বনানী বাবলি : মায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পরলো। এখান থেকে চট্টগ্রাম রওনা হওয়ার আগেও শুনেছি হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হবে আগামীকাল। শরীর এখন অনেকটা ভালো। কিন্তু এ কেমন মৃত্যু? মনকে ঠিক বোঝাতে পারছিলাম না। গ্রামের বাড়িতে গেলাম শেষকৃত্যর অনুষ্ঠানের জন্য। চারিদিকে শোকের আবহ। একসময় সব শেষ হলো। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরলাম শেষ রাতে। ভোরের দিকে ঘুম জড়ানো অবস্থাতেই হঠাৎ শুনতে পেলাম একসাথে কারা যেনো আরবি পড়ছে মিষ্টি সুরে। ভাবলাম স্বপ্ন। যতটুকু জানি গ্রামের মসজিদ আরো অনেক দূরের পাড়াতে। তাই শ্রবনীন্দ্রিয়কে আরো সজাগ করে শোনার চেষ্টা করলাম। তারপরও মনে হলো হয়তো রেডিও। উঠে বসলাম এবং শব্দকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম বৈঠকখানায় আমার পিসী জয়িতা পাঁচটা শিশুকে সাথে নিয়ে পড়াচ্ছেন আরবি। বাচ্চারা পড়া শেষ করে চলে গেলো কিছুক্ষণ পরে আগামীকালের হোম ওয়ার্ক নিয়ে। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম পিসীকে, “আপনি কখন আরবি শিখলেন?” তিনি বললেন, “আমি ও পাড়ার এই বাচ্চাদেরকে সব বিষয়েই পড়াচ্ছিলাম অনেকদিন যাবৎ একমাত্র আরবি ছাড়া। বাচ্চারা সব বিষয়েই ভালো মার্ক পাচ্ছিল ইস্কুলে কিন্তু আরবিতে কম নম্বর পেত। তাই আমি তাদের বলেছি আমার এখানেই যেনো পড়ে। ওদের কাছে শুনতে শুনতে আমিও শিখে গেলাম আরবি।” আমি মুগ্ধ হলাম ভাষার প্রতি এই স¤প্রীতি দেখে, আমি পুলকিত হলাম স্থান কাল পাত্র ভেদে ধর্মের সহ অবস্থান দেখে। আমার এই ছোটবেলার খেলার সাথী, চিরকুমারী, দোভাষী পিসির কাছে আমি যা শিখতে পেলাম তা অমূল্য অনেকদিন পর বাংলাদেশে যাওয়ার কারণে ভাইবোনদের ব্যক্তিগত গল্পগুলি আমার কাছে সবাই উত্থাপন করতো। কিছু ছিলো কৌতুক জনক, কিছু দুঃখের, কিছু সাদা মাটা একই রকম এবং কিছু ছিলো রহস্যময়। যাইহোক, সবই প্রাণের কথা, মন দোলানো ঘটনা, প্রাণ খুলে হাসার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ। এবার গেলাম কক্সবাজার শহরেরই। রাতে প্রচন্ড গরম আর মশার উৎপাত। কিন্তু তাতে কি? কাকার বাসাতে গভীর রাতের আড্ডা চলছে সমান তালে। আমার চাচাতো ভাই ঝিনুক খুব জন দরদী বিশেষ করে তার অগুনতি বন্ধুদের ব্যাপারে এবং এই কক্সবাজার শহরেই তার জন্ম, পড়াশুনা ও বেড়ে উঠা।
ঝিনুক আমাকে বললো যে কীভাবে তার বন্ধু সাহায্য নিয়েছে বেহেশতে যাওয়ার পথকে সুগম করতে। আমি হেসে বললাম, “ঠিক আছে, বলে যা, আমি শুনছি।” ঝিনুক আমাকে বলতে শুরু করলো, “শোনো দিদি, একখান সত্য ঘটনা। আমার বন্ধু, কামাল বেহেশতে যাইতে চায় এবং একদিন আমারে বহুত অনুরোধ কইরা কইলো, আমি যেনো শুধুমাত্র একবারের জন্য মসজিদে গিয়া নামাজ কায়েম করি।” তখন আমি তারে কইলাম, “দেখ বন্ধু, আমিতো নামাজ কেমনে পড়তে হয় জানি না।” কামাল কইলো, “দোস্ত, অসুবিধা নাই। আমি যা যা করি নামাজে দাঁড়ায়, তুইও তা করবি।” আমি তারে কইলাম, তবে কাছের কোনো মসজিদে নয়। দূরের কোনো গ্রামের মসজিদ হইলে আমার জন্য নিরাপদ হয়। কামাল কইলো, “চল দোস্ত, কোনো সমস্যা নাই।” দুইজনে একদিন ভোরে রওনা হইলাম বহু দূরের উখিয়ার এক মসজিদের উদ্দেশ্যে। নামাজ পইড়া ভাবলাম আমার বন্ধু যদি আমার একদিনের নামাজে বেহেশতে যাইবে এই কারণে খুশি হয় – তো আমার ক্ষতি কি?”
১৯৯৬ সালে, আমার বন্ধু শুভ্রা চট্টগ্রামের একটি প্রথিতযশা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করলো এবং অন্যান্য বিষয়ের সাথে ধর্ম ইসলামিয়াতও সংযুক্ত হলো। কারণ হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্য ধর্মের কোনো ক্লাস ছিলো না। কিন্তু তাতে কি? বন্ধু শুভ্রা তার মেয়েকে বললো, “এটাও তো একটা বিষয়, শিখতে সমস্যা কোথায়?” কিন্তু ক্লাসের ছোট শিশুরাও জানলো এই টুম্পা নামাজ পড়ে না কিন্তু সে ইসলামিয়াত ক্লাস করে এবং সর্বোচ্চ নম্বর সে তুলে নেয় ক্লাসে। এই অবোধ শিশু টুম্পা একদিন স্কুল থেকে বাসায় এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো, “মা, বন্ধুরা জানতে চায়, আমি কি হিন্দু, নাকি মুসলিম?” মা বললো, “তুমি বলো ওদের, তুমি মানুষ।” প্রসঙ্গত: নর্থ আমেরিকাতে বিষয় হিসাবে ধর্ম দেয়া হয় প্রাথমিক নয় মাধ্যমিক ইস্কুলে এবং সেটা ওয়ার্ল্ড রিলিজিওন (হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, খ্রীষ্টান, ইসলাম ও অন্যানো ধর্মের উৎপত্তি ও ইতিহাস সম্বলিত একটি বই) এবং তাও সেটা ঐচ্ছিক, বাধ্যতামূলক নয়। একাত্তরে অনেক মুসলিম পরিবার তার হিন্দু প্রতিবেশীকে বোরকা দিয়ে সাহায্য করেছিল রাজাকার ও তাদের দোসর পশ্চিম পাকিস্তানী হায়েনাদের হিংস্র থাবা থেকে রক্ষা পেতে এবং সেই মানবধর্মের উদাহরণও আছে বাংলাদেশে।
আমি কোনো ধর্ম বিষয়েই জ্ঞানী নই। তবে সমাজতাত্তি¡ক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, প্রাগৈতিহাসিককালে ধর্মের যখন উৎপত্তি হয় নাই তখন সেই আদিম যুগে মানব সমাজ অতি প্রাকৃত বস্তুকে সন্তুষ্টি, জাদু, ভয় ভীতির মূল্যবোধকে ভিত্তি করে সামাজিক বন্ধন গড়ে উঠেছিলো। উৎপত্তি হলো গোষ্ঠীর বা দলগত সমষ্টি। সৃষ্টি হলো দলপতির। কিন্তু দলপতিকেও একটি ভয়ঙ্কর, অস্পষ্ট, ঐন্দ্রজালিক, ঐশ্বরিক কিছুকে অবলম্বনের প্রয়োজন হলো সমাজকে তথা সমাজের মানুষকে বশে রাখার জন্য। ঐতিহাসিকভাবেই সেই সময় কিছুকাল ছিলো মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ও পরবর্তীতে এই সমাজ বিভিন্ন কারণে পরিবর্তন হয়ে সৃষ্টি হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের। মেয়েদের ভূমিকা হয়ে যায় সন্তানের জন্ম দেয়া, তাদের লালন পালন, গৃহস্থালির কাজ ও অল্প স্বল্প কৃষি কাজ করা। মেয়েদের একটা প্রকৃতিগত অভ্যাস আছে যেটা হলো আগামী দিনের জন্য খাদ্য সংগ্রহে রাখা। তখন মেয়েরা উদ্বৃত্ত বুনো ফল-মূল মাটির নিচে সংগ্রহ করে রাখতো আগামী দিনের জন্য। তারপর একদিন তারা আবিষ্কার করলো ফলমূল মাটির নিচে রেখে দিলে তার থেকে চারার সৃষ্টি হয় এবং এই ভাবে আবিষ্কার হয় মেয়েদের কৃষিকাজ বা বাগানের উৎপত্তি। আর মানব সমাজ অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে আজকের সমাজে উন্নীত হয়েছে। পরবর্তীতে একের পর এক ধর্মের প্রবর্তনের মাধ্যমে মানব সমাজকে সংহত করা হয়েছিলো। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম প্রবর্তন সমাজকে অনৈতিকতা-অরাজকতা থেকে রক্ষা করেছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রাগৈতিহাসিক আমলে প্রতিটা ধর্ম প্রবর্তক বা ধর্মগুরুদের নারীর অধিকার নিয়ে বা নারীর সমঅধিকার নিয়ে ভাববার অবকাশ ছিলো না। সেই সময় নারী ছিলো পুরুষের অধীনে (অল্প কিছু কাল মাতৃ তান্ত্রিক সমাজ বাবস্থা ছিল যেটার সামগ্রিক বর্ণনা পাওয়া যায় রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন এর ভলগা থেকে গঙ্গা পুস্তকে। যার কারণে কোনো ধর্মেই নারীকে মন্দিরের পুরোহিত, মসজিদের ইমাম কিংবা চার্চের পাদ্রী হতে দেখা যায় নাই। নারীর স্থান ছিলো গৃহকোণে। এখনো এই বিংশ শতাব্দীতে আমরা কোনো কোনো গ্রামের ঘর বসতির দেয়ালে সাদা কাপড়ে নকশা করা, সুতার কাজ করা, বাধাই ফ্রেমে দেখতে পাই প্রচলিত প্রবাদ, “সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে।” গৃহকর্মে নিপুণা, নিজ ধর্মে আস্থাশীল, পুরুষের অনুগত মেয়েই কাঙ্খিত সামাজিক তথা ধর্মীয় মানদন্ডে। ধীরে ধীরে মানুষের চিন্তার বিকাশ, পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয়েছে যুগে যুগে ঠিক প্রাণীর বিবর্তনের মতো। কিন্তু কতটুকু এর গ্রহণযোগ্যতা আমাদের বাংলাদেশের সমাজে যখন আমরা নারী পুরুষের সমতার কথা বলি, নামাজের জন্য শুক্রবার সরকারি ছুটি পালন করি (কিছু মুসলিম রাষ্ট্র ছাড়া পৃথিবীর সব দেশে রোববার হলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন কারণ সপ্তাহ শুরু হয় সোমবার দিয়ে। পাঁচ বা ছয়দিন একটানা কাজ করার পর রোববার মানুষের বিশ্রামের দরকার হয়।), রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংযুক্ত না করে একে উপেক্ষা করি, ধর্ম পালনের জন্য জনসমক্ষে পাঁঠা বলি বা গরু জবাই করে কোরবানী করি। তাছাড়া ধর্মের কী অদ্ভুদ লীলা এক ধর্মে গরু হলো মায়ের মতো, তাই গো হত্যা পাপ আর অন্য ধর্মে গরু কোরবানি দেয়া হয় ধর্মের নামে। আর to kill or not to kill এই নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ চলেই যাচ্ছে ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে।
জন সমক্ষে ধর্মের নামে প্রাণী হত্যা করা অন্যায় এবং ধর্মের নামে উচ্চস্বরে পাবলিক প্লেসে মাইক্রোফোন ব্যবহার করা নিষেধ উন্নত বিশ্বে। কাঁসার ধনি, আজানের শব্দ মধুর তখনি যখন সেটা দৈনন্দিন শব্দ দূষিতকরণের পর্যায়ে পরে না। গৌতম বুদ্ধকে যদিও লাইট অফ এশিয়া বলা হয়ে থাকে তথাপি বৌদ্ধ ধর্মেও নারীকে সমঅধিকার দেয়ার কথা উল্লেখিত হয় নাই। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের প্রবর্তনের পর হাজার হাজার বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। তার সাথে সাথে সমাজের পরিবর্তন হয়েছে অনেক এবং এই সমাজের কাছে সেই প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম কতটা ব্যবহারিক জীবনে কার্যকর যদি না তার সংস্কার হয়? যেখানে আজও পর্যন্ত ধর্মকেই আঁকড়ে ধরে রাজনীতিবিদরা সমাজ তথা রাষ্ট্র পরিচালনার হাতিয়ার করে চলেছে। ধর্মের ফতোয়া দিয়ে নারীকে বিচারের সম্মুখীন হতে হচ্ছে আজও এই সমাজে, সমাজের গ্রামে গঞ্জে রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্র ও ধর্ম দুটো পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞা। এই সংজ্ঞা দুটো একসাথে চলতে পারে না। তাই ইউরোপ ধীরে ধীরে এই পরস্পর বিরোধী সংজ্ঞার সংঘাত থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। কয়েক বছর আগে ইউরোপে একটা সমীক্ষায় সেই দেশের মানুষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে তারা চায় একটা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা হোক। এটাও ইউরোপবাসীর মানুষের চিন্তার পরিবর্তনের ফসল এবং সেটাও সমাজের প্রয়োজনে, মানুষের কল্যাণের জন্য যুগোপযোগী চিন্তা। নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, শ্রীলংকাসহ ১৬টি দেশ (তিউনিশিয়া, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম, তাজিকিস্তান, লাটভিয়া, বুলগেরিয়া, ক্যামেরুন, চাদ, কঙ্গো, গ্যাবন, চীন, মরক্কো) বোরকা নিষিদ্ধ করেছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য। কানাডার কুইবেক প্রভিন্স এ ধর্মীয় কোনো সিম্বল নিয়ে পাবলিক সার্ভিস (পুলিশ, বিচারক এবং শিক্ষক) কাজ করা নিষেধ।
স্বল্প উন্নত, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল বিশ্বে পুরুষতন্ত্র ধর্মের বাহক হিসাবে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে সমাজের সর্বস্তরে। একজন শিশু সাধারণত জন্মসূত্রে একটি ধর্মের অধিকারী এবং ছোটবেলা থেকেই তাকে সেই বিশেষ ধর্মেই তাকে বিশ্বাসী করেই তার মননশীলতা তৈরী হয়ে থাকে। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর সে সেই ধর্মকেই শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে বিশ্বাস করে। ধর্মকে সাক্ষী রেখে পুরুষতন্ত্র অধিকার করেছে মানুষের নামকরণে, মানুষের জীবন যাত্রায়, মানুষের ভাবনায় তথা প্রথা সৃষ্টিতে। মনে করুন একটি মেয়ের নাম রাখা হলো মেঘলা। সে যদি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নেয় তাহলে তার পদবি হবে মেঘলা ভট্টাচার্জি/ভট্টাচার্যী। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন কাস্ট সিস্টেম এর কারণে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি সে হিন্দু ধর্মের কোন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। ঠিক তেমনি মেঘলা যদি বৌদ্ধ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তার নাম মেঘলা বড়ুয়া। মেঘলা যদি মুসলিম পরিবারে জন্মে তবে হবে মেঘলা ইসলাম, হক ও অন্যান্য। এর পর মেঘলা যদি বিয়ে করে তবে তার জন্মের পর বাবার পদবীর পর এবার সে নেয় তার স্বামীর পদবি (ইউরোপ ও নর্থ আমেরিকাতে হাইফেনাটেড টাইটেল ও ব্যবহার হচ্ছে। যেখানে মেয়েরা বাবার পদবি ও স্বামীর পদবি একত্রে ব্যবহার করে।
এখানে মেয়েরাই শুধু পদবি পরিবর্তনের শিকার। শুধু তাই নয় মেঘলার পদবি বহন করে তার ধর্মীয় ব্যাকগ্রাউন্ড। ধর্ম কেনো মানুষের নামের সাথে যুক্ত হয়ে লেজুড় বৃত্তি করবে? এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজেই এই ধর্মীয় প্রথা তৈরী হলো। এই মেঘলা যখন সন্তান ধারণ করে তখন মেঘলার সন্তানরা বহন করে তার স্বামীর পদবি (তবে ইদানিং ধীরে ধীরে কিছু ব্যতিক্রম যে হচ্ছে না তা নয়। যেমন আজকালকার মেয়েদের নাম হয় সংযুক্তা ঐশী, প্রজ্ঞা লাবনী, অনন্যা দীপ্তা ইত্যাদি।)। এইবার দেখি একটি নবাগত শিশুর সামাজিকীকরণ, যেমন মেঘলার যদি মেয়ে সন্তান হয় তাহলে তাকে কিনে দেয়া হয় পুতুল। আর যদি ছেলে হয় তাকে দেয়া হয় খেলনা বন্দুক, গাড়ি অথবা বল। জন্মের পর থেকে এই তফাৎটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি একটি মেয়ে শিশু ও ছেলে শিশুকে। টেলিভিশন কিংবা মাইকে যখন আজান দেয়া হয় তখন হুজুররা বা বাড়ির বয়স্করা শেখায় মাথায় কাপড় দিতে শুধুমাত্র “মেয়েদেরকেই”।
যাই হোক, মেয়েরা গৃহকোণের আবর্তন থেকে অনেকটা বেরিয়ে এলেও এখনো তারা সামাজিকভাবে পণ্য যেহেতু পুরুষরাই আধিপত্য বিস্তার করছে সমাজে ধর্মের বাহক হয়ে এবং সেটা বাণিজ্যিক পণ্যের নামকরণে, বিজ্ঞাপনে মডেল হয়ে, তথাকথিত কবিতা, গানের লাইভ অথবা ছবি সংযুক্তির আঙ্গিকে। যেমন ধরা যাক, জনৈক অধ্যাপক এর একটি বিখ্যাত গান, যেটাতে শাড়ির বর্ণনা দেয়া আছে ঠিক এইভাবে- পাঁচ ফুট শরীরে বারো হাত শাড়ি। যে বারো হাত শাড়িতেও পাঁচ ফুট শরীর ঢাকে না। তাছাড়া অনলাইনের কল্যানে ইদানিং কিছু কবিতা প্রেমী কবি, যারা প্রতিটা কবিতার শুরুতে ব্যবহার করেন একটি সুন্দরী নারীর ছবি (অংকিত চিত্রকলা নয়)। যদি তাই হয় তবে এই ইদানিংকার তথাকথিত কবিরা কেনো পুরস্কার ও বাহবা নেন সুন্দর কবিতা বা গান সৃষ্টিতে মেয়েদের ছবিকে প্রাধান্য করে?
এটা ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নয় কি? যেখানে নারীর পোশাককে সমালোচনা করে ধর্মীয় রীতি ব্যাহত হওয়ার কারণে এবং তাকে আবার পণ্য হিসাবে ব্যবহার করে প্রসিদ্ধি লাভ করা (বলা যেতে পারে একই হাটে একটি মেয়েকে দুইবার বিক্রি)। বিপরীত দিকে এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না সেখানে জসিমুদ্দিন, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জয়নুল আবেদীন কিংবা শরৎচন্দ্র নারীর শরীর দেখা যায় বলে তাঁরা আক্ষেপ করেছিলেন অথবা নারীর লাইভ চেহারা সম্বলিত ছবি সংযুক্তি ছিল তাঁদের বিখ্যাত সব কবিতাতে বা গল্পে। সেইযুগে আমরা দেখতে পাই বাংলা সাহিত্যের কবি লেখকদের কাব্যে সেই চিরায়ত মানুষের আবেগ অনুভূতি, সুখ দুঃখের চিত্র, প্রকৃতির অপরূপ বর্ণনায় সমৃদ্ধ ছিল সংগীত, সাহিত্য, চিত্রকলা কিংবা চলচিত্র। এই সব ক্ষেত্রগুলির গুণগত মান ছিলো উন্নত এবং সমাজের জন্য একটা শিক্ষণীয় বার্তা নিয়ে আসতো। এই মাধ্যমগুলি এখন নি¤œগামী (স্ট্যাটিস্টিক্স এ কোনো কিছুর স্যাম্পলিং বা নমুনায়নে খারাপের সংখ্যা বেশি হলে তখন অল্প কিছু ভালো হলে ও তা উল্লেখিত হয় না)।
ধর্মের ভালোমন্দের হাত অনেক বিস্তৃত। বাংলাদেশ ও ভারতসহ এশিয়ার অনেক দেশে এখনও চাকুরীর দরখাস্তে লিখতে হয় ধর্ম কি, লিঙ্গ কি এবং সংযুক্ত করতে হয় পাসপোর্ট সাইজের ছবি। বলাই বাহুল্য যে, অন্য দিকে নর্থ আমেরিকা ও ইউরোপে চাকুরীর দরখাস্তে আবেদনকারীর ধর্ম বা জেন্ডার উল্লেখ করতে হয় না। তাছাড়া চাকুরীর দরখাস্তে ছবিও সংযুক্ত করতে হয় না এখানে। শুধুমাত্র আবেদনকারীর যোগ্যতাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। সমাজের অন্যান্য বিভিন্ন দরখাস্ত পূরণে জেন্ডারের ক্ষেত্রে শুধু মহিলা বা পুরুষ ছাড়াও আরো অনেক কলাম রয়েছে নিজেকে কি হিসাবে পরিচিতি হতে দেখতে চান একজন মানুষ LGBTQ + (Lesbian Gay Bisexual Transgender Queer এবং অন্যান্য) হিসাবে। তদুপরি অন্য কোনো দরখাস্ত পূরণে ধর্মে বিশ্বাসী কিনা সেটাও জানানোর বা না জানানোর অধিকার আছে একজন মানুষের এই নর্থ আমেরিকা ও ইউরোপে।
আর প্রথাগত ধর্মীয় রীতি অনুসারে শবদেহ দাহ বা কবর না দিয়ে উন্নত বিশ্বে মানুষ তাঁর শরীর দান করে দেন মানুষের কল্যানে এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য। এই ডোনারদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছেই ইউরোপ ও নর্থ আমেরিকাতে। শিখ স¤প্রদায়ের মন্দিরের স্লোগান হলো, ‘ফুড ফর সোল’ অর্থাৎ মানুষের আত্মার তৃপ্তির জন্যই খাদ্য? সব ধর্মের মানুষকেই তাঁরা আমন্ত্রণ করেন বিনামূল্যে খাদ্য পরিবেশনের মাধ্যমে। ঠিক দুর্গাপূজার মায়ের প্রসাদের মতো। বড়দিনের আনন্দ সবাই উপভোগ করে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এবং নর্থ আমেরিকার প্রায় প্রতিটা মানুষের ঘরে শোভা পায় খ্রীষ্টমাস ট্রি। ধর্ম এখানে সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়েছে সার্বজনীন উৎসবে। এখানে অনেক দানবীর আছেন যাঁরা প্রথাগতভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা করতে যান না কিন্তু সারাজীবনের সঞ্চয় দান করে যান হাসপাতালের ফান্ডে কিংবা গবেষণার কাজে। মানব ধর্ম এখানে ধীরে ধীরে সঞ্চারিত হয়েছে সামাজিক সংস্কৃতিতে ও মানুষের কল্যাণের অগ্রগতিতে।
আরজ আলী মাতুব্বর বাংলাদেশের সামাজিক জীবনের অনেক বৈসাদৃশ তুলে ধরেন তাঁর রচনা সামগ্রীতে এবং তিনি বলেন, “ধর্মজগতে এরূপ কতগুলি নীতি, প্রথা, সংস্কার ইত্যাদি এবং ঘটনার বিবরণ প্রচলিত আছে, যাহা সাধারণ মানুষের বোধগম্য নহে, এবং ওগুলির দর্শন ও বিজ্ঞানের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ নহে এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বিপরীত ও বটে।” নিঃসন্দেহে ধর্মের সহাবস্থান ও স¤িপ্রতি দেখতে ভালো লাগে সবার কিন্তু ধর্মীয় উগ্রতা বেদনাদায়ক। প্রকৃত ধার্মিক তার মনুষ্যত্বকে বিকাশ করে ধর্মের বাণী দিয়ে, ধর্ম পালন করে। আবার প্রথাগত ধর্ম পালন না করেও মানব ধর্ম পালন করার ও অনেক দৃষ্টান্ত আছে পৃথিবীতে । প্রকৃত ধর্ম মনে প্রশান্তি আনে। কোনো ধর্ম গ্রন্থ বলেনা অন্যকে হীন কাজ করতে কিন্তু ধর্মের বাহক হয়ে এর বিচার বিশ্লেষণ যারা করে তারাই তাদের নিজেদের ব্যক্তি সন্তুষ্টির জন্য ধর্মকে হাতিয়ার করে তুলছে প্রথা ও সংস্কার দিয়ে । ধর্ম সমাজে একসময় শৃঙ্খলা যেমন এনেছিল তেমনি এর অপব্যবহার শৃঙ্খলিত করে মানুষকে। ধর্ম তখনি সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন একের ধর্ম বিশ্বাস অন্যকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে একক ভাবে, সামাজিকভাবে অথবা রাষ্ট্রীয় কাঠামোগত ভাবে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সংখ্যাগুরুদের মাধ্যমে বাংলাদেশে যেমন হিন্দুরা নির্যাতিত ঠিক তেমনি মুসলমানরা নির্যাতিত ভারতে। ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং পরম্পরায় এটি অর্জিত হলেও আধুনিক যুগে মানুষের সত্যের অনুসন্ধিৎসা চির বহমান । তাই হয়তো দালাই লামা বলেন, ”This is my simple religion. There is no need for temples; no need for complicated philosophy. Our own brain, our own heart is our temple; the philosophy is kindness.”
টরন্টো, কানাডা