আতোয়ার রহমান : একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে দেশে। করোনার মহামারী এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই যেন দেশে ধর্ষণের মহামারী শুরু হয়েছে।
আগে কখনও গভীর জঙ্গল, কখনও ধান বা পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে ভেসে আসতো অসহায় তরুণীর আর্ত চিৎকার। এখন তা সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের মতো শিক্ষার পবিত্র অঙ্গন থেকেও ভেসে আসছে। শুধু সিলেট নয়, সারা দেশেই এই সামাজিক ব্যাধি বা সামাজিক অনাচার দিনের পর দিন যেন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখন দেশে প্রতিদিন গড়ে এগারজন নারী ধর্ষিত হচ্ছে।
ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ নতুন না হলেও, তবে তার থেকেও বেশি ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা হচ্ছে পিতার সামনে কন্যাকে, স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করা হয়, ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে খুন করা হয় ধর্ষিতাকে। ফলত কোথাও জিভ কেটে দেওয়া হয়, পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়; পোড়া সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে, কোথাও পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে। এই যে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করা- সেই নজির কিন্তু এত প্রকটভাবে দেখা যায়নি আগে কখনও।
যিনি ধর্ষিত হচ্ছেন বা অত্যাচারিত হচ্ছেন, এক্ষেত্রে তিনি সামাজিক লজ্জায়, মানসিক আঘাতের কারনে মুখ খোলেনা। অনেকক্ষেত্রে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না; আবার অনেকক্ষেত্রে মামলা এত দীর্ঘকালীন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয় যে নির্যাতিতার পরিবার সেখান থেকে সরে আসে। এই সুযোগে ধর্ষণকারীরা দিব্যি ঘুরে বেড়ায় বুক ফুলিয়ে। আবার কেউ যদি সাহস করে এগিয়ে আসে, থানায় কোনভাবে অভিযোগ জানায়, শুরু হয়ে যায় প্রশাসন আর প্রভাবশালীদের পক্ষ থেকে ধর্ষকদের আড়াল করার সচেতন প্রয়াস। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলে ধর্ষণ মামলা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচারই পায় না অভিযুক্ত। প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তরা জামিনে মুক্ত হলে বা খালাশ পেয়ে গেলে তাদের নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা ফুলের মালা দিয়ে বিজয় মিছিল করে। আবার কখনও জেলে গেলে তাদের জন্য ভালো খাবাদাবারের ব্যবস্থ্যা করা হয়, জামাই আদরে রাখা হয়। হয়তো এই ঘটনাই ধর্ষকদের পরবর্তী শিকার খুঁজে নেওয়ার জন্য মনে মনে সাহসী করে তুলছে আরও, যৌন ক্ষুদার্ত করে তুলছে। ক্ষমতার পেশি প্রদর্শনই এখানে মূল কথা। আমি পুরুষ; আমি যা কিছু করতে পারি মহিলাদের সঙ্গে- এই বক্তব্যই যেন ধর্ষণের মাধ্যমে আমাদের দিতে চাইছে ধর্ষকেরা।
একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা। কিন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে এমন অনাচার বৃদ্ধির কারণটা ঠিক কী? এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন। তবে আমার মনে হয় এর মূল কারণ মানুষের বিকৃত মানষিকতা। আমরাও সকলেই কমবেশি দায়ী কারন আমরা এ অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিনা, নিরবতা অবলম্বন করে থাকি, গা বাঁচিয়ে চলি, উটকো ঝামেলা মনে করে তা থেকে এড়িয়ে চলি। কিন্তু আমরা আর কত নিরবতা অবলম্বন করে থাকব? সত্যিই কি ধর্ষণ এবং নারীনির্যাতনের মতো ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করার কোনো ইচ্ছা আছে ক্ষমতাসীন মানুষদের?
এ জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করতে হবে।গা সওয়ার মানষিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। যেমন সিলেটের আইনজীবী সমাজ তাদের বয়কট করেছে, কেউ তাদের পক্ষে আইনি লড়াই লড়তে রাজি হয়নি। এভাবে চিকিৎসকরা যদি তাদের চিকিৎসা প্রদানে অস্বীকার করে, শিক্ষক শিক্ষা প্রদানে অস্বীকার করে, রেস্টুরেন্টের মালিক খাবার দিতে রাজি না হয় তাহলে এ জঘন্য অপরাধীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে। তবে ভয়ের ব্যাপার হল, সেই সচেতনতা আসতে আসতে আরো কতগুলো মেয়ের জীবন কলঙ্কিত হবে, আগুনের শিখায় অথবা পাথরের নিচে থেঁতলে শেষ হয়ে যাবে, তা কে বলতে পারে!
তাই আমাদের আইন ব্যবস্থা কে আরো শক্তিশালী করে তুলতে হবে, ধর্ষণকারিদের জন্য আরও কঠোর এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান করতে হবে। যাতে অন্যায়কারি কোন ভাবেই ছাড় না পায়। মানুষের বিশ্বাস থাকে আইনের ওপরে। অনেকে ক্রসফায়ারে দিয়ে এদের মেরে ফেলার কথা বলছেন। তবে এদের ক্রসফায়ারে দিয়ে আইনবহির্ভূত উপায়ে মেরে ফেলাকে সমর্থন করা যায়না। তাহলে প্রদীপের মতো অনেক খুনী পুলিশ অফিসার তৈরি হতে পারে।
প্রতিটা ধর্ষণ,প্রতিটা যৌন হেনস্থা, প্রতিটা পুড়ে যাওয়া, থেঁতলে যাওয়া দেহ, প্রতিটা শরীরী হয়রানির দমবন্ধ অভিজ্ঞতাই আসলে আমাদের সমাজের গায়ে, আমাদের এই পোড়া দেশের গায়ে দীর্ঘশ্বাস।