ফরিদ আহমেদ : উত্তর ভারতের কোনো এক অঞ্চল থেকে ঢাকায় এসেছিলেন আর্জুমান্দ বানু। তখন তাঁর বয়স মাত্র সতেরো বা আঠারো। ঢাকার নবাবদের শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল এবং দিলকুশার বাগানবাড়িতে মুজরো করতে এসেছিলেন। সেই সময়ে তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যায় নবাব পরিবারের কোনো এক তরুণ। প্রেমটা এক তরফা ছিলো না। আর্জুমান্দ বানুও প্রেমে পড়েছিলেন সেই তরুণের।
সেই প্রেম এতোই তীব্র ছিলো যে তাঁর দলের সবাই ঢাকা ছেড়ে চলে গেলো আর্জুমান্দ বানু থেকে যান। নবাব পরিবারের সেই তরুণের সাথে সবার অগোচরে বিয়েও হয়ে যায় তাঁর। তাঁর স্বামী তাঁর জন্য এক কুঠি বানিয়ে দেয়। দু’জনের প্রেম-ভালবাসা অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হয় না। আর্জুমান্দ বানুর স্বামী অল্প বয়সেই কলেরায় মারা যায়। স্বামী মারা গেলেও উত্তর ভারতে আর ফিরে যান না তিনি। স্থায়ী নিবাস গড়ে তোলেন ঢাকায়।
ঢাকা শহরে থাকার কোনো জায়গা ছিলো না ‘পিচ্চি’-র। পথশিশুদের মতো রাস্তাতেই ঘুমোতো। এটা সেটা টুকরো কাজ করে পেটের জ্বালা নিভাতো এই কিশোর। কখনো কখনো হাত পেতেও টাকা নিতো মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে। এ’রকমই একদিন ভিক্ষা করছিলো ‘পিচ্চি’। নানা বাড়িতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পৌঁছে যায় আর্জুমান্দ আরার বাড়িতে। পরীর মতো দেখতে অবাঙালি নারীটি তাকে আদর করে খাওয়া। তার থাকার কোনো জায়গা নেই শুনে অশ্রুসিক্ত হয় তাঁর নয়ন। ওই বাড়িতেই আশ্রয় হয়ে যায় ‘পিচ্চি’-র। দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে মা আর সন্তানের এক তীব্র ভালবাসার আবেগময় সম্পর্ক। আর্জুমান্দ আরা নামহীন ‘পিচ্চি’-কে অভিজাত এক নাম দেন। সেটা হচ্ছে মীর্জা আশেক।
তরুণ বয়সে মীর্জা আশেক বাংলা সিনেমার নায়ক হতে গিয়েছিলো। সেই কাজে সফল হতে পারে নাই। তবে, দুদু মাস্টার নামের এক চিত্র নাট্যকারের সুপারিশে দ্বিতীয় নায়ক হিসাবে পর্দায় অভিষেক ঘটে তার। অভিষেক ঘটলেও লাভ হয় না তার। ওই ছবি ফ্লপ করে। এর মধ্যে আবার এক উঠতি নায়িকাকে ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে এফডিসি থেকে বহিষ্কৃত হয় মীর্জা আশেক।
আশেকের ভাগ্য বিড়ম্বনার এখানেই শেষ ঘটে না। আর্জুমান্দ বানুর ক্যান্সার ধরা পড়ে। আর্জুমান্দ বানুর চিকিৎসার টাকা কোথায় পাবে, সেটা নিয়ে যখন সে অস্থির এবং দিশেহারা অবস্থায় আছে, ঠিক সেই সময়ে দুদু মাস্টার বিপুল পরিমাণ টাকা লুট করার এক বুদ্ধি নিয়ে আসে। আর এখান থেকেই শুরু হয় গল্পের অতি উত্তেজনাকর রোমাঞ্চকর অংশের। সঙ্গত কারণেই সেই অংশের বর্ণনা আমি দিচ্ছি না। রিভিউ পড়ে যাতে কারো বই পড়াটা মাটি হয়ে না যায়, সেই কারণে এই সতর্কতা।
যে উপন্যাস নিয়ে এতক্ষণ কথা বললাম সেটা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের লেখা একটা থ্রিলার উপন্যাস। এর নাম হচ্ছে ‘দরিয়া-ই-নুর। আকৃতিতে এতো ছোট যে একে আসলে উপন্যাস বলা হবে, নাকি বড় গল্প বলবো, সেটা নিয়ে দারুণভাবে দ্বিধান্বিত আমি। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন অবশ্য এর নাতিদীর্ঘতার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যার জন্য এটা লিখেছিলেন তিনি। ঈদ সংখ্যাগুলোতে জায়গার একটা টানাটানি থাকে। ফলে, অনেক সময় সম্পাদকেরাই লেখার আকৃতি সীমাবদ্ধ করে দেন। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো। তিনি কম শব্দের মধ্যেই ‘দরিয়া-ই-নুর’ লিখেছিলেন। তবে, তাঁর ভাষ্য হচ্ছে তিনি ভিন্ন ধরনের ন্যারেশন এবং ভিন্ন ধরনের দৃশ্যকল্প তৈরি করে কম শব্দে বেশি গল্প বলেছেন।
যে কৌশলই তিনি নিক না কেনো, তাতে যে তিনি সফল ছিলেন, সেটা বলাই বাহুল্য। নাতিদীর্ঘতার মাঝেও পাঠক এখানে পূর্ণ এক গল্পের স্বাদ পাবে। গল্পের চরিত্রগুলো সেখানে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছে। এই গল্পে যেমন ভালবাসার কথা আছে, একইভাবে আছে ভালবাসাহীনতার কথাও, বিশ্বাসের সাথে মিশে রয়েছে অবিশ্বাস, বন্ধুত্বের পাশেই স্থান পেয়েছে শঠতা। নিদারুণ লোভের কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে নিঃস্বার্থতার নদী। প্রতারণার উলটো পিঠে ভেসে উঠেছে প্রতিশোধের আগুন।
আগেই বলেছি, এটা একটা থ্রিলার উপন্যাস। বাংলাদেশে থ্রিলার লেখার ক্ষেত্রে গুণে এবং মানে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এখন শীর্ষে রয়েছেন। অসম্ভব পাঠকপ্রিয়ও তিনি। তাঁর পাঠকপ্রিয়তার মূল কারণ হচ্ছে একেবারে দেশীয় পটভ‚মিতে আন্তর্জাতিক মানের টান টান থ্রিলার পড়ার সুযোগ তিনি একের পর এক করে দিচ্ছেন তাঁর পাঠকদের। তাঁর লেখা থ্রিলার উপন্যাস নিয়ে একাধিক ওয়েব সিরিজও হয়েছে।
বাংলাদেশে থ্রিলার সাহিত্য সেভাবে বিকশিত হয়নি। যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে মূলত অনুবাদ বা এডাপ্টেশন। মৌলিক থ্রিলার লেখার চর্চাটা খুব কম ছিলো এখানে। চর্চাটা না থাকার পিছনেও কারণ রয়েছে। থ্রিলারকে আমাদের সাহিত্যে নিচু চোখে দেখা হয়। আবার থ্রিলার লেখার জন্য যে ধরনের যোগ্যতা লাগে, সেটা আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের মধ্যে নেই। বাংলাদেশে মৌলিক থ্রিলার লেখাটা শুরু হয়েছিলো কাজী আনোয়ার হোসেনকে দিয়ে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ‘ধ্বংস পাহাড়’ এবং ‘ভারত নাট্যম’ নামের দু’টো স্পাই থ্রিলার লেখেন। ওই দুটো উপন্যাস দিয়েই জেমস বন্ডের বাংলাদেশি ভার্সন ‘মাসুদ রানা’-র জন্ম হয়। এর পরেই তিনি মূলত বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে মাসুদ রানা-র বই লিখতে থাকেন। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেছিলেন যে, স্পাই থ্রিলার লেখার জন্য ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাগে, দেশে বিদেশে ঘোরার প্রয়োজন পড়ে প্লটের কারণে। এটা বাংলাদেশি লেখকদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। সত্যিকারের থ্রিলার লিখতে গেলে এর পিছনে প্রচুর সময় দিতে হয়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একজন লেখকের পক্ষে একটা বইয়ের পিছনে এতোখানি সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে লেখককে না খেয়ে মরতে হবে।
এই কারণেই হয়তো বাংলাদেশে থ্রিলার লেখার জন্য আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বন্ধ্যা থেকে গিয়েছে সাহিত্যের এই জনপ্রিয় অংশটি। অনেক বছর পরে এসে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন সেই জায়গাটাতে আলোড়ন তুলেছেন। একটা কিংবা দু’টো নয়, এর মধ্যে বেশ কয়েকটা থ্রিলার লিখে ফেলেছেন তিনি। এই বইগুলো পড়লে পরিষ্কারভাবে অনুধাবন করা যায় যে লেখকের পড়াশোনার পরিধি ব্যাপক। সেই সাথে সমাজকে দেখার, সমাজের মানুষদের পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা প্রচুর। একই সাথে থ্রিলারের পাঠক কী চায়, সেই সম্পর্কেও সম্যক ধারণা তাঁর রয়েছে। তাঁর বইয়ের চরিত্রগুলো আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অতি পরিচিত চরিত্র। তিনি যে জায়গাগুলোতে ঘটনার সমাবেশ ঘটাচ্ছেন সেগুলোও আমাদের খুব চেনাজানার। ফলে, পাঠক যখন বইটা হাতে নেয়, তাঁর কাছে মনে হয় পরিচিত রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছে সে। সবকিছুর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে পাঠক খুব সহজেই। বিদেশি থ্রিলার পড়ার ক্ষেত্রে যে রকম অচিন দেশের ঘটনা মনে হয়, এখানে সে রকম লাগে না।
থ্রিলার লেখার কঠিন কাজটাকে এমন সহজ করে ফেললেন কীভাবে মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন।? তাঁর মতে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় থ্রিলার লেখা বরং বেশি সহজ কাজ। কারণ, আমাদের সমাজে আইন-শৃঙ্খলার শিথিলতার কারণে নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয় প্রতিনিয়ত, যেটা পাশ্চাত্য সমাজে বিরল। ফলে, একজন থ্রিলার লেখকের জন্য বইয়ের প্লট চারপাশেই ছড়ানো ছিটানো থাকে। শুধুমাত্র দৈনিক পত্রিকাগুলো পড়লেই একজন লেখক থ্রিলারের জন্য অসংখ্য প্লট খুঁজে পাবেন বলে তিনি মনে করেন। তাঁর বইগুলো পড়ার পরে তাঁর এই বক্তব্যের সাথে একমত হতে পাঠক বাধ্য হবেন। আমাদের চারপাশে ঘটা অনেক পরিচিত ঘটনাকেই তিনি তাঁর বইতে নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন।
‘দরিয়া-ই-নুরে’ ফিরে যাই আবার। ছোট মরিচে যেমন ঝাল বেশি থাকে, এই বইতেও থ্রিল একটু বেশি বেশি পরিমাণেই আছে। থ্রিলারপ্রেমী পাঠকদের প্রবঞ্চিত হবার সম্ভাবনা এখানে তাই কম।