ডঃ বাহারুল হক : নিউ ইয়র্ক আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ একটি মেগাসিটি। এই শহরে দর্শনীয় স্থান কি কম আছে? পরের দিন আমরা বের হলাম স্টাচু অব লিবার্টি দেখার জন্য। এই স্টাচু অব লিবার্টিকে বাংলায় বলা যায় স্বাধীনতা মূর্তি। এই মূর্তি দেখার অদম্য অভিলাষ নিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ হাজির হয এই মূর্তির সামনে। ফলে অগ্রিম টিকেট না করলে যাবো- টিকেট নেবো- ঢুকবো এটা হয় না। টিকেট অগ্রিম নিয়ে রাখতে হয়। নাছির ভাই আমাদের সকলের জন্য আগে ভাগে টিকেট নিয়ে রেখে ছিলেন। ফলে আমাদের কাজ হলো যাওয়া- দেখা। গাড়ি চালাচ্ছেন নাছির ভাই আমি তার পাশের সিটে বসা। ভালো কথা, গত পর্বে ম্যানহাটানের ভ্যাসেল সম্মন্ধে কথা শেষ করিনি। ভ্যাসেলে প্রবেশ এখন একেবারে নিষিদ্ধ। কেন নিষিদ্ধ সেটাই নাছির ভাইর মুখ থেকে শুনলাম।

সিঁড়ি কেন্দ্রিক (২৫০০টি সিঁড়ি) নান্দনিক এই ভবন সর্বসাধারনের জন্য খুলে দেয়া হয় ২০১৯ সনে। তারপর শুরু হয় ভ্যাসেলে উঠে লাফ দিয়ে নিচে পড়ে দর্শনার্থীর আত্মহত্যা। ফেব্রæয়ারি ২০২০ সনে প্রথম আত্মহত্যা করে ১৪ বছর বয়সী এক বালক। তারপর কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করে ১৫ বছরের নিচের বয়সী কোন দর্শনার্থীকে অভিভাবক ছাড়া ভ্যাসেলে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হবে না। বেশ; অভিভাবক নিয়ে তারা ভ্যাসেল দেখছে। কিন্তু বিধি বাম। সে বছরই ডিসেম্বর মাসে ২৪ বছর বয়সী এক মহিলা হঠাৎ লাফ দিল ভ্যাসেলের ১৫ তলা থেকে। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সনের মার্চ মাসে ১৯ বছর বয়সী এক যুবক ভ্যাসেল থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করলো। এভাবে একের পর এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটায় ভ্যাসেল কর্তৃপক্ষ ভ্যাসেলে প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিল। দুইমাস বন্ধ রেখে ভ্যাসেল জুন মাসে আবার দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হলো। কিন্তু সবাই হতভম্ব হয়ে গেল যখন ২০২১ সনের জুলাই মাসে ২১ বছর বয়সী এক যুবক হঠাৎ ১১ তলা থেকে লাফ দিয়ে শত শত দর্শনার্থীদের সামনে লাশ হয়ে গেল। কর্তৃপক্ষ আর কি করবে, ভ্যাসেলে প্রবেশ অনির্দৃষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিল। তবে আর্কিটেক্ট ও আত্মহত্যা রোধ বিশেষজ্ঞ নিয়ে কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। কাজ করছে এই ভবনের আর্কিটেকচারাল ডিজাইন কেন দর্শনার্থীদের মনের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবনতা সৃষ্টি করে এবং কি করলে দর্শানার্থীদের আত্মহত্যার প্রবনতা রোধ করা যাবে তা জানার জন্য। প্রায় বিশ মিনিট পথ চলার পর নাছির ভাই এক জায়গায় থামলেন আমরা নেমে গেলাম। নাছির ভাই তার গাড়ি পার্ক করলেন। তারপর একটা ভাড়ার ট্যাক্সি ডেকে আমাদের সেই টেক্সিতে উঠালেন এবং তিনি নিজেও উঠে বসলেন। ট্যাক্সি যাত্রীদের নিয়ে সোজা চলে গেল ফেরি ঘাটে। আগেই বলেছি আমাদের গন্তব্য স্থল হলো লিবার্টি আইল্যান্ড যেখানে আছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি যা দেখতে শত শত মানুষের ভিড় লেগে থাকে দিনভর। লিবার্টি আইল্যান্ডের পাশেই আছে এলিস আইল্যান্ড। দুটো আইল্যান্ড পাশা পাশিভাবে অবস্থান করছে নিউ ইয়র্ক উপসাগরে; তবে মূল ভুমি থেকে বেশি দূরে নয়। ফেরিতে ২৫/ ৩০ মিনিট সময় লাগে। আইল্যান্ডে যাওয়া -আসার জন্য যান হিসেবে আছে দুটো ফেরি। ফেরিঘাটে আমরা অপেক্ষা করছিলাম ফেরির জন্য। এখানে সুযোগ পেয়ে নাছির ভাইর কাছে জানতে চাইলাম কেন তিনি তার গাড়ি নিয়ে ফেরিঘাট পর্যন্ত আসলেন না। ইতোমধ্যে ফেরি এসে ঘাটে ভিড়লো। খালি হলে আমাদের উঠার ডাক পড়লো। ফেরির ক্যারিং ক্যাপাসিটি দেখার জন্য ফেরিতে আগমনী ভিজিটরদের সংখ্যা আমি গুনলাম এবং দেখলাম তিন শত জন। আমরা ফেরিতে উঠে গেলাম। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন একটা ফেরি। বসার চমৎকার ব্যাবস্থা আছে। আমি বসলাম না। সাগর, পানি, চতুর্দিক দেখার অভিলাসে ফেরির কিনার ঘেসে অন্যান্য ভিজিটরদের পাশে দাঁড়ালাম। সবার চোখ দূরে দৃশ্যমান লিবার্টি আইল্যান্ডের দিকে। আমি শুধু তাকিয়ে আছি বিপরীত দিকে। ফেরি যত কিনার থেকে দূরে যাচ্ছে কিনারে ভ‚মির উপর দাঁড়িয়ে থাকা দৃষ্টিনন্দন ইমারতগুলো আমার চোখে আরো সুন্দর হয়ে ফোটে উঠছে। ফেরিতে না উঠলে নিউ ইয়র্কের এই অংশের এই অপরুপ দেখতে পেতাম না। ফেরি দূরে যাচ্ছে আর আমার চোখের সামনে ক্যানভাসও স¤প্রসারিত হচ্ছে। এবার আইল্যান্ডের দিকে মুখ ফিরালাম। দেখি ফেরি ছুটে যাচ্ছে লিবার্টি আইল্যান্ডের দিকে, এলিস আইল্যান্ডের দিকে নয়। ফেরি যতই আইল্যান্ডের কাছে যাচ্ছে ততই মূর্তি স্পস্ট হচ্ছে। ফেরি প্রায় ঘাটের কাছে। একটা মোড় নিলেই ঘাট। মূর্তি এবার একেবারে স্পস্ট। দেখা যাচ্ছে বিরাট মূর্তি ততোধিক বিরাট বেদির উপর দন্ডায়মান। মূর্তির মুখ সাগরের সেই পথের দিকে যে পথে জলযানগুলো বন্দরে ভিড়ে এবং বন্দর থেকে আবার সাগরের বুকে ছুটে যায়। ডান হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তি। ফেরি ভিড়লে আমরা নেমে পড়লাম। নামার পর আমার মধ্যে একটা অসম্ভব ভালো লাগার অনুভুতি সৃষ্টি হলো। কারণ এ মূর্তি দেখার জন্য আমি বহু আগে থেকে উদগ্রীব ছিলাম। ফেরি ঘাট থেকে কিছু পথ হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম মূর্তির কাছে। নারী মূর্তিটি তৈরিতে স্টীল আর কপার ব্যাবহার করা হয়েছে। তবে স্টীলই বেশি। স্টীল ১১৩ টন অপরদিকে কপার মাত্র ২৭ টন। মূর্তির উচ্চতা ১৫১ ফুট আর ওজন ২০৪ টন। বেদির উচ্চতা ১৫৪ ফুট। তাহলে বেদির গোড়া থেকে মূর্তির হাতে ধরা মশালের শীর্ষ স্থান পর্যন্ত মোট উচ্চতা হয়ে গেল ৩০৫ ফুট। মূর্তির ডান হাতে আছে একটা মশাল যা জ্ঞানের প্রতীক; আরেক হাতে আছে একটা বই যার উপর লেখা আছে (সংখ্যা রোমান ভাষায় লিখা) IV জুলাই MDCCLXXVI (৪ জুলাই, ১৭৭৬); এই তারিখটা আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। আমেরিকা বৃটিশ বন্ধন থেকে মুক্ত হয় এই দিনে।

প্রাচীনকালে রোমানরা এক দেবীর পুজা করতো যার নাম ছিল লিবার্টাস। লিবার্টাস ছিল মুক্তি ও স্বাধীনতার দেবী। ইংরেজি লিবার্টি শব্দটিও এসেছে লিবার্টাস শব্দ থেকে। সেই জন্য স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে এই নারী মূর্তি। মূর্তির ডান হাতে আছে মশাল যা দিয়ে বিশ্ব ব্রম্মান্ডকে তার অসীম জ্ঞানের আলোতে উদ্ভাসিত করবার বাসনা বুঝাচ্ছে। মূর্তির হাতে ধরা এই মশালটির উপর সোনার আস্তর দেয়া হয়েছে। রাত্রি বেলায় এই মূর্তির উপর এমনভাবে আলো প্রক্ষেপন করা হয় যে মনে হয় মশালটি জলন্ত। মূর্তির মাথায় বর বড় সাতটি স্পাইক বসানো হয়েছে। মূর্তির মাথায় স্পাইক লাগিয়ে মাথাটাকে প্রোজ্জলিত সুর্য্যের রুপ দেয়া হয়েছে যে সুর্য্য সকল শক্তির উৎস এবং যে সুর্য্য অবিনাসী। স্পাইকগুলো আলোকরশ্মির প্রতিচ্ছবি। তবে স্পাইকের সংখ্যা সাত হওয়াতে কেউ কেউ বলে, না, এটা সাতটা মহাদেশ ও সাতটা মহাসমুদ্রের প্রতীক। যাই হোক, আমেরিকানদের কাছে স্টাচু অব লিবার্টি স্বাধীনতার প্রতীক। এটি আমেরিকা উপহার হিসেবে পেয়েছিল ফ্রাঞ্চের কাছ থেকে। বলা হয়েছিল ফ্রাঞ্চবাসির পক্ষ থেকে আমেরিকান বন্ধুদের জন্য প্রীতি উপহার। এর উদ্বোধন হয় ১৮৮৬ সনে আমেরিকার জন্মের ১০০ বছর পুর্ণ হয় যেদিন সেদিন। সে আমলে এটি ছিল নিউ ইয়র্কের সব থেকে উঁচা স্ট্রাকচার। ১৯৮৪ সনে স্টাচু অব লিবার্টিকে “ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট” হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইউনেস্কোর “স্টেটমেন্ট অব সিগ্নীফিকেন্স” স্টাচু অব লিবার্টিকে “মাস্টারপিস অব দি হিউম্যান স্পিরিট” বলে বর্ণনা করেছে। বেদির এক পাশে প্রবেশ পথ আছে। আমরা সে পথ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। তবে মূর্তির ভিতরে নয়। এখনও বেদিতে। বেদির শীর্ষদেশে চতুর্দিকে খোলা ঝুল বারান্দা। সে বারান্দায় হেঁটে মূর্তিকে অনুকরন করে সাগর পানে তাকিয়ে থাকা যায়। নির্বিঘেœ দেখা যায় দূরের নিউ ইয়র্ক নগরী, বন্দর, জাহাজের আনাগোনা, হাডসন নদীর মোহনা, যেখানে সর্বদা চলছে নিউ ইয়র্ক উপ সাগরের জলের সাথে হাডসন নদীর জলের হা-ডু-ডু হেলা। আর উপরের দিকে তাকালেই সেই রোমান স্বাধীনতা দেবী লিবার্টাসের অবয়বধারী বিরাট নারী মূর্তি লিবার্টি যার কোমল দৃষ্টিতে দর্শনার্থীদের মনে সৃষ্টি হয় স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকার উদগ্র এক বাসনা। দিন নেই রাত নেই চব্বিশ ঘন্টা এই মূর্তি যেন অগ্রগতি সভ্যতা কোমলতা রোধকারী সকল বন্ধনের বিরুদ্ধ শক্তি মুক্তির এক অবিনাসী অতন্দ্র প্রহরী। আমি নিবিষ্ট মনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম মূর্তির ঠোঁট, গাল, নাক, কপাল, আর দেখলাম এসব মিলিয়ে মূর্তির মুখে যথার্থভাবে ফোটে উঠা প্রবল ব্যাক্তিত্বের এক নিটোল ভাব। মূর্তির দুটো হাত দেখলাম। হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সেই বিখ্যাত কবিতার চরন- “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আরেক হাতে রণ- তূর্য্য”। না, না, এ তো বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের মূর্তি নয়। এ যে মুক্তির দেবী লিবার্টাস। এর এক হাতে মশাল আরেক হাতে পুস্তক। একটা অবিনাসী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেতো তাকিয়েই আছে। এ দৃষ্টির কোন সীমা পরিসীমা নাই। মিউজিয়াম ঘুরে জানতে পারি এই মূর্তি নিউ ইয়র্কে তৈরি করা হয়নি। মূর্তির ডিজাইন পাস হওয়ার পর শুরু হয় কপার আর স্টীল দিয়ে বিভিন্ন খন্ড নির্মাণ। খন্ডগুলো ফ্রাঞ্চে নির্মাণ করার পর শুরু হয় বিশাল বিশাল খন্ডগুলোকে জাহাজে ভরে নিউ ইয়র্ক পাঠানোর কাজ। এদিকে চলতে থাকলো বেদি নির্মাণ কাজ।

বেদি নির্মাণ শেষ হলো। মূর্তির খন্ডগুলোও চলে এল। খন্ডগুলোকে নিখুঁতভাবে বসিয়ে, নিখুঁতভাবে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হলো দুইশত চার টন ওজনের বিরাট নারী মূর্তি- স্টাচু অব লিবার্টি, ইউনেস্কোর স্টেটমেন্ট অব সিগনিফিকেন্স – এর বর্ণনায়ও যেটিকে অভিহিত করা হয়েছে মাস্টারপিস অব দি হিউম্যান স্পিরিট। মিউজিয়াম না দেখলে এই মূর্তিকে চেনা – বুঝা যায় না। খন্ডগুলো কিভাবে নির্মাণ করা হলো, ফ্রাঞ্চ থেকে কেমন করে নিউ ইয়র্ক আনা হলো, আনার পর কিভাবে সেগুলোকে বেদির উপর বসানো হলো সে সব চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। শুরু থেকে শেষ অবদি কাজের বাৎসরিক অগ্রতির চিত্রও মিউজিয়ামে আছে। মূর্তির শুরু থেকে শেষ দেখলে মনে হবে মায়ের জরায়ুতে ক্রম রুপান্তরের মাধ্যমে শিশুর জন্ম দেখছি। শুক্রানু ডিম্বানুর মিলন, জাইগোট হওয়া, তারপর সে জাইগোট থেকে ভ্রæন হওয়া, তারপর জরায়ুর ভিতরে ভ্রæনের মানব শিশুতে রুপান্তরিত হওয়া যেমন ঠিক সেরকমই মনে হলো পুরো প্রক্রিয়াকে। খন্ড হলো, সেগুলোকে বয়ে নেয়া হলো নিউ ইয়র্ক। সেখানে খন্ডগুলো জোড়া লাগিয়ে বানানো হলো স্টাচু অব লিবার্টি। এ মূর্তি নির্মানে কি পরিমান অর্থ ব্যায় হলো, কিভাবে ফান্ড রেইজিং হলো, স্থপতি কে, এটি নির্মানে কতটা জীবনঘাতী দুর্ঘটনা ঘটলো, এ সব কিছু লেখা আছে মিউজিয়ামের বিভিন্ন কক্ষে। দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল আমি আর এ সময়ে নাই , চলে গেছি একশত পঞ্চাশ বছর পুর্বের এক সময়ে। স্টাচু অব লিবার্টি আইল্যান্ড দেখা শেষ হলে আমরা উঠলাম ফেরিতে। এবার ফিরে যাওয়ার পালা। তবে ফেরি আমাদেরকে নিয়ে গেল এলিস আইল্যান্ডে। (চলবে)