সালে বাতাসের গুণগত মানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৯তম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাতাসে সূক্ষ্ণ কণার সর্বোচ্চ যে মাত্রা সুপারিশ করেছে, এ সময়ে বাংলাদেশে তার চেয়ে ৬ গুণ বেশি ছিল এই কণা। পারিপার্শ্বিক ও বাড়িঘর থেকে যে বায়ুদূষণ হয় তা চরম মাত্রার এক ভয়াবহ ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে ৫ লাখ ৭২ হাজার ৬০০ মৃত্যুর ক্ষেত্রে চরম মাত্রায় ঝুঁকির একটি ফ্যাক্টর এই বায়ুদূষণ। গত নভেম্বরের শেষে এবং চলতি মাসের প্রথম দিকে ঢাকা পৃথিবীর দূর্ষিত শহরের শীর্ষে স্থান পায়। এর প্রেক্ষাপটে আদালতকে জানানো হয় যে, বাংলাদেশি ওই ব্যক্তি ফ্রান্সে যে ওষুধ সেবন করছেন তা বাংলাদেশে পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া হাসপাতালে অবস্থানকালে ওই বাংলাদেশিকে রাতে ঘুমানোর সময় শুধু রাত্রিকালীন ভেন্টিলেশন সরঞ্জাম সুবিধা দিতে পারে বাংলাদেশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
আদালতে আরো তথ্যপ্রমাণ হিসেবে বলা হয়, ওই বাংলাদেশির পিতা ৫৪ বছর বয়সে অ্যাজমায় মারা গেছেন। আইনজীবী লুডোভিচ রিভিয়ার বলেছেন, ফ্রান্সে পৌঁছার পর সেখানে চিকিৎসা নেয়া শুরু করেছেন ওই বাংলাদেশি। এর ফলে ২০১৩ সালে তার শ্বাসযন্ত্রের সক্ষমতা ছিল শতকরা মাত্র ৫৮ ভাগ। চিকিৎসা নেয়ার পর ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৭০ ভাগ। লুডোভিচ রিভিয়ার বলেন, এসব কারণে আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, আমার মক্কেলকে তার দেশে ফেরত পাঠানো হলে তাকে প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দেয়া হয়।
বাংলাদেশে অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে ২০১১ সালে ওই ব্যক্তি পালিয়ে ফ্রান্সে যান। সেখানে টোলুসে তিনি একজন ওয়েটার হিসেবে কাজ নেন। বিদেশি নাগরিকের চিকিৎসা প্রয়োজনীয়তার ওপর ভিত্তি করে তাকে অস্থায়ী ভিত্তিতে আবাসিক অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু ২০১৭ সালে চিকিৎসকরা ফরাসি অভিবাসন বিষয়ক কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করে। তাতে তারা বলে যে, তার যে অবস্থা তা বাংলাদেশে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। এর দু’বছর পরে স্থানীয় হাউতি-গ্যারোনি কর্তৃপক্ষ তাকে ফ্রান্স ছাড়ার নোটিশ দেয়। গত বছরের জুনে তাকে ফেরত পাঠানোর নির্দেশের বিরুদ্ধে রায় দেয় টোলুসের নিম্ন আদালত। ওই আদালত এটা আমলে নেয় যে, ওই ব্যক্তির নিজের দেশ বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট ওষুধ পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু হাউতি-গ্যারোনি কর্তৃপক্ষ আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে। সেই আপিল প্রত্যাখ্যান করেছে বোর্ডেক্সের আদালত। বিচারক বলেছেন, এক্ষেত্রে পরিবেশগত বিষয় মানদণ্ড হিসেবে অবশ্যই আমলে নিতে হবে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের বায়ুদূষণ বিষয়ক বিজ্ঞানী ড. গ্যারি ফুলার বলেছেন, পরিবেশগত কারণে কোনো প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়া আটকে দেয়ার কথা তিনি এই প্রথম শুনতে পেয়েছেন। আদালত যথার্থই ঘোষণা করেছে যে, পরিবেশ, বিশেষ করে বায়ুদূষণ একজন ব্যক্তির জন্য অনিরাপদ হতে পারে। এ জন্য তাকে তার দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে রাজধানী ঢাকাকে বিশ্বের ২১তম দূষিত শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে বায়ু দূষণের কারণে মারা গেছেন কমপক্ষে এক লাখ ৭০ হাজার মানুষ।