আফতাব হোসেন : বাবার নাম আমজাদ হোসেন। দাদার নাম আফসার উদ্দিন। দুজনের নামই আ দিয়ে শুরু। বাপ দাদার নামের সাথে মিল রেখেই বোধহয় আমার নাম রাখা হয়েছিল আফতাব হোসেন। তবে সবাই ডাকত ফিরুজ বলে। যাকে বলে ডাক নাম। আর আফতাব হোসেন ছিল আমার ভালো নাম বা কেতাবি নাম। সেই কেতাবি নামেই স্কুলে ভর্তি হলাম। বন্ধুরা, খেলার সাথীরা আমাকে আফতাব নামে ডাকতে শুরু করল। আস্তে আস্তে আমার খুব প্রিয় ডাক নামটি টিকটিকির লেজের মতো খসে পড়ে গেল। গুটিকয় একান্ত নিকটাত্মীয় ছাড়া কেউ আর ফিরুজ নামে ডাকত না। এমনকি মাঝে মাঝে আমার মা যখন আফতাব বলে ডাক দিতেন, মনে হত আমার মা নয়, প্রতিবেশী কিংবা কোনো বন্ধুর মা ডাকছেন।
একজন মানুষকে শনাক্ত করার জন্য তো একটা নামই হওয়া উচিত। কেন যে বাঙ্গালিরা একজন মানুষের দু দুটো নাম রাখে, কোনদিন আমার মাথায় আসেনি। সে রাখুক। তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। মাথা ব্যথা শুরু হল তখন, যখন বুঝলাম, কোনো নিয়ম নীতি না মেনেই বাঙ্গালিরা নাম রাখে। যেমন বাঙ্গালি মুসলমানরা নামের আগে মোহাম্মদ জুড়ে দেন, অনেকটা পদবীর মতো। হয়ত নবী মোহাম্মদ (সঃ) এর প্রতি ভালোবাসা কিংবা সম্মান প্রদর্শনের জন্য। কিন্তু সেই ভালোবাসা কিংবা সম্মান যখন নিতান্তই একটা লৌকিকতা হয়ে যায়, তখন বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমার নামের সামনেও মোহাম্মদ জুড়ে দেয়া হল। তাতেও অসুবিধা ছিল না। অসুবিধা হল, যখন সেই মোহাম্মদকে সংক্ষিপ্তাকারে মোঃ কিংবা ইংরেজিতে MD লেখা হল। আমার সব সার্টিফিকেটে নাম মোঃ আফতাব হোসেন কিংবা MD Aftab Hossain হিসেবে মুদ্রিত হল।
১৯৯০ সালে ইরান যাবার আগে পাসপোর্ট করতে হল। সার্টিফিকেটের সাথে মিল রেখে পাসপোর্টের নাম হল MD Aftab Hossain. বিপ্লবোত্তর ইরান তখন কট্টর ইসলামী দেশ। অথচ সে দেশে গিয়ে দেখলাম, কারও নামের সামনেই মোহাম্মদ পদবী নেই।
মোহাম্মদ নামের অনেক মুসলমানই আছে, কিন্তু মোহাম্মদ পদবীধারী কোনো মুসলমান নেই। তারা কি বাঙ্গালি মুসলমানদের মতো নবী মোহাম্মদ (সঃ) ভালোবাসে না? কোনো দিন জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে সেখানে আমার নামের সামনে এমডি নিয়ে কোনো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। নাম জানতে চাইলে তো আর পাসপোর্ট দেখাতে হত না। বলতাম,
– মান দকতোর আফতাব হোসেন হাস্তাম।
ওরা সম্মান করে ডাকত, দকতোর হোসেন। ফিরুজ নয়, আফতাব নয়, হোসেন নামেই কেটে গেল তিনটা বছর।
ইরান থেকে ফিরে সৌদি আরব যাবার জোগাড় যন্তর শুরু করলাম। যথা সময়ে ভিসাও চলে এলো। কিন্তু এলো, মোহাম্মদ আফতাব হোসেন এর নামে। আরবিতে তো আর মোহাম্মদকে সংক্ষিপ্ত করে মীম লেখার রেওয়াজ নেই! সৌদি যেতে হলে ভিসার সাথে পাসপোর্ট নামের হুবহু মিল থাকতে হবে। তাই পুরনো পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে নতুন পাসপোর্ট করতে হল, Mohammed Aftab Hossain নাম দিয়ে। নবী মোহাম্মদ (সঃ) এর পুণ্য ভূমি সৌদি আরবের প্রায় অর্ধেক মানুষের নাম হয় মোহাম্মদ কিংবা আহম্মদ। সৌদিরা ওদের নামের প্রথম অংশে নিজের নাম, দ্বিতীয় অংশে বাবার নাম এবং তৃতীয় অংশে দাদার নাম কিংবা বংশের নাম দিয়ে রাখে। স্বভাবতই ওরা মনে করল, আমার নাম মোহাম্মদ, বাবার নাম আফতাব আর দাদার নাম হোসেন। মর জ্বালা। অগো কেমনে বুঝাই, অত নিয়ম কানুন মাইনা আমাগো দ্যাশে কেউ নাম রাখে না। আমার তো খালি তিন শব্দের নাম। অনেকের তো পাঁচ ছয় শব্দের নাম আছে। যেমন আমার এক বন্ধুর নাম আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফরহাদ ইমরান চৌধুরী, সংক্ষেপে এ এস এম এফ ইমরান চৌধুরী। আরবিতে যার অর্থ হল, সাইদের বাবা মোহাম্মদ, তার বাবা ফরহাদ, তার বাবা ইমরান আর বংশ চৌধুরী। অথচ ইমরানের চৌদ্দ পুরুষেও এই সব নামে কেউ নাই। স্টাইল কইরা বাপ মায়ে এই নাম রাখছিল।
যাই হোক, আমি ওদের কাছে হয়ে গেলাম দকতোর মোহাম্মদ। ফিরুজ নাম তো আগেই মুছে গিয়েছিল, ছয় বছরে আফতাব নামটাও মোছার উপক্রম হল! ভাগ্যিস কিছু বাঙ্গালি/ভারতীয় ডাক্তার ও বন্ধুরা আমার বাপ দাদার আমলের নামটি মাঝে মাঝে স্মরণ করিয়ে দিত।
সৌদির পাট শেষে গজঈচ পরীক্ষা দিতে ইংল্যান্ড যাবার সময় হল। একই পাসপোর্ট নিয়ে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য ব্রিটিশ এম্বাসীতে দাঁড়ালাম। ব্রিটিশরা বেনিয়ার জাত। কোনো ম্যাচিঙর স্টুডেন্ট ওদের দেশে পরীক্ষা দিতে যাওয়া মানে পকেটে ভর্তি করে এক কাড়ি পাউন্ড নিয়ে যাওয়া। সার্টিফিকেটের সাথে পাসপোর্টের নামের বানানে অমিল থাকা সত্তে¡ও ভিসা দিতে খুব একটা গাইগুই করল না। কিংবা বাংলাদেশে ব্রিটিশ এম্বাসীর কর্মকর্তারা বাঙ্গালিদের এই নাম বিভ্রাটের সাথে পরিচিত। তাই গাইগুই করার প্রয়োজন মনে করল না।
সৌদি বসে রক্ত ঘাম করা কড়কড়ে দশ হাজার পাউন্ড সাথে নিয়ে ইংল্যান্ড এলাম। হাঁসপাতাল ডরমিটরিতে থাকি। টাকাগুলো সারাক্ষণ পকেটেই রাখি পাছে চুরি হয়ে যায়। সেখানে এক সম্ভ্রান্ত বাঙ্গালি পরিবারের সাথে খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গিয়েছিল। একদিন বললাম,
– আংকেল, টাকাগুলো আপনাদের বাসায় রাখেন।
পকেট থেকে অতগুলো পাউন্ড বের করতে দেখে তো তার চক্ষু চড়ক গাছ। বললেন,
– হায় হায়, কও কী মিয়াঁ? এই দ্যাশে এত টাকা তো দূরের কথা, পঞ্চাশ পাউন্ডও কেউ পকেটে রাখে না। ড্রাগীরা টের পাইলে তোমারে চ্যাংদোলা কইরা শ্বশুর বাড়ি লইয়া যাইব। আর বাসায় ক্যাশ রাখার তো প্রশ্নই ওঠে না। এখানে সবাই ক্রেডিট কার্ড কিংবা ব্যাংক কার্ড ব্যবহার করে।
শুনে আমার গলা শুকিয়ে গেল। ফ্যাসফ্যাসে গলায় জানতে চাইলাম,
– তাইলে কী করব আংকেল? আমার তো ক্রেডিট কার্ডও নাই, ব্যাংক কার্ডও নাই!
– অসুবিধা নাই। চলো, তোমারে ব্যাংকে একাউন্ট কইরা দেই। ওরা ব্যাংক কার্ড ইস্যু করে দেবে।
ভদ্রলোক ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করতেন। ব্যাংকের সাথে বেশ ভালোই খাতির। তখনও এ দেশে মানি লন্ডারিং রেগুলেশন এত কড়াকড়ি হয়নি। ছাত্ররা চাইলেই ব্যাংক একাউন্ট খুলতে পারত। একদিন কয়েক মিনিটের মধ্যেই ব্যাংক একাউন্ট খুলে দিলেন। খুলে দিলেন পাসপোর্টের নাম অনুসারে। Mohammed Aftab Hossain এর নামে।
কিন্তু ঝামেলা বাধল অন্য খানে। MRCP, PLAB, ইত্যাদি পরীক্ষা দিতে হলে সার্টিফিকেটের সাথে ফটো আইডেন্টিটি অর্থাত পাসপোর্টের নামের মিল থাকতে হবে। তার মানে দাঁড়াল, হয় আমাকে সার্টিফিকেটের নাম বদলাতে হবে, নয়ত পাসপোর্টের নাম বদলাতে হবে। ইংল্যান্ডে বসে যেহেতু সার্টিফিকেটের নাম বদলানো সম্ভব নয়, পাসপোর্টের নাম বদলানোই একমাত্র উপায়। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। সাথে মামা আর টাকার জোর থাকলে তো কথাই নেই। চাইলেই দিনকে রাত, রাতকে দিন করে দেয়া যায়। কথাটা বোধহয় শুধু বাংলাদেশে নয়, যেখানে যেখানে বাঙ্গালিরা আছে, সেখানেও প্রযোজ্য। ভাগ্যক্রমে আমার এক বন্ধু লন্ডনের বাংলাদেশ হাই কমিশনের বড় কর্মকর্তা। তাকে বলতেই একদিনে পাসপোর্টের Mohammed কেটে MD করে দিলেন।
বংশ পরম্পরা রক্ষা করতে আমার ছেলের নামও রেখেছিলাম, আ দিয়ে, আরিয়ান। যার অর্থ সোনালী জীবন বা উন্নত জীবন। ওর নানা বললেন, সাথে সাদ যোগ করে দাও। যার অর্থ বিশ্বাসী। আরিয়ান সাদ। বেশ অন্য রকম নাম। তবে নামের সামনে মোঃ কিংবা এমডি যোগ করলাম না। ভাবলাম, নামের সামনে মোঃ পদবী লাগিয়ে নবী (সঃ) এর প্রতি ভালোবাসা দেখানোর দরকার নেই, বরং বুকের মধ্যে ভালোবাসা থাকলেই চলবে। তাতেও বিড়ম্বনা থেকে রক্ষা পাওয়া গেল না। প্যারেন্টস ডে তে ছেলের স্কুলে গেলে টিচাররা আমাকে ডাকত মি সাদ বলে। ওরা মনে করল, ছেলে নিশ্চয়ই আমার নামটা তার শেষ নাম (surname) হিসেবে ব্যবহার করছে। এখানেই শেষ নয়। বউয়ের নাম হেলেন আক্তার। তাকে কোনো ডাক্তার কিংবা অপ্টেসিয়ানের কাছে নিয়ে গেলে তারা আমাকে ডাকত মি আক্তার। কারণ বিয়ের পরে এ দেশে মেয়েরা স্বামীর সারনেম ব্যবহার করে। আমার তো “আমি কার খালু” অবস্থা। মনের দুঃখে কিছু বলতাম না। কত জনের ভুল ভাঙ্গানো যায়? ডাকুক, যার যা খুশি ডাকুক, আমার কিচ্ছু আসে যায় না।
এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হল না। ব্রিটেনের মানুষ অনেক আগে থেকেই ডিজিটালাইজড। করোনা তাঁদের অতি ডিজিটালাইজড করে দিয়েছে। সব কিছু ভার্চুয়াল। প্রায় সব কাজ অনলাইনে করা যায়। ছেলে বড় হয়েছে। ঋষি মুনি টাইপের ছেলে। বৈষয়িক জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। একমাত্র ছেলে। ভবিষ্যতে কী করে খাবে কে জানে? ভাবলাম ওর নামে একটা কোম্পানি খুলে দেই। আমার একাউন্ট্যান্ট থাকে লন্ডন থেকে তিনশো মাইল দূরে। ফোন করে বললাম,
– জন, একটা কোম্পানি খুলতে চাই। কবে আসব?
– তোমাকে আসতে হবে না। ডিটেইলস পাঠিয়ে দাও। আমি ঘরে বসেই অনলাইনে খুলে দিচ্ছি।
বাহ, ঘরে বসে কোম্পানি খোলা? যেই বলা, সেই কাজ। আমি ডিটেইলস, মানে কোম্পানির নাম, ঠিকানা, ডিরেক্টরদের নাম, ইত্যাদি সব পাঠিয়ে দিলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সে কোম্পানি হাউজে নতুন কোম্পানি রেজিস্ট্রি করে ফেলল। আমি কোম্পানি হাউজের ওয়েব সাইটে গিয়ে দেখি ডিরেক্টর হিসেবে আমার নাম Dr Aftab Hossain. সঙ্গে সঙ্গে জনকে আবার ফোন করলাম,
– জন, আমার এমডি কই?
– কীসের এমডি?
– ক্যান, আমার নামের সামনে যে এমডি ছিল। সেটা কোথায় গেল? কোম্পানি সার্টিফিকেটে তো নাই।
– ডোন্ট ওরি এফট্যাব। এমডি মানে তো ডক্টর অফ মেডিসিন। আমি তো নামের সামনে ডঃ লাগিয়ে দিয়েছি। তাতেই চলবে।
শুনে আমি হাসব না কাঁদব, বুঝতে পারলাম না। অনেক কষ্টে দুঃখ চেপে বললাম,
– না, চলবে না। এই এমডি সেই এমডি না। এই এমডি আমার নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এমডি স্ট্যান্ডস ফর মোহাম্মদ। পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ট্যাক্স, ইনস্যুরেন্স সব জায়গায় এমডি আছে। তাড়াতাড়ি ঠিক করো।
– ওহ, আয়াম সরি। ঠিক করে দিচ্ছি। তবে সার্টিফিকেট পেতে আরও একদিন সময় লাগবে।
একদিনের মধ্যেই এমডি সহ কোম্পানি সার্টিফিকেট পাওয়া গেল। এখন কোম্পানির নামে বিজনেস একাউন্ট খুলতে হবে। বিশ বছর ধরে বার্কলেজ ব্যাংকের সাথে আছি। ভাবলাম, বার্কলেজেই একাউন্ট খুলি। একটা ব্রাঞ্চে গেলাম। আগে ব্যাংকে অনেকগুলো ক্যাশ কাউন্টার থাকত। অনেক কাস্টোমার সার্ভিস অফিসার থাকত। ব্যাংকে ঢুকে দেখি সব বদলে গেছে। মাত্র একটা কাউন্টার খোলা। আর সব সেলফ সার্ভিস। মেশিন থেকে টাকা তোলো। মেশিনেই টাকা জমা দাও। মেশিনে চেক জমা দাও, বিল জমা দাও। এমনকি মেয়াদোত্তীর্ণ টাকাও মেশিনে বদলানো যায়। দুটো মেয়ে শুধু গাইড করছে, কে কোন মেশিনে যাবে। তাঁদের একজনকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
– পার্সোনাল অফিসার কেউ নাই?
– কেন?
– বিজনেস একাউন্ট খুলব।
– আমাদের ব্যাংকে তোমার পার্সোনাল একাউন্ট আছে?
– হ্যাঁ।
– তাহলে বাসায় গিয়ে অনলাইনে খোলো। এখন আর ব্রাঞ্চে একাউন্ট খোলা হয় না। আর একান্তই যদি ব্রাঞ্চে বসে একাউন্ট খুলতে চাও, তাহলেও অনলাইনেই এপোয়েন্টমেন্ট নিতে হবে। কমপক্ষে দুই মাস অপেক্ষা করতে হবে।
হায় হায়, সব অনলাইন? না জানি মানুষগুলোও একদিন সব ভার্চুয়াল হয়ে যাবে। ফেসবুকে দেখা, হোয়াটসআপে প্রেম, জুমে বিয়ে আর ইমেইলে ছেলেমেয়ে! কী আর করা। বাসায় এসে ল্যাপটপ খুলে বসলাম। যতটা জটিল ভেবেছিলাম, ততোটা জটিল নয়। পাসপোর্ট, কোম্পানি সার্টিফিকেট, ইউটিলিটি বিল, ইত্যাদি সব স্ক্যান করে অনলাইনে জমা দিলাম। ওয়েব ক্যামের সামনে বসে কনে দেখানোর মতো নিজের চেহারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালাম। আমি গান গাইতে পারি কিনা শুনতে চাইল না। তবে কথা বলতে পারি কিনা বোঝানোর জন্য বিভিন্ন সংখ্যা উচ্চারণ করে শুনাতে হল। কিন্তু পাত্র তাঁদের পছন্দ হল কিনা, ঠিক বোঝা গেল না। মেসেজ এলো, সব বিবেচনা ও পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত পরে জানাবে।
এই দেশে কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি খাটানো যায় না। সব আপন নিয়মে চলে। দেশে হলে কথা ছিল না। এক চুটকি বাজিয়ে সব করে ফেলতে পারতাম। কবে সিদ্ধান্ত জানায় কে জানে? আর কত ব্যাংকে ধর্না দিতে হবে, তাই বা কে জানে? সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে এই সব সাত পাঁচ ভাবছি, অমনি টিং করে শব্দ হল। মেসেজ এসেছে, কোম্পানি সার্টিফিকেটে আমার নামের সাথে পার্সোনাল একাউন্টে আমার নামের মিল কেন নেই। ব্যাখ্যা দাও।
কয় কী? কোম্পানি সার্টিফিকেটে তো মোহাম্মদ কাইটা এমডি কইরা দিছি। তাইলে ভুল হইল কোথায়? আর তখনই মনে পড়ল বিশ বছর আগে বাংলাদেশী পাশপোর্টের নাম অনুসারে ব্যাংকে একাউন্ট খুলেছিলাম। সেখানে নামের আগে এখনও মোহাম্মদ রয়ে গেছে। অথচ ততদিনে টেমসের জল অনেক গড়িয়েছে। পাসপোর্টের মোহাম্মদ কেটে কবেই এমডি হয়ে গেছে। ব্রিটিশ পাসপোর্টেও এমডি। জবাব দিলাম,
“ যাহা মোহাম্মদ, তাহাই এমডি। যেমন যাহা ডক্টর, তাহাই ডঃ। এমডি ইজ দা এব্রিভিয়েশন অব মোহাম্মদ”
জবাব এলো, “উই উইল লেট ইউ নো আওয়ার ডিসিশন”।
আবার অপেক্ষা! একদিন, দুইদিন, তিনদিন, জবাব আর আসে না। আজ চতুর্থ দিন। বার্কলেজ থেকে বিজনেস ম্যানেজারের ফোন এলো,
– সরি ডক্টর! উই কান্ট ওপেন ইয়োর একাউন্ট।
– কেন?
– তোমার নামের ঠিক নাই।
ধপ করে মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে উঠল। নামের ঠিক নাই মানে কী? আমি কি বেনামী কেউ? ব্রিটিশ পাসপোর্ট আছে। ব্রিটিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। ক্রেডিট কার্ড আছে। ডেবিট কার্ড আছে। আর এই বেটায় কয়, নামের ঠিক নাই! সাত কাণ্ড রামায়ণ পইড়া বেটায় কয়, সীতা কার বাপ? কিন্তু উপায় নাই গোলাম হোসেন। বসেছ মোঘলের সাথে, খানা খেতে হবে একসাথে। এটা রাগ দেখানোর সময় নয়। গলাটাকে যথা সম্ভব মোলায়েম করে বললাম,
– দেখো, আমাদের দেশের মুসলমানরা তাঁদের নামের সামনে প্রোফেটের নাম “মোহাম্মদ” যুক্ত করে দেয়। যার সংক্ষিপ্ত রূপ হল এমডি। ইটস এ কাস্টম।
– আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড। বাট ইয়োর নেম শুড বি একজাক্টলি সেম ইন এভরি ব্যাংক একাউন্ট। আদারোয়াইজ, উই কান্ট ওপেন ইয়োর একাউন্ট।
– তাহলে আমি এখন কী করব? যত দ্রুত সম্ভব, আমার একাউন্ট খোলা দরকার।
– এক কাজ করো, কোম্পানি হাউজে গিয়ে তোমার নাম বদলে ফেলো। এমডি কেটে মোহাম্মদ করে দাও।
আবার কাটাকাটি? এত কষ্টের মাঝেও হাঁসি পেয়ে গেল। হেসে বললাম,
– তখন তো বলবা, কোম্পানি হাউজে তোমার নামের সাথে পাসপোর্টের নামের মিল নাই। তুমি বরং আমার পার্সোনাল একাউন্টে মোহাম্মদ কেটে এমডি করে দাও।
– সরি, আমার সেটা করার এখতিয়ার নেই।
– তাহলে কার আছে?
– তুমি তোমার পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে ব্রাঞ্চে যাও। ওরা তোমার আইডেন্টিটি ভেরিফাই করে মোহাম্মদ কেটে এমডি করে দেবে।
– সে ভেরিফিকেশন তো তুমি অনলাইনেও করতে পারো।
– না। পারি না। অনলাইনে নাম কাঁটার নিয়ম নাই। নাম ঠিক হলে আমাকে ফোন দিও।
শুনে ভানু বন্ধোপাধ্যয়ের মতো চিত্কার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, “তাইলে হালার যুদ্ধেই যামু না”। গুষ্টি কিলাই একাউন্টের, তগো ব্যাংকে একাউন্টই খুলমু না। কিন্তু বলে কী লাভ? তাহলে তো চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতো হয়ে যাবে। ওদের আর দোষ কী? নামের এমন বিভ্রাটের সাথে ওদের তো আর পরিচয় নেই।
বিদ্রঃ নামে মানুষের পরিচয় নয়, কাজে পরিচয়। সুতরাং, সন্তানের নাম ভেবে চিনতে রাখুন। লম্বা চওড়া নাম রাখলেই কেউ লম্বা চওড়া হয়ে যাবেনা। নামের সামনে এব্রিভিয়েশন পরিহার করুন। দয়া করে লেখাটিকে কেউ ধর্মীয় দৃষ্ট কোন থেকে বিচার করবেন না।
আফতাব হোসেন : লেখক এবং চিকিত্সক, লন্ডন, ইংল্যান্ড