সিনহা মনসুর : এক.
মেষ বালকের নাম সান্টিয়াগো। ছেলেবেলা থেকেই জগত সম্পর্কে তার অধির আগ্রহ! বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে ধর্ম-যাজক বানাতে! কিন্তু ছেলে চায় জগতকে জানতে। ঈশ্বর ও মানুষের পাপ সম্পর্কে জানার চেয়ে জগত সম্পর্কে জানা তার কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ!
তার মন পরে রয় ভ্রমণে! পথ আর পথের পাঁচালীতে!
একদিন কথাটা সে বাবাকে জানায়। বাবা বাঁধা দেননি। বরং হাতে দিলেন তিনটি স্বর্ণমুদ্রা। তা দিয়ে কেনা হল এক পাল মেষ। ল্যাটিন আর ধর্ম-তত্ব পড়া যুবক সান্টিয়াগো হয়ে গেল মেষ পালক! কারণ মেষ পালকেরা ঘুরে বেড়ায় দূর-দুরান্তে!
পরের কয়েক বছর সে পুরো আন্দালুসিয়া ঘুরে বেরিয়েছে। সংগে ছিল তার ভেড়ার দল। এদের ভাষা সে বোঝে। মাঝে মাঝে সে বই পড়ে শোনায় ওদেরকে! কিন্তু ভেড়ারা উদাসীন। খাওয়া আর পানীয় ছাড়া অন্য কোন চিন্তাই ওদের বিচলিত করে না! ভেড়ার পশম বিক্রির জন্য সান্টিয়াগো আশেপাশের সব শহর ও গ্রামগুলোতে যায়। ওইরকম একটি গ্রামে একটি ব্যবসায়ীর মেয়েকে তার ভাল লাগে। মেয়ের বাবা গত বছর সান্টিয়াগোর কাছ থেকে ভেড়ার পশম কিনেছিলো। এ বছরও কিনবে সেই আশায় সে যাচ্ছে সেই গ্রামে। তবে সবচেয়ে বড় আশা মেয়েটিকে দেখবে এবং হয়তো বলবে তার ভাল লাগার কথা! সান্টিয়াগোর চলেছে ওই গ্রামের উদ্দেশ্যে!
এই হচ্ছে ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলহো রচিত ‘দ্যা আলকেমিস্ট’ উপন্যাসের প্রস্তাবনা। মূল উপন্যাসটি পর্তুগিজ ভাষায় রচিত। পরে অনুদিত হয়েছে অন্তত ৮০টি ভিন্ন ভাষায়! এটি একটি রূপকধর্মী উপন্যাস। পাওলো কোয়েলহো ১৯৮৭ সালে মাত্র দুই সপ্তাহে এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন। তিনি বলেন:
‘এটি আমার হৃদয়ে ছিল বলে আমার লিখতে তেমন বেগ পেতে হয়নি’!
ব্যাপারটা তাই! হৃদয়ের টানে লেখক লিখেছেন তার উপন্যাস, হৃদয়ের টানে তার নায়ক হয়েছেন মেষ পালক!
অথবা এটাই ছিল তার নিয়তি!
স্বপ্ন ও স্বপ্নের টানে কিভাবে এই মেষ পালক জড়িয়ে পড়ল এক অমোঘ যাত্রায় সেটাই আমরা জানবো এই উপাখ্যানে!
আরো জানবো সেই দর্শনের কথা যা হচ্ছে:
‘যখন তুমি মন থেকে কিছু চাও, পুরো বিশ্ব তা পেতে তোমাকে সাহায্য করবে’!
অথবা-
‘প্রত্যেক ব্যক্তি-ই পৃথিবীর ইতিহাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের ভূমিকা পালন করে যা অনেক সময় সে নিজেও জানে না’!
দুই.
ভাংগা গির্জায় বসে যুবক স্বপ্ন দেখে যে মিসরের পিরামিডের কাছে গুপ্তধন লুকানো আছে। এক নয়, একাধিকবারের এই স্বপ্ন! এই স্বপ্নের অর্থ জানার জন্য সে প্রথমে এক মহিলার সাহায্য নেয় যিনি তাকে মিসরে যাবার পরামর্শ দেন। এরপরে একজন বৃদ্ধ লোকের সাথে তার কথা হয় যিনি নিজেকে সালেমের রাজা বলে পরিচয় দেন। তিনি সান্টিয়াগোকে পরামর্শ দেন স্বপ্নের খোঁজে পথে নামতে!
রাজা তাকে বলে, তার ব্যক্তিগত কিংবদন্তি:
‘যা সে বরাবরই অর্জন করতে চেয়েছিল তা হল প্রত্যেকে, যখন তারা যুবক হয়, তখন তাদের ব্যক্তিগত কিংবদন্তিটি কী তা জানে’!
মেলচিজেডেক নামক ওই বৃদ্ধ তাকে মানুষের জীবন, জীবনের লক্ষ্য নিয়ে অধিবিদ্যক জ্ঞান দেন, আর দেন ‘ইউরিম’ আর ‘থেম্মিম’ নামের দু’টো মূল্যবান পাথর। তিনি বলেন:
‘যখন কেউ তার জীবনের লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করে, পুরো বিশ্ব তাকে সাহায্য করে’! অবশেষে সান্টিয়াগো তার ভেড়ার পাল বিক্রি করে দিয়ে পিরামিডের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়।
উপন্যাসের এই অংশটুকু ‘মেটাফর’!
কে ওই রাজা?
সেকি মহারতের কোন মণি-ঋষি?
ঠাকুর মা’র ঝুলির ঠা’কুমা? যে তাকে ব্যাংমা-ব্যাংমির গল্প শোনাচ্ছে! অথবা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা!
ভিন্নরুপে! ভিন্ন প্রেক্ষিতে!
যে তাকে জীবন-সত্য জানাতে পথে নামাতে চাইছে?
পথের টানে, সান্টিয়াগো প্রথমে আফ্রিকা যায় এবং সেখানে গিয়ে এক চোরের পাল্লায় পড়ে তার সমস্ত অর্থ সম্পদ হারায়। সাময়িকভাবে ভেঙে পড়লেও সে আবার ঘুরে দাঁড়ায় এবং পাহাড়চূড়ার একটি কাচের দোকানে কাজ নেয়। ব্যবসায় লাভবান হয়ে সে টাকা জমায়। এরপরে সে আবার পাড়ি জমায় পিরামিডের উদ্দেশ্যে!
মরুভূমি পাড়ি দেবার সময় তার পরিচয় ঘটে একজন ইংরেজের সাথে। সেই ইংরেজ কোন এক এলকেমিস্টের সন্ধান করছেন যিনি তাঁকে এলকেমি সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান দিতে পারবেন। মরুভূমি পাড়ি দেয়ার পথে তারা গোত্র-যুদ্ধের কারণে একটি মরূদ্যানে আশ্রয় নেয়। সেখানে ইংরেজের সাথে এলকেমিস্টকে খুঁজতে গিয়ে সান্টিয়াগোর পরিচয় হয় ফাতেমার সাথে। তারা দুজন দুজনার প্রেমে পড়ে যায়। ইতোমধ্যে সান্টিয়াগো দেখা পায় সেই এলকেমিস্টের। এরপরে এলকেমিস্টের সহযোগিতায় সে পা বাড়ায় মরুভূমির পথে, গুপ্তধনের সন্ধানে!
কিন্তু পিরামিডের কাছে সেই গুপ্তধন সে পায়নি! যা সে পেয়েছিল তা গুপ্তধনের চাইতেও অনেক অনেক বড়! তা হলো জীবনের গুঢ় রহস্য- এই মহাবিশ্বের ভাষা বোঝার ক্ষমতা! যে ভাষায় স্রষ্টা আর সৃষ্টির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত!
যে ভাষা বুঝলে বোঝা যায় সৃষ্টি! বোঝা যায় স্রষ্টার উদ্দেশ্য!
যে কেউ প্রবেশ করতে পারে বিশ্বের আত্মা’য়!
জীবন একটা বড় ভ্রমণ, যেখানে প্রতিটা মানুষ একটা নির্দিষ্ট চরিত্র পালন করছে এবং কোনো চরিত্রই চিরস্থায়ী নয়। আমাদের সবার জনেই রয়েছে সংরক্ষিত গুপ্তধন! সেই গুপ্তধন আবিষ্কারের খোঁজে পথে নামতে হয়!
ত্যাগ স্বীকার করতে হয়!
তাহলেই ধরা দেয় সেই গুপ্তধন!
তিন.
মানুষ কেন স্বপ্ন দেখে?
কে তাকে স্বপ্ন দেখায়?
এ এক মৌলিক প্রশ্ন?
সৃষ্টিকর্তাই কি তাকে তাকে স্বপ্ন দেখায়? স্বপ্নের জন্যে পথে নামায়?
যা’তে করে সে মহা বিশ্বের ভাষা বুঝতে পারে?
উপন্যাসটি পাঠ করার পরে, এইরকম বিবিধ প্রশ্ন আমার মাথায় এসেছে! সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে, তা কেন?
এটাই তো সৃষ্টির মাহাত্ম্য!
উপরন্তু এগুলো কি আসলেই স্বপ্ন?
না জীবন-প্রণালী?
ভাগ্যপূরণ আদৌ সম্ভব কি-না? আরো কত শত প্রশ্ন?
মাথায় এতসব প্রশ্নের উদ্রেককারী লেখক পাওলো কোয়েলহোকে আমার স্বপ্নীল অভিবাদন!
‘দ্য আলকেমিস্ট পড়া মানে খুব ভোরে জেগে উঠে সূর্যোদয় দেখা, বাকি পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে’!
ভোরের প্রথম আলো মনের আঁধার দূর করে। আলকেমিস্টও জীবনের আঁধার দূর কিছুটা দূর করেছে!
দূর করেছে হতাশা!
দেখিয়েছে আশার আলো!
দিয়েছে ব্যর্থতা ঠেলে সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছাতে অনুপ্রেরণা!
মনোযোগী পাঠক মাত্রেই এই বই পাঠে অন্ধকার গলিপথ ছেড়ে আসবেন আলোর মহাসড়কে!
ওই মহাসড়ক জীবাত্মা আর বিশ্ব-আত্মার ইট-সুরকিতে তৈরী!
হৃদয়ের দিয়ে ঘটাতে হয় এ দুই আত্মার মিশেল!
যারা স্বপ্ন দেখেন,যারা কোনো বিষয়কে নিজের লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করেছেন এবং সত্যিই সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চান তাদের জন্যই এই বই: ‘দ্যা আলকেমিস্ট’!
সচেতন পাঠকের বইটি পড়া উচিত।
একবার নয়, বার বার!