সোনা কান্তি বড়ুয়া : বুদ্ধভূমি স্মৃতির পটে পুন্ড্রবর্দ্ধনে (বগুড়া) গৌতমবুদ্ধের বাংলাদেশ! বাংলার বুক জুড়ে মাটির নীচে ও উপরে বুদ্ধমূর্তি বিরাজমান। প্রাচীন বাংলাদেশে মহাস্থানের পুন্ড্রবর্দ্ধনে (বগুড়া) এবং পাহারপুরে (রাজশাহীর সোমপুরী বিহার) বসে গৌতমবুদ্ধ দিনের পর দিন বাঙালি সমাজকে দান, শীল, ভাবনা এবং সুন্দর ভাবে জীবন যাপনের শিক্ষা দিয়েছেন। Sanskrit এবং দেবভাষায় কোন লিপি নেই (দেশ, ১৪ পৃষ্ঠা, কলকাতা, ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২)।” গৌতমবুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার এই সামাজিক বিকৃতির হাত থেকে জনতাকে রক্ষা করেন। কারণ দেশ ও ভাষা বাঙালীর কাছে নিরেট বাস্তব, অতিশয় অপরিহার্য। চর্যাপদ পাঠ এবং গবেষণার সময় মনে হবে বাংলা কেবল একটি দেশ নয়, সে একটি সভ্যতা, একটি সংস্কৃতি, একটি অপাপবিদ্ধ জীবনাদর্শ বা জীবন দর্শনের প্রতীক, যার মর্মবাণী হল বিশ্ব মানবতাবাদ। টরন্টোয় বসে আমি আমার কবিতা রচনা করেছি:

রাজশাহীর পাহাড়পুর এবং বগুড়ার মহাস্থানগড়ে
গৌতমবুদ্ধের শিক্ষা দীক্ষা ছিল বিশ্বশান্তির তরে।
সিদ্ধার্থের রাজসিংহাসন ত্যাগ মানব কল্যাণে
মনের আঁধার জয়ী বুদ্ধ গয়ার উরবিল্ব বনে।
লোভকে জয় করা সহজ কাজ নয়
বোধিবৃক্ষতলে বুদ্ধত্ব লাভ মারের পরাজয়।
বুদ্ধ গয়া বৌদ্ধদের পূজনীয় পরম তীর্থভুমি
বিধর্মীরা হিংসা করে বোমা মারলে তুমি?
বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্মৃতির মনিমালায় পোড়ামাটির শিল্পকর্মে “গৌতমবুদ্ধ ধর্মচক্র মূদ্রায়” আজও South Asian countries এবং বাংলাদেশে বিরাজমান। মনে মৈত্রী করুণ রস, বাণী অমৃত পদ। জনে জনে হিতের তরে, পড়েন গৌতমবুদ্ধের জীবনী এবং চর্যাপদ। পরম পূজনীয় গৌতমবুদ্ধকে সশ্রদ্ধ বন্দনা করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতা লিখেছিলেন,
“ওই নামে ধন্য হলো একদিন তব জন্মভূমি
আর বার সেই নাম
এ দেশের নগরে প্রান্তরে দান কর তুমি।”

বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক ইউয়েন চোয়াঙ ৬৩৯ খৃষ্ঠাব্দ থেকে ৬৪৫ খৃষ্ঠাব্দের মধ্যে পুন্ড্রবর্ধন (বগুড়া) পরিভ্রমণ করেন। তিনি তখন বাংলাদেশে অনেক বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ছাড়া ও নগরের (বগুড়া) কাছে এক বিরাট বৌদ্ধ বিহার দর্শন করেন। ধর্মচক্র মূদ্রা বা ভূমিস্পর্শ মূদ্রায় বজ্রসত্ত¡ বা বুদ্ধকে বর্ণনা করার মতো কলম, অথবা এঁকে দেখাবার মতো তুলি আমার নেই। শুধু আমি আমার বিদ্যাবুদ্ধিতে এটুকু বলতে পারি বাংলাদেশের বুদ্ধমূর্তির চিত্রে এমন একটা কিছু আছে যার জন্যে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা যায়। বাব বার ফিরে ফিরে এঁকে দেখলে ও চোখ ক্লান্ত হয় না, পীড়িত হয় না। বাংলাদেশে একাধিক বুদ্ধমূর্তি আছে যা নাকি শুধু বিভিন্ন পদার্থ দিয়ে বানানো নয়, যেন তাঁর মধ্যে হাজার বছর ধরে বন্দী হয়ে আছে শিল্পীর অনুক্ত কথা, একটি অপ্রকাশিত ধ্যানের মন্ত্র। যা খোলা নয়, ঢাকা।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “জীবন স্মৃতির” ভাষায়: “স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা কিছু ঘটিতেছে, তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি-অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড়ো করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।

এইরূপে জীবনের বাইরের দিকে ঘটনার ধারা চলিয়াছে, আর ভিতরের দিকে সঙ্গে সঙ্গে ছবি আঁকা চলিতেছে। দুয়ের মধ্যে যোগ আছে অথচ দু’ই ঠিক এক নহে। আমাদের ভিতরের এই চিত্রপটের দিকে ভালো করিয়া তাকাইবার আমাদের অবসর থাকে না। ক্ষণে ক্ষণে ইহার এক-একটা অংশের দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করি। কিন্তু ইহার অধিকাংশই অন্ধকারে অগোচরে পড়িয়া থাকে। যে-চিত্রকর অনবরত আঁকিতেছে, সে যে কেন আঁকিতেছে, তাহার আঁকা যখন শেষ হইবে তখন এই ছবিগুলি যে কোন্ চিত্রশালায় টাঙাইয়া রাখা হইবে, তাহা কে বলিতে পারে।

কয়েক বৎসর পূর্বে একদিন কেহ আমাকে আমার জীবনের ঘটনা জিজ্ঞাসা করাতে, একবার এই ছবির ঘরে খবর লইতে গিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম, জীবনবৃত্তান্তের দুই-চারিটা মোটামুটি উপকরণ সংগ্রহ করিয়া ক্ষান্ত হইব। কিন্তু দ্বার খুলিয়া দেখিতে পাইলাম, জীবনের স্মৃতি জীবনের ইতিহাস নহে– তাহা কোন্-এক অদৃশ্য চিত্রকরের স্বহস্তের রচনা। তাহাতে নানা জায়গায় যে নানা রঙ পড়িয়াছে, তাহা বাহিরের প্রতিবিম্ব নহে- সে-রঙ তাহার নিজের ভাণ্ডারের, সে-রঙ তাহাকে নিজের রসে গুলিয়া লইতে হইয়াছে- সুতরাং, পটের উপর যে-ছাপ পড়িয়াছে তাহা আদালতে সাক্ষ্য দিবার কাজে লাগিবে না।

এই স্মৃতির ভাণ্ডারে অত্যন্ত যথাযথরূপে ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা ব্যর্থ হইতে পারে কিন্তু ছবি দেখার একটা নেশা আছে, সেই নেশা আমাকে পাইয়া বসিল। যখন পথিক যে-পথটাতে চলিতেছে বা যে-পান্থশালায় বাস করিতেছে, তখন সে-পথ বা সে পান্থশালা তাহার কাছে ছবি নহে- তখন তাহা অত্যন্ত বেশি প্রয়োজনীয় এবং অত্যন্ত অধিক প্রত্যক্ষ। যখন প্রয়োজন চুকিয়াছে, যখন পথিক তাহা পার হইয়া আসিয়াছে তখনই তাহা ছবি হইয়া দেখা দেয়। জীবনের প্রভাতে যে-সকল শহর এবং মাঠ, নদী এবং পাহাড়ের ভিতর দিয়া চলিতে হইয়াছে, অপরাহ্নে বিশ্রামশালায় প্রবেশের পূর্বে যখন তাহার দিকে ফিরিয়া তাকানো যায়, তখন আসন্ন দিবাবসানের আলোকে সমস্তটা ছবি হইয়া চোখে পড়ে। পিছন ফিরিয়া সেই ছবি দেখার অবসর যখন ঘটিল, সেদিকে একবার যখন তাকাইলাম, তখন তাহাতেই মন নিবিষ্ট হইয়া গেল।

মনের মধ্যে যে-ঔৎসুক্য জন্মিল তাহা কি কেবলমাত্র নিজের অতীতজীবনের প্রতি স্বাভাবিক মমত্বজনিত। অবশ্য, মমতা কিছু না থাকিয়া যায় না, কিন্তু ছবি বলিয়াই ছবিরও একটা আকর্ষণ আছে। উত্তররামচরিতের প্রথম অঙ্কে সীতার চিত্তবিনোদনের জন্য লক্ষ্ণণ যে-ছবিগুলি তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহাদের সঙ্গে সীতার জীবনের যোগ ছিল বলিয়াই যে তাহারা মনোহর, তাহা সম্পূর্ণ সত্য নহে।

এই স্মৃতির মধ্যে এমন কিছুই নাই যাহা চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবার যোগ্য। কিন্তু বিষয়ের মর্যাদার উপরেই যে সাহিত্যের নির্ভর তাহা নহে; যাহা ভালো করিয়া অনুভব করিয়াছি, তাহাকে অনুভবগম্য করিয়া তুলিতে পারিলেই মানুষের কাছে তাহার আদর আছে। নিজের স্মৃতির মধ্যে যাহা চিত্ররূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাকে কথার মধ্যে ফুটাইতে পারিলেই, তাহা সাহিত্যে স্থান পাইবার যোগ্য।

এই স্মৃতিচিত্রগুলিও সেইরূপ সাহিত্যের সামগ্রী। ইহাকে জীবনবৃত্তান্ত লিখিবার চেষ্টা হিসাবে গণ্য করিলে ভুল করা হইবে। সে-হিসাবে এ লেখা নিতান্ত অসম্পূর্ণ এবং অনাবশ্যক। স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহাকিছু ঘটিতেছে, তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি-অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটোকে বড়ো করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।”
বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস জুড়ে গৌতমবুদ্ধ বিরাজমান। বিশ্বকোষ (১৩শ ভাগ, পৃষ্ঠা ৬৫) থেকে একটি ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি উল্লেখ করা গেল, “কিয়ৎকাল পরে সিদ্ধার্থ গুরুগৃহে গমনের পূবেই তিনি ব্রাহ্মী- বঙ্গলিপিসহ ৬৪ প্রকার লিপি অবগত ছিলেন।” লেখক মুকুল সাহার মতে, “সমস্ত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে লিপির কোন স্থান নেই। ধর্মের ঘৃতে রাজনীতির মধু মিশে বিষক্রিয়া হয় এবং জাতিভেদ প্রথার মাধ্যমে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যসংস্কৃতি Political Hindu ধর্মের অপব্যবহার করে লেখাকে নরকের দ্বার স্বরূপ ফতোয়া জারি করে বিধান দিলেন, “স্বরস্বতী বাগদেবী, লিপির দেবী নয়।

ইতিহাসের আলোকে বিজয় সেন সুদূর কর্ণাটক থেকে এসে বাংলা দখল করে নিল এবং বহিরাগত সেন রাজারা যে চারশ বছরের পাল সাম্রাজ্যের সমদর্শী সংস্কৃতি ও প্রচলিত বৌদ্ধধর্মের বিলোপ ঘটিয়েছে। ভাষা আন্দোলন না হলে, বাংলা ভাষা ও বৌদ্ধধর্মের মতো দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতো। অবিশ্বাস্য হলে ও সত্যি যে, গৌতমবুদ্ধের সময় বাংলাদেশে দনোত্তম কঠিন চীবর দানের ইতিহাসসহ বাংলা ভাষার আদিরূপরেখার অস্তিত্ব বগুড়ার মহাস্থানগড়ে সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে আজ থেকে দুই হাজার তিনশত বছর আগেই বিদ্যমান ছিল। উক্ত ঐতিহাসিক শিলালিপি খন্ডখানি আজও কলিকাতা যাদুঘরে দৃশ্যমান।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়:
“সেদিন প্রভাতে সূর্য এইমতো উঠেছে অম্বরে
অরণ্যের বন্দনমর্মরে;
নীলিম বাষ্পের স্পর্শ লভি
শৈলশ্রেণী দেখা দেয় যেন ধরণীর স্বপ্নচ্ছবি।
নারিকেল-বনপ্রান্তে নরপতি বসিল একাকী
ধ্যানমগ্ন-আঁখি।
উচ্চে উচ্ছ¡সিল প্রাণ অন্তহীন আকাঙক্ষাতে,
কী সাহসে চাহিল পাঠাতে
আপন পূজার মন্ত্র যুগযুগান্তরে।
অপরূপ অমৃত অক্ষরে
লিখিল বিচিত্র লেখা; সাধকের ভক্তির পিপাসা
রচিল আপন মহাভাষা —
সর্বকাল সর্বজন
আনন্দে পড়িতে পারে যে ভাষার লিপির লিখন।
সে লিপি ধরিল দ্বীপ আপন বক্ষের মাঝখানে,
সে লিপি তুলিল গিরি আকাশের পানে।
সে লিপির বাণী সনাতন
করেছে গ্রহণ
প্রথম উদিত সূর্য শতাব্দীর প্রত্যহ প্রভাতে।
অদূরে নদীর কিনারাতে
আলবাঁধা মাঠে
কত যুগ ধরে চাষী ধান বোনে আর ধান কাটে,–
আঁধারে আলোয়
প্রত্যহের প্রাণলীলা সাদায় কালোয়
ছায়ানাট্যে ক্ষণিকের নৃত্যচ্ছবি যায় লিখে লিখে,
লুপ্ত হয় নিমিখে নিমিখে।
কালের সে-লুকাচুরি, তারি মাঝে সংকল্প সে কার
প্রতিদিন করে মন্ত্রোচ্চার,
বলে অবিশ্রাম,–
“বুদ্ধের শরণ লইলাম।”
প্রাণ যার দুদিনের, নাম যার মিলাল নিঃশেষে
সংখ্যাতীত বিস্মৃতের দেশে,
পাষাণের ছন্দে ছন্দে বাঁধিয়া গেছে সে
আপনার অক্ষয় প্রণাম, —
“বুদ্ধের শরণ লইলাম।”
কত যাত্রী কতকাল ধরে
নম্রশিরে দাঁড়ায়েছে হেথা করজোড়ে।
পূজার গম্ভীর ভাষা খুঁজিতে এসেছে কতদিন,
তাদের আপনকণ্ঠ ক্ষীণ।
ইঙ্গিতপুঞ্জিত তুঙ্গ পাষাণের সংগীতের তানে
আকাশের পানে
উঠেছে তাদের নাম,
জেগেছে অনন্ত ধ্বনি, — “বুদ্ধের শরণ লইলাম।”
অর্থ আজ হারায়েছে সে যুগের লিখা,
নেমেছে বিস্মৃতিকুহেলিকা।
অর্ঘ্যশূন্য কৌতূহলে দেখে যায় দলে দলে আসি
ভ্রমণবিলাসী, —
বোধশূন্য দৃষ্টি তার নিরর্থক দৃশ্য চলে গ্রাসি।
চিত্ত আজি শান্তিহীন লোভের বিকারে,
হৃদয় নীরস অহংকারে
ক্ষিপ্রগতি বাসনার তাড়নায় তৃপ্তিহীন ত্বরা,
কম্পমান ধরা;
বেগ শুধু বেড়ে চলে ঊর্ধ্বশ্বাসে মৃগয়া-উদ্দেশে,
লক্ষ্য ছোটে পথে পথে, কোথাও পৌঁছে না পরিশেষে;
অন্তহারা সঞ্চয়ের আহুতি মাগিয়া
সর্বগ্রাসী ক্ষুধানল উঠেছে জাগিয়া;
তাই আসিয়াছে দিন,
পীড়িত মানুষ মুক্তিহীন,
আবার তাহারে
আসিতে হবে যে তীর্থদ্বারে
শুনিবারে
পাষাণের মৌনতটে যে বাণী রয়েছে চিরস্থির —
কোলাহল ভেদ করি শত শতাব্দীর
আকাশে উঠিছে অবিরাম
অমেয় প্রেমের মন্ত্র, — “বুদ্ধের শরণ লইলাম।” (বোরোবুদুর, যবদ্বীপ, ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯২৭) !

প্রসঙ্গত: বর্তমানে নয়া দিল্লিস্থ ভারতের রাষ্ঠ্রপতি House (ভবনে) দরবার প্রাঙ্গনে এখন সুদীর্ঘ ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ উবষযর দিলীর সিংহাসনে বিরাজমান, যিনি ভারতের জনগন ও শাসকবৃন্দকে আশির্বাদ করছেন। এর পাশে আছে সম্রাট অশোক হল, এখানে ভারতীয মন্ত্রীরা শপথ নেন এবং বিদেশী রাষ্ঠ্রদূতগণ মাননীয় রাষ্ঠ্রপতির নিকট তাঁদের পরিচয় পত্র পেশ করেন। আজকের ভারতীয় সভ্যতা ও চীন সভ্যতা গৌতমবুদ্ধের অবদানকে অস্বীকার না করে অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন ভারতের স্বাধীন জাতীয় পতাকায় “অশোকচক্র” স্থাপন করে এবং চীনদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সভ্যতা ও শিক্ষা প্রণালীর মাধ্যমে।
বাংলার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ‘বুদ্ধবরণ’ কবিতায় (বেলা শেষের গান) লিখেছেন,
“বঙ্গে এল বুদ্ধবিভা, কিন্তু সে নাই বেঁচে,
নগর পুন্ড্রবর্ধনও নেই স্বপ্ন হয়ে গেছে;
নেই বালিকা উপাসিকা, আমরা তারই হয়ে,
বরণ করি বুদ্ধবিভা চিত্তপ্রদীপ লয়ে;
চৈত্য দিয়ে যতেœ ঘিরি বুদ্ধবিভূতিরে,
নিরঞ্জনা তীরের স্মৃতি ভাগীরথির তীরে।”

বৌদ্ধ SCHARLARS AND MONKS ‘সাম্য ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠার’ জন্যই নাটক চর্চা করতেন এবং চর্যাপদের ১৭ নম্বর কবিতায় (চর্যায়) আমরা পড়েছি, “নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী / বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই অর্থাৎ দেবী গাইছেন, বজ্রাচার্য নাচছেন, এভাবে বুদ্ধ নাটক শেষ হলো। সংসারের দুঃখ থেকে নির্বানলাভ বা বিমুক্তি সুখই ত্রিপিটক ও চর্যাপদে মানব জীবন নিয়ে সাধনা । প্রতিটি শব্দ ও তার গভীর মর্মার্থকে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, ১৯২৮ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালির আত্মপরিচয়ের খোঁজে ডক্টর মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ (ইংরেজীতে তাঁর পি.এইচ. ডি. থিসিসি ছিল) ‘বুড্ডিষ্ট মিষ্টিক সংস (বা বৌদ্ধ চর্যাপদ)’ শীর্ষক বই লিখেছেন এবং বলেছেন, “আমরা বলিতে পারি যে বৌদ্ধগানই (চর্যাপদ) যেমন একদিকে গজলের, তেমনি অন্যদিকে বৈষ্ণব পদাবলীর মূল উৎস।” ভাবতে ও আশ্চর্য লাগে যে ১৯০৭ সালের আগে বাংলাদেশে বাংলা ভাষার প্রথম গ্রন্থ ‘চর্যাপদ’ খুঁজে পাওয়া যায় নি।
লেখক সোনা কান্তি বড়ুয়া (Bachelor of Arts, University of Toronto), সাবেক সভাপতি, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, টরন্টো, খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা প্রবাসী কলামিষ্ঠ, লাইব্রেরীয়ান, বিশ্ববৌদ্ধ সৌভ্রতৃত্ব পত্রিকার সহ সম্পাদক এবং জাতিসংঘে বিশ্ববৌদ্ধ প্রতিনিধি!