শারমীন শরীফ : পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই নিঃসঙ্গ কিন্তু অনেকেই সেটা জানে না, আর যারা জানে না তাঁরা বেঁচে গিয়েছে। আমরা যারা নিঃসঙ্গতাকে অহরহ উপলব্ধি করি তাঁদের জন্য এটা এক রকম বিড়ম্বনা, অন্তত আমার ক্ষেত্রে কারণ, আমি মাঝে মাঝে বুঝতেই পারি না একাকীত্ব ভাল না খারাপ! একটা দোটানায় পড়ে কেমন একটা বিভ্রান্তিতে থাকি। জীবনের বিভিন্ন সময়ে এসে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখেছি, শুধু নিজের পায়ের ছাপ ছাড়া নিজের চলার পথে আর অন্য কোন পায়ের ছাঁপ চোখে পড়েনি। আমি এর জন্য নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে দোষ দিতে পারিনি। একটা বয়সে এসে মনে হল, এভাবে প্রতিনিয়ত নিজের সাথে যুদ্ধ না করে বরং একাকীত্বের সাথে সন্ধি করে নিলে কেমন হয়? অনেক বছর পরে নিজের এই সিদ্ধান্তকে মনে হয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত একটা সিদ্ধান্ত। জানলাম এভাবেও ভাল থাকা যায়, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চল রে!’ উপলব্ধি করলাম, নিজেকে চিনতে পারাই সব থেকে বড় পাওয়া এই পৃথিবীতে। উবহরধষ থেকে বেড়িয়ে এসে নিজেকে সহজ করে স্বীকার করে নেবার নামই হল নিজের সাথে বোঝাপড়া। এখন কেউ যদি আমাকে উপেক্ষার, অবহেলার বা অনাদরের ভয় দেখায়, তাঁদের জন্যই আমার বরং মায়া লাগে। আমার ধমনীতে বইছে নিঃসঙ্গতার গান, আমার কিসের ভয়? নতুন করে হারাবার কিছু নেই। সবাই পালে হাওয়া লাগিয়ে চলতে পারে না, সমাজে দু’একজন দল ছাড়া, গোত্র ছাড়া উদ্ভট মানুষও রয়েছে আর, তাঁরা না হয় তাঁদের মতই থাকুক।
সেদিন সন্ধ্যায় হয়ত পরিবেশটাই এমন ছিল, সঞ্চি ওর মনের কথাগুলো উজার করে দিয়েছিল আমার কাছে, আমি নিরব শ্রোতা হয়ে শুনেছিলাম। অনেক অনেক রাত পর্যন্ত সিঁড়িতে বসে অনেক কাপ চা ধ্বংস করেছিলাম সেদিন, কখন ঘুমাতে গিয়েছিলাম ঠিক মনে নেই কিন্তু পরের দিন ঘুম ভাঙল সঞ্চির চেঁচামেচিতে। আমি উঠে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখলাম বাড়ির অনেকেই অবাক হয়ে বাগানের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে চেয়ে দেখলাম শিউলি গাছটা সমূলে উত্পাটিত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে গেটের পাশে। সেই রাতে আমরা ঘুমাতে যাবার পড়ে অনেক ঝড়-বৃষ্টি হয়েছিল আর তারই ফলাফল ছিল শিউলী গাছের অপমৃত্যু। সঞ্চির মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। রক্তশূন্য ফ্যাঁকাসে লাগছিল ওকে। একে একে সবাই বারান্দা থেকে চলে গেলেও রয়ে গিয়েছিলাম আমরা দু’জন। ফিসফিসিয়ে সঞ্চি বলল, ‘হবে না বুঝলি? আর হবে না। আমি বুঝতে পেরে গিয়েছি, তাই তোর উপর থেকে সব বিধি নিষেধ তুলে নিলাম’। আমি পরিষ্কার বুঝেছিলাম ও কি বলেছিল সেদিন। কিছুক্ষণ পরে ও আমায় বলল যে, সে আজ ক্লাসে যাবে না, আমি চলে যেতে পারি। কিন্তু আমি সেদিন ওকে ফেলে যাইনি। সারাদিন দু’জন বেইলি রোডের শাড়ির দোকানে অকারণে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরলাম, বিকেলে ওর কোন এক আত্মীয়ার বাসায় গেলাম ওর সাথে, কারো জন্মদিন ছিল সে বাড়িতে। সন্ধ্যায় আমি হলে ফিরে গেলাম।
পরের দিন আমার নিজের মন মেজাজ খুব খারাপ ছিল, ভীষণ রকম আপসেট ছিলাম আমি। সঞ্চি সেদিনও ক্লাসে আসেনি। নিতান্তুই পারিবারিক কারণে আমার মন মেজাজ ভাল ছিল না সেই সাথে আতিকের উপড়েও ভীষণ চটে ছিলাম।
আতিক সেটা বুঝতে পেরেছিল। প্রথম দু’টো ক্লাস শেষে একটা লম্বা গ্যাপ, অনেক পরে ৩টার দিকে হুমায়ুন আজাদ স্যারের ক্লাস ছিল সেদিন। দ্বিতীয় ক্লাস শেষের সাথে সাথে আতিক আমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে রিকশায় তুলল। জানতে চাইলাম কই যাচ্ছি। বলল, অপেক্ষা কর দেখবি। আমাকে সে নিয়ে গেল কবি আল-মাহমুদের অফিসে। তাঁর কবিতা ‘সমুদ্র নিষাদ’ দিয়ে তখন আমাদের দিন শুরু হত আর শেষ হত ‘সোনালী কাবিন’ দিয়ে। ব্যক্তি কবি আল-মাহমুদ কে, তাঁর বিভিন্ন কর্মকান্ডের জন্য ব্যাবচ্ছেদ করবার মত বয়স বা মানসিক পরিপক্বতা আমাদের তখন ছিল না বা প্রয়োজনও ছিল না। আমরা তাঁর কবিতার মুকধ পাঠক ছিলাম। নারী প্রীতি আল মাহমুদের সহজাত অভ্যাস, এ দোষটা শুধু তাঁকে একাকে দিলে ভীষণ অন্যায় হবে। আমি সেখানে যাওয়া মাত্র তিনি আমাকে নিয়ে অনেক ব্যাস্ত হয়ে গেলেন। আতিক ওখানে থেকেও যেন নেই হয়ে ছিল। কবি আমার সাথে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিলেন এবং বুঝলেন যে আমি সেদিন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছি। তিনি আতিককে জিজ্ঞেস করলেন আমার বিপর্যস্ততার কারণ। আতিক উত্তর না দিয়ে আমাকে বলল ‘চল’, উনি আরেকটু বসতে বললেন কিন্তু আমরা বেড়িয়ে এলাম সেখান থেকে। অনেক বছর পরে আতিক স্বীকার করেছিল যে, ওর হিংসা হচ্ছিল আমার প্রতি কবির আগ্রহ দেখে। ওর সহ্য হয়নি অন্য কেউ আমার প্রতি এত প্রেম দেখাচ্ছে। ফেরার পথে রিকশায় আমরা যখন ক্যাম্পাসে ফিরে যাচ্ছিলাম, তখন আমি আতিককে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন সে আমার কাছ থেকে ব্রাশ-পেস্ট চেয়ে নিয়েছিল আর কেনই বা সে আমাকেই আনতে বলেছিল? অন্য কারো কাছ থেকে নয় কেন? ও কোন উত্তর না দিয়ে অদ্ভুত ভাবে আমার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। আমি বুঝে নিয়েছিলাম। আর কোন প্রশ্ন করিনি। এই প্রসঙ্গে আমরা আর কোনদিন কথা বলিনি কিন্তু আতিকও আমার চোখ চেয়েছিল সেদিন এবং সেও জানত আমার মনের কথা। নিরব বোঝাপড়ার মধ্যেই পুরো ব্যাপারটা আমরা ভুলে যাবার অভিনয় করেছিলাম। আমরা সঞ্চিকে ভালবাসতাম এবং সেটাই বেশি গুরুত্ত¡পূর্ণ ছিল, বাকি সবকিছু ফাঁকি।
আমদের যখন কিছু করার থাকত না তখন আমরা গিয়ে পাঠকা সমাবেশে বিজুর দোকানে বসে থাকতাম। সেই বিজু তখন এই বিজু ছিল না। ওখানে বসে বসে বই পড়তাম বা সময়ে সময়ে কিনে নিয়ে যেতাম, আমি কোন বই কিনলে সবার শেষে সে বই পড়া আমার কপালে জুটত অথবা, সবার আগে আমি পড়ার পরে ওদের একজনকে দিতাম পড়ার জন্য তারপরে সে বইয়ের চেহারা আর কোনদিন দেখতে পেতাম না। আমরা প্রচুর বই কিনতাম ওর দোকান থেকে। একটা খাতা খোলা ছিল আমাদের নামে, আসলে বলা যেতে পারে আমার নামে। হঠাত কোন একদিন বিজু আমাকে চমকে দিয়ে বলত, ‘আপা আপনার নামে ১৫০০ টাকা জমে গিয়েছে?’ আমি অবাক হয়ে জানতে চাইতাম কখন, কিভাবে? বিজু নিরবে খাতাটা এনে আমার সামনে রাখত। আমি দেখতাম বইয়ের নামের সামনে মুনির, আতিক আর সেলিমের নাম। ওরা ইচ্ছামত বই নিয়ে যেত আমার নামে। এখন হাসি পায় ভাবলে কিন্তু তখন ভীষণ রাগ লাগত। ওদের বলতাম ফের আমার নামে বই নিলে মার লাগাবো। দাঁত বের করে হাসত কিন্তু বই নেয়া বন্ধ করত না।
রুনা সংসার পেতেছিল খিলগাঁও, ওর সংসার হবার পরে আমাদের একটা আড্ডা মারার জায়গা হোয়েছিল বলে আমরা ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। প্রায়ই ক্লাস শেষে আমি, পলি, আরিফ, সীমা, তুলি আমরা রুনার বাসায় আড্ডা দিতে চলে যেতাম। সীমা ভিতুর ডিম কখনো কোথাও একা যেতে পারত না। সব সময় আমি ভলান্টিয়ার করতাম, ওকে, ওদের আজিমপুরের বাসা থেকে তুলে নিয়ে তবে যেতাম। আমি নাটক নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবার পরে ওদের সাথে আড্ডাটাও কমে গেল ধীরে ধীরে।
সেলিম থাকত এফ রহমান হলে। আমি কখনো বড় আপার বাসায় রাতে থাকলে সকালে ক্লাসে আসার পথে সেলিমের হলের সামনে থামতাম। সোজা হলে ঢুকে ওর রুমে চলে যেতাম, কখনো এক সেকেন্ডের জন্যও ভাবিনি আমার কোন বিপদ হতে পারে। এখনকার দিনে আমার মনে হয় না কোন মেয়ে এভাবে সাহস পাবে হলে ঢুকতে। যাই হোক হলে ঢুকে সেলিমকে বলতাম চল, বাইরে রিকশা দাঁড়িয়ে, ও বলত দাড়া চিরতার পানি খেয়ে নেই। এমনি একদিন একটা গ্লাস আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ‘চুমুক দে’। আমি চিরতার পানি খাইনি কোনদিন, তাই প্রথমদিন ভাবলাম কোন সরবত হবে, ভেবে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে থু থু করে সব ফেলে দিয়ে বাকি পানি ওর মাথায় ঢেলেছিলাম। ভেজা মাথা টাওয়াল দিয়ে মুছে, শার্টটা পালটে বলল, ‘চল’, যেন কিছুই হয়নি। মুখটা সেদিন সারাদিনের জন্য তেতো হয়েছিল। আর আমাকে বোকা বানানোর আনন্দে সেলিমকে আর পায় কে সেদিন, তারিয়ে তারিয়ে সেই গল্প সে করেছিল সারাদিন।