অনলাইন ডেস্ক : টেস্ট না করেই করোনার রিপোর্ট নিয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ারের প্রতারণা প্রকাশ্যে আসার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তার বিরুদ্ধে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর।

পুলিশ বলছে, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্টার চিকিৎসক হিসেবে চাকরিরত থেকেই জেকেজির চেয়ারম্যান পদে ছিলেন ডা. সাবরিনা। কিভাবে, কার মাধ্যমে তিনি এ কাজ হাতিয়েছেন, সে ব্যাপারে চলছে অনুসন্ধান। তদন্তে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে সাবরিনাকে গ্রেফতার করা হবে। জানা গেছে, স্বামী আরিফ চৌধুরী গ্রেফতার হওয়ার পর সাবরিনা গা ঢাকা দিয়েছেন।

জানা যায়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ৪৬০টি টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করে। এসব টেস্টে জনপ্রতি হাতিয়ে নেয়া হয়েছে ৫ হাজার টাকা। আর বিদেশিদের কাছ থেকে নেয় একশ’ ডলার। এ হিসাবে ভুয়া টেস্ট বাণিজ্য করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৮ কোটি টাকা।

২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে প্রতারক আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের ২ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। দু’জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। জেকেজির কার্যালয় থেকে ল্যাপটপসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি জব্দ করে পুলিশ। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার কোনোটিতে এখন পর্যন্ত ডা. সাবরিনার নাম সংযুক্ত করা হয়নি। চারটি মামলার তদন্ত করছে তেজগাঁও থানা পুলিশ।

ওই থানার পরিদর্শক আবুল হাসনাত খোন্দকার বলেন, মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। আমি নিজেও একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তদন্তে ডা. সাবরিনার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে মামলায় আসামি দেখানো হবে।

জানতে চাইলে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন শুক্রবার জানান, সাবরিনার বিষয়টি হাসপাতালের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে তদন্ত করতে বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলাম। আজই বাসায় ফিরেছি। তিনি (ডা. সাবরিনা) ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন কিনা খোঁজ নিতে হাসপাতালের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধানকে নির্দেশ দিয়েছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জেকেজি ২৭ হাজার রোগীর করোনার টেস্টের রিপোর্ট দেয়। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনার আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ রিপোর্ট তারা নিজেরা তৈরি করেছে। জেকেজির ৭-৮ জন কর্মী মিলে ভুয়া এসব রিপোর্ট তৈরি করে।

প্রতিষ্ঠানটির মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেয়া লোকজনের নমুনা সংগ্রহ করত। রোগীদের ১০টি প্রশ্ন দেয়া হতো। এর মধ্যে ৫টির বেশি প্রশ্ন যদি করোনা উপসর্গের হতো তবেই তাকে করোনা পজিটিভ রিপোর্ট দেয়া হতো। অন্যদের দেয়া হতো নেগেটিভ রিপোর্ট। এভাবেই চলছিল তাদের করোনা পরীক্ষার প্রতারণা।

নমুনা সংগ্রহের জন্য জেকেজির হটলাইন নম্বর ছিল। ওই নম্বরে কেউ ফোন করলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা তার বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করত। আবার অনেকে জেকেজির বুথে এসে নমুনা দিতেন। বিদেশি নাগরিকদের জন্য নেয়া হতো ১০০ ডলার। আর বাংলাদেশিদের জন্য সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। আর কোনো মাঠকর্মী বাসায় যাতায়াত করলে তার জন্য নেয়া হতো ১ হাজার টাকা। যদিও দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির ভিত্তিতে বিনামূল্যে তাদের স্যাম্পল কালেকশন করার কথা ছিল।

জেকেজিতে চাকরি করতেন নার্স তানজিনা পাটোয়ারি ও তার স্বামী হুমায়ূন কবির। তানজিনার বেতন ছিল ৩০ হাজার টাকা। ভুয়া করোনা পরীক্ষা করে কোটি কোটি টাকা কামানো দেখে তানজিনা দাবি করেন তার বেতন বাড়িয়ে দিতে হবে। বিষয়টি জেকেজির কর্ণধার আরিফ চৌধুরী জেনে তানজিনা ও তার স্বামীকে চাকরিচ্যুত করেন। পরে তারা দু’জন বাসায় বসে নিজেরাই করোনার ভুয়া টেস্টের বাণিজ্য চালান।

তানজিনা নমুনা সংগ্রহ করতেন আর ঘরে বসে তার স্বামী রিপোর্ট তৈরি করতেন। ২৩ জুন রাতে তানজিনা ও তার স্বামী গ্রেফতার হওয়ার পর বেরিয়ে আসে জেকেজির প্রতারণার রহস্য। এরপর জেকেজির গুলশান অফিসে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় প্রতারক আরিফ চৌধুরীসহ অন্যদের।

ওইদিনই প্রতিষ্ঠানটির কিছু কর্মী আরিফকে ছাড়িয়ে নিতে তেজগাঁও থানায় জড়ো হন। তারা থানার বাইরে হট্টগোল করতে থাকেন। এ ঘটনায় পৃথক একটি মামলা হয়েছে। ওই মামলায় ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, ডা. সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি ভাগিয়ে নেয় জেকেজি। প্রথমে তিতুমীর কলেজে মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এবং অনেক জেলা থেকেও সংগ্রহ করা হয় নমুনা। সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে টেস্ট করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে জেকেজির যে চুক্তি ছিল তা বাতিল করা হয়েছে।