শারমীন শরীফ : মনে আছে পরেরদিন দুপুরবেলা মেজদির দরজায় নক। মেজদি একটু দরজা খুলে উকি মেরে দেখল যে আব্বা দাঁড়িয়ে এবং হাতে বিরাট দুটো কাগজের ঠোংগা। আব্বা সেগুলো মেজদির হাতে দিয়ে বললেন, মনি কই? যখন দেখলেন আমি লম্বা হয়ে বিছানায় শুয়ে তখন বললেন- তুই আর মনি মিলে খা। মেজদি ঠোংগা নিয়ে ঘরের মধ্যে এলে অন্য সময় আমি হয়ত ঝাঁপিয়ে পড়তাম কি আছে ওর মধ্যে দেখার জন্য কিন্তু এবারে একদম পাত্তাই দিলাম না। মেজদি টেবিলে উপরে ঠোংগা দুটো রেখে একে একে বের করল ওর মধ্যের জিনিষ। সেখানে ছিল আমার প্রিয় কেক, বিস্কিট, মিষ্টি, আম, কমলা, আঙ্গুর, লজেন্স এমন আরো কত কি।

মেজদি খুব খুশী হয়ে বলল যে, ‘এখন থেকে আমার সব পরীক্ষার আগে তুই নিয়ম করে আব্বার মার খাবি বুঝলি যাতে আব্বা এমন সব মজার মজার খাবার আনে,’ আমি মেজদিকে একটা ভেংচি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম কেকের উপরে, মেজদি একটা স্লাইস দিয়ে বলল, এখন আর খাস না, সন্ধ্যা বেলা সবাই মিলে খাব। সন্ধ্যায় মেজদি বাকি ভাই বোনদের ডাকলে আমারা সবাই মিলে হৈচৈ করে পলকে সেগুলো সব কিছু সাবার করে দিয়েছিলাম। খেয়েদেয়ে সবার মতামত হল যে শুধু পরীক্ষার সময় নয় বরং তাদের লাভের জন্য নিয়মকরে আমার মার খাওয়া উচিত। পরের দিন আমি রাগ টাগ ভুলে আবার আমার স্বরুপে ফিরে গেলাম।

আব্বার সামনে পড়লে আব্বা মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। আমার গান শেখা পর্বের ইতি সেখানেই ঘটেছিল। পরে এ নিয়ে আমি অনেক আফসোস করেছিলাম এই ভেবে যে আব্বা যদি ধৈর্য্য ধরে আরেকটু সময় অপেক্ষা করতেন তাহলে হয়ত কোন এক সময় গানে আমার মন ঠিকই বসত। যখন ৪ দেয়ালে বন্দি হয়ে গিয়েছিলাম তখন মনে হত গান শিখলে খারাপ হত না কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। রুনা লায়লার বাবা আব্বার কলিগ ছিলেন এবং রুনা লায়লাকে খুব কাছ থেকে দেখে আব্বার মনে হয়েছিল তাঁর মেয়েও অমন করে গান গাইবে একদিন।
কিন্তু সবার সব কিছু হবার নয়।

প্রি-টেস্ট পরীক্ষার পরে আর স্কুলে যেতে হল না, অতএব ঘরে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি চলতে লাগল আর ছ্যাঁকা দিয়ে পিন্টু ভট্টাচায্যির গানের উপরে ভক্তি বেড়ে যাওয়াতে ক্যাসেটে সারাক্ষণ তাঁর গান, ‘এক তাজমহল গড়ো হৃদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলে।’ আমি এই গান শুনছি জানলে মনির ভাই হয়ত আমাকে ধরে মার লাগাতেন। এমনি এক দুপুরে আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ছি আর গান শুনছি হঠাত শুনলাম মায়ের চেঁচামেচি, উঠে রান্না ঘরের দিকে গেলাম। মা দূর থেকেই চেঁচিয়ে উঠলেন সেদিকে না যাবার জন্য। আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম দ্রুত সব দেখে নিয়ে বুঝলাম সবাই সুস্থ আছে এবং গাছ থেকে আম পাড়া বিষয়ক মায়ের কোন ড্রামা সিকোয়েন্স চলছে, বাড়ির সব আম গাছের আমগুলো পেঁকে গিয়েছে এবং সকাল থেকে প্রস্তুতি চলছিল সেগুলো পাড়বার, মনে হল সেই নিয়ে কিছু হয়েছে, মায়ের কথা হল কোন আম মাটিতে পড়তে পারবে না তাই নীচে আরো ৪জন মিলে চাদর পেতে দাড়িয়ে আছে আর বাবুল গাছের মাথা থেকে আম পেড়ে সেই চাদরে ছুড়ে মারছে, সে এক এলাহি কান্ড। আমি আবার পড়ার টেবিলে ফিরে গেলাম। দেখলাম আব্বা খবরের কাগজ রেখে বসার ঘর থেকে উঠে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছেন, মনে হল গুরুতর কিছু একটা হয়েছে। আমি মনে হয় পড়ার টেবলে বসে মনোযোগ দিয়ে কোন গল্পের বই পড়িছিলাম তাই ওসবে আর পাত্তা দিলাম না। হঠাত করে আমার মাথা ঘুরে উঠল এবং মনে হচ্ছিল আমি পুড়ে যাচ্ছি। আমি বিকট জোরে চীত্কার করে উঠলাম। সবাই দৌড়ে আমার ঘরে। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। পানি খেয়ে ধাতস্ত হয়ে বললাম যে মাথা হালকা হয়ে গিয়েছিল হঠাত করে। মা সাথে সাথে চেঁচিয়ে উঠে আব্বা কে বললেন, ‘দেখলেন তো দেখলেন তো এগুলো সত্যি কিনা?’

আমি মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না কিন্তু আব্বা কোন কথা না বলে সেখান থেকে চলে গেলেন আর মাও বিপরীত দিকে চলে গেলেন। আমি গিয়ে আমেনা খালা কে জিজ্ঞেস করলাম ঘটনা কি? আমেনা খালা বললেন যে আমার জানলার পাশে যে বিরাট আম গাছটা সেই গাছেই আগডালে একটা তাবিজ ঝুলছিল। বাবুল মাকে সেটা জানাতে মা বলে ছিলেন সেটা ছিড়ে নিয়ে নীচে নেমে আসতে। সেই তাবিজ খুলে দেখা গিয়েছিল যে সেখানে আমার নাম লেখা, মনির ভাইয়ের নাম লেখা এবং অজস্র দোয়াকালাম লেখা। আব্বা সেটা দেখে বলেছিলেন যত্তসব ফালতু ব্যাপার এবং সেটা মায়ের হাত থেকে নিয়ে গনগনে চুলায় ফেলে দিয়েছিলেন আর ঠিক তখনই আমার মাথা ঘুরে উঠেছিল এবং মনে হচ্ছিল আমি পুড়ে যাচ্ছি। আব্বা এগুলো একদম বিশ্বাস করতেন না আর মা ছিলেন তার ঠিক উল্টো। আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এসব সত্যি নাহলে আমার মাথা কেন ঘুরিয়ে উঠেছিল? আব্বার স্ট্রেইটকাট উত্তর ছিল, আমি যেহেতু পরীক্ষার পড়াশুনা নিয়ে অনেক খাটছি এবং সাথে ঠিক মত খাওয়া-দাওয়া করছি না তাই অমন হয়েছে, এখন থেকে ডাবল খেতে হবে? টাইমিং এর ব্যাপারটা জানতে চাইলে বলেছিলেন যে ওটা নিছক কাকতালীয়। ব্যাস আমার সব টেনশন শেষ কিন্তু মা এত সহজে ব্যাপারটা ভুললেন না। এই বিষয়ে মায়ের গবেষণা চলতে থাকল। সবাইকে সাবধান করে দিলেন যে এই কথা যেন বাইরে না যায়।

মা বললেন, বাইরে যাওয়া একেবারে মানে পুরোপুরি বন্ধ। একটুখানি দুষ্টুমি করতে গিয়ে তার জন্য অনেক লম্বা মাশুল গুনতে হয়েছিল আমাকে। বুঝলাম যে সে তাবিজ কবজের আশ্রয় নিয়েছিল আমার মত ঘোরানোর জন্য। তারমানে সে অথবা তার কোন লোক আমাদের বাড়ির সীমানায় ঢুকে আমার জানলার পাশের আমগাছ পর্যন্ত বেয়ে উঠেছিল। মনে মনে মায়ের বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না। মা যেন আগেই সব জানতেন আর তাই আমাকে জানলা বন্ধ করে শুতে বলেছিলেন। সেদিন মা আর আব্বা ফিরে ফিরে এসে দেখেছিলেন আমি ঠিক আছি কিনা। মেজদা রাত্রিবেলা বাড়ি এসে এসব শুনে হেসেই শেষ। ভাই-বোনের রোজ একটা আড্ডা হত প্রতি রাতে। মেজদা আমার থেকে ১৫ বছরের বড় এবং তখন বাড়িতে আমি, মেজদা আর মা, বাবা ছাড়া আর কেউ থাকতেন না। বাকি ভাই বোনেরা যে যার সংসার নিয়ে এদিকে সেদিকে ব্যাস্ত। তাই মেজদা আর আমার মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক অসাধারণ বন্ধুত্বের সম্পর্ক। মা চলে যাবার পরে মেজদা একটা বিয়ারের ক্যান বের করে বলল, বিয়ার খাবি, বিয়ার খা তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে? আমি সাথে সাথে টেবিলের উপরে থাকা গ্লাসের পানি ফেলে দিয়ে গ্লাস পাতলাম মেজদার সামনে। মেজদা হয়ত ২ চুমুকের মত ঢেলে দিয়েছিল। আমি বললাম মাত্র এইটুকু? বিশ্বাসই হচ্ছিলনা যে আমি বিয়ার খেতে যাচ্ছি। টিভিতে দেখতাম আর ভাবতাম, আহা! কত যেন মজা খেতে। মেজদা বলল আগে এইটুকু ‘খা’ তারপরে চাইলে আবার দেব। আমি তো চোখের পলকে চুমুক দিয়ে দিলাম আর সাথে সাথে ইয়াক থু বলে আবার গ্লাসের মধ্যে ফেলে দিলাম। মেজদা বলল, আরো নিবি? নে, খা, আরো খা। ততক্ষনে আমি চিনি খুঁজতে ভারার ঘরে চলে গিয়েছি। হি হি করে অনেক হাসলাম দুজনে।

মেজদা তখন আমার ভাবির সাথে প্রেম করেছে চুঁটিয়ে কিন্তু আমরা কেউ জানিনা। মেজদার বন্ধু ছিলেন আলতাফ ভাই। তিনি ছিলেন আরেক দুষ্টের শিরোমনি। এরা দুজন হঠাত আবিষ্কার করলেন যে আমাদের রাখাল বাবুল পাশের বাড়ির মেয়ে আর ওপাশের বাড়ির ছেলের চিঠি আদান প্রদানের পিওন। একদিন বিকেলে মেজদা আর আলতাফ ভাই বারান্দায় সিড়িতে বসে চা খাচ্ছেন আর রাস্তা দিয়ে সব মেয়েদের যাওয়া দেখছে। কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না ওদের দিকে। আমি টিপ্পনি কাটলাম, বললাম, তোমাদের দিকে ওরা তাকাচ্ছে না পর্যন্ত, যাও মেকাপ নিয়ে এস। মেজদা বলল, ‘উহারা সব কমিউ্যনিস্ট, উহারা আমাদের সাথে কো-অপারেট করে না, উহাদিগকে আমাদের প্রয়োজন নাই।’ ঠিক এই সময়ে দৃশ্যপটে বাবুলের আবির্ভাব। একটা চোর চোর ভাব মুখে নিয়ে সে গেট থেকে বেরোবার চেস্টা করছে। মেজদা একটা হাক দিল, ‘এই বাবুল এদিকে আয়।’ বাবুল গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে এল, বলল- ডাকেন ক্যান চাজ্জান (চাচাজান)? মেজদা বলল, ‘তোর ট্যাকে কি আছে বের কর’। বাবুল বলল- কিচ্ছু নাই খোদার কসম। এইটুকু বলার সাথে সাথে মেজদা আর আলতাফ ভাই ওকে চ্যংদোলা করে তুলে ফেলল এবং ঘরের মধ্যে ঢুকে যেতে যেতে আমাকে ঘরে ঢুকতে বারণ করল। ওর লুংগি খুলে ঝেড়ে সেই চিঠি বের করল।

বাবুল কান্নাকাটি করে বলল, ‘চিডি দ্যান চাজ্জান (চাচাজান), নাইলে মোরে ছ্যাচপেয়ানে’। সেই চিঠি ছিল মিলি আপার তরফ থেকে বড় ভাই তরফের প্রতি। মেজদা আর আলফাত ভাই সেই চিঠি পড়ে ছিড়ে ফেলে আগডুম বাগডুম লিখে বাবুলকে দিয়ে বলল, যা এই চিঠি দিয়ে আয় এবং উত্তর নিয়ে আমাদের কাছে আসবি। বাবুল লক্ষী ছেলের মত চিঠি নিয়ে চলে গেল। এভাবে ওদের দুষ্টুমি চলতে থাকল কিন্তু ধরা পরে গেল অচিরেই। ওরা দুপক্ষের চিঠিই পড়ে ছিড়ে ফেলে যা মন চাইতো তাই লিখত। মাথামুণ্ডু লেখা দেখে সন্দেহ করে পারাত বড় ভাই বাবুলকে চেপে ধরল। বেচারা বাবুলের বেশ একটা উপরি আয় হচ্ছিল এখান থেকে, সেটার উপরে হামলা হয়ে গেল। ধরা খেয়ে বাবুল সব বলে দিল। বাবুলকে পিটুনি দিয়ে ছেড়ে দিল। সে বিকেলে বারান্দায় বপ্সে মেজদা আর আলতাফ ভাইয়ের যখন চা খাওয়া আর মেয়ে দেখা সেশন চলছে তখন বাবুল হঠাত গরুর মত চীত্কার করতে করতে এসে হাজির, ‘ও চাজ্জান, চাজ্জান গো চাজ্জান মোরে কোল ধরছেলে ঠাইশ্যা, ছেইচ্যা মোর পিট ভাইঙ্গা দেছে দ্যাহেন, মুই কোল দিছি সব কইয়া, এহন আ¤েœরা বোজেন যাইয়া’ বলে বাবুল ভাগল্পুর। মেজদা আর আলতাফ ভাই দেখল সমূহ বিপদ। মেজদা বয়সে অনেক বড় বলে পাড়াত ভাই মেজদাকে কিছু বলেনি কিন্তু আলতাফ ভাইকে বলেছিল, ‘কাজটা ভাল করেন নাই আলতাফ ভাই।’ (চলবে)