ফরিদ আহমেদ : ‘ধর্ম্ম সাধারণ লোকের কালচার, আর কালচার শিক্ষিত, মার্জ্জিত লোকের ধর্ম্ম’- এই রকম সাহসী বক্তব্য দিয়ে শুরু হয়েছে প্রবন্ধটার। শুধুমাত্র সাহস দিয়ে শুরু করে সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি লেখক। এই লেখার পুরো অংশ জুড়ে সেই সাহসের ধারাবাহিক চর্চা করে গেছেন তিনি।
যুক্তিবোধ থাকা কিংবা প্রচলিত প্রথার বা ধর্মের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলাটা আমাদের সমাজ একদমই পছন্দ করে না। পছন্দ করে যুক্তিবোধহীন বিশ্বাসী মানুষদের, যারা বিনা চ্যালেঞ্জে, বিনা প্রতিবাদে, বিনা প্রশ্নে মেনে নেয় ঈশ্বরের অস্তিত্বকে, প্রাচীন কোনো ধর্মগ্রন্থকে কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধর্মবিশ্বাসকে। এই ধরনের বিশ্বাসীরা সমাজের সংহতির জন্য সহায়ক শক্তি। অথচ বিশ্বাস খুবই ক্ষতিকর একটা জিনিস। ধর্মের বইগুলো এর অনুসারীদের নির্দেশ দেয় সেখানে যা লেখা আছে, সেগুলোকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে। কাউকে সুযোগ দেয় না সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখার। সেটা দেখতে গেলে বিশ্বাসের জায়গা থেকে ছুটে যেতে হয়। অথচ জ্ঞানের প্রধান শর্তই হচ্ছে যে কোনো কিছুকে কষ্টি পাথর দিয়ে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া।
বিশ্বাসীরা ধর্মগ্রন্থকে যে বিশ্লেষণ করে না, তা নয়। করে, তবে, সেই করাটা হয় বিশ্বাসকে আরো পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে গভীর বিশ্বাস নিয়ে করা বিশ্লেষণ। ফলে, অবিশ্বাস করার মতো কোনো কিছুই তারা সেখানে খুঁজে পায় না, পায় না সন্দেহ করার মতো কিছু। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছেন, ‘আমি মনে করি মানুষের থাকা উচিত সন্দেহ করার, অবিশ্বাস করার বাসনা।’ সন্দেহই মানুষকে সুন্দর করে তোলে, সঠিক পথে পরিচালিত করে। সভ্যতার সৃষ্টিও হয় সন্দেহ এবং অবিশ্বাস থেকে। ধর্মগুলো তাদের অনুসারীদের সেই অবিশ্বাস করার বাসনাকে বিকশিত হবার কোনো সুযোগ দেয় না। তার বদলে ধর্মগ্রন্থে থাকা একরাশ নির্দেশকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে বাধ্য করে। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের বিশ্বাসী শ্রেণীই সমাজের কাম্য। এর বিপরীতে অবিশ্বাসীদেরকে সমাজের সংহতির প্রতি হুমকিস্বরূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। যে মিথ্যাকে বিশ্বাসের সুদৃশ্য মোড়কে পুরে মানুষকে খাওয়ানো হয়, সেটাকে কোনোভাবেই ঝুঁকিতে ফেলতে রাজি নয় সমাজ। যে কারণে ‘সমাজের আদেশঃ দশের মধ্যে এক হও, এগারো হয়ো না। এগারোদের সে সহ্য করে না – যদিও গৌরবের জন্য মাঝে মাঝে মাথায় করে নাচে।’
ধর্ম এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ। ধার্মিকের জীবন নিয়ন্ত্রণ করে ভয় আর পুরস্কারের লোভ। সেই ভয় আর পুরস্কার আসে ধর্ম থেকে। এই লোভ এক ধরনের ইতর লোভ। ঊর্ধ্বাকাশের ঈশ্বর ইহকাল এবং পরকাল সুফলা করে দেবে, এই লোভ দিয়ে চালিত হয় মানুষ। এই ধরনের মানুষদের কাছে থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন জর্জ বার্নাড শ। কারণ, এরা ইতরশ্রেণীর মানুষ। পরকালের দোজখ থেকে রক্ষা পাওয়া, বা স্বর্গে একটা স্থান পাকাপোক্ত করার জন্য এরা ধর্ম পালন করে অন্ধের মতো। এর বাইরে অন্য কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে সেখানে নেই। হুমায়ুন আজাদ শুধুমাত্র ধার্মিকদেরই না, পুরো ধর্মেরই কোনো উপকারিতা দেখতে পাননি। তিনি তাঁর ‘আমার অবিশ্বাস’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ধর্মের কোনো উপকারিতা নেই, তবে এর অপকারিতা রয়েছে প্রচুর, বস্তুগতভাবে সব সময়ই তা প্রমাণ করা যায়; কিন্তু ধর্ম যেহেতু শক্তিশালী, সব সময় মানুষকে রাখে সামাজিক ও মহাজাগতিক ভয়ের মধ্যে, তাই ধর্মের অপকারিতার কথা কেউ বলে না। মহাজাগতিক ভয়ের থেকে অবশ্য সামাজিক রাষ্ট্রিক ভয়ের পরিমাণ বেশি; কেননা অধিকাংশ সমাজ ও রাষ্ট্রও কাজ করে ধর্মের রক্ষিবাহিনীরূপে, তার তৎপরতার কোনো শেষ নেই।’
সাধারণ মানুষ যেহেতু ধর্ম দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, সে কারণে ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজ বা রাষ্ট্র। ধর্মের নিজেরও প্রয়োজন হয় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নির্ভর হবার। ধর্ম আর রাষ্ট্রের যূথবদ্ধতা তাই পারস্পরিক প্রয়োজনেই সৃষ্ট। এই যূথবদ্ধতায় সমস্যা তৈরি হয় যুক্তিবোধসম্পন্ন মানুষের ক্ষেত্রে। এদের উপরে বিশ্বাসের নিয়ন্ত্রণ চাপাতে গেলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যায়। এঁরা কোনো প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবার বদলে শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে প্রাপ্ত অন্তর্নিহিত সূ² চেতনা দিয়ে পরিচালিত হতে ভালবাসে। ধর্মের নিয়ন্ত্রণ প্রগাঢ় হয়ে উঠলে সেই সূ² অনুভ‚তিময় চেতনাটা যায় নষ্ট হয়ে। মৃত্যু ঘটে আলোকিত মানুষটির অন্তর্নিহিত সত্ত¡ার।
এতক্ষণ যে যে প্রবন্ধটা নিয়ে কথা বলছি, সেটা লিখেছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী। প্রবন্ধটার নাম ‘সংস্কৃতি-কথা’। এই রকম সাদামাটা নাম দেখে এই প্রবন্ধটাকে নিরীহ গোবেচারা ভাবলে ভুল হবে। বাংলাদেশের দার্শনিক কিংবা সাহিত্যিকরা ধর্মের বিরুদ্ধে অল্প যে দুই চারটে সাহসী প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁর মধ্যে এটা অন্যতম। গুণে মানে, দার্শনিক ভাবনায় এবং সাহসিকতায় এটা হয়তো হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’-কে ছুঁতে পারবে না। কিন্তু, যে সময়ে এই প্রবন্ধ লেখা হয়েছে (পাকিস্তান আমলের শুরুর দিকে), সেই সময়টাকে বিবেচনায় নিলে এটাকেও যথেষ্ট সাহসী প্রবন্ধ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করার কোনো সুযোগ নেই। লেখাটার বিষয়বস্তু আসলে ঢাকা পড়ে গিয়েছে শিরোনামের কারণে। শিরোনাম দেখলে মনে হবে লেখক বোধহয় সংস্কৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। কিন্তু, এই আপাদমস্তক নিরীহ শিরোনামের আড়ালে তিনি যে নাগাসাকিতে ফেলা শক্তিশালী পারমাণবিক বোমা নিয়ে খেলা করেছেন, সেটা খুব কম মানুষই উপলব্ধি করতে পেরেছে।
যদিও এই প্রবন্ধের নাম সংস্কৃতি-কথা, কিন্তু লেখক এখানে মূলত ধর্ম এবং সংস্কৃতির পার্থক্য নিয়েই আলোচনা করেছেন। ধর্ম কী, সেটা আমরা জানি। এটা একটা সামাজিক এবং সামষ্টিক বিষয়। অন্যদিকে সংস্কৃতি বলতে লেখক ব্যক্তিগত ধর্ম বুঝিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন বা স্বধর্ম সৃষ্টি করাই সংস্কৃতির উদ্দেশ্যে বলে তিনি মনে করেন। ব্যক্তির ভিতরের ‘আমি’কে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলাই তার কাজ। মানুষ যদিও সমাজের সৃষ্টি প্রাথমিকভাবে। কিন্তু, একটা সময়ের পরে গিয়ে নিজস্ব শিক্ষাদীক্ষা, যুক্তিবোধ, সৌন্দর্য সাধনার মাধ্যমে নিজেকে ভিন্নভাবে গড়ে তোলে সে। সমাজের নিজস্ব ছাঁচ থেকে বের হয়ে যায় সে। নিজেকে এইভাবে আলাদা করে তৈরি করা, বিশেষভাবে গড়ে তোলাটার নামই সংস্কৃতি। যে কারণে সংস্কৃতিবান মানুষ সমাজের ছক বাধা আর দশজনের মতো না, ভেড়ার পালের অংশ না। বরং সে একটা স্বতন্ত্র সত্ত¡া, আলাদা একজন মানুষ। নিজের চিন্তা, একান্ত ভাবনা, নিজস্ব যুক্তিবোধ এবং আপন কল্পনা দিয়ে গড়া একজন সংস্কৃতবান মানুষ সে। ধর্ম ব্যক্তির এই চিন্তার স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করে না। সমাজও তাই। ভিন্নমুখী চিন্তাভাবনার বদলে, চিন্তার সাম্যতা সমাজকে সংহতি রক্ষায় সাহায্য করে। ফলে, সমাজ বা রাষ্ট্র চায় ধর্মের বিকাশ, ধর্মবিশ্বাসীদের বিপুল বিস্তার। এর বিপক্ষে কেউ যুক্তি নিয়ে দাঁড়ালে, সেই ভিন্নমতকে থামিয়ে দেওয়া হয় শক্ত হাতে।
নিজস্ব স্বার্থে রক্ষণশীল আচরণ করতে গিয়ে ব্যক্তির বিকাশকে থামিয়ে দেয় ধর্ম। এতে করে ব্যক্তি নয়, শেষ পর্যন্ত আসলে সমাজই থেমে যায়। অবিকশিত থেকে যায় সমাজ, এর প্রগতি যায় রুদ্ধ হয়ে। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর মতে, ‘ধর্ম্ম চায় মানুষকে পাপ থেকে, পতন থেকে রক্ষা কতে, মানুষকে বিকশিত করতে নয়। জীবনের গোলাপ ফোটানোর দিকে তার নজর নেই, বৃক্ষটিকে নিষ্কণ্টক রাখাই তার উদ্দেশ্য। অপর পক্ষে কালচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবনের বিকাশ, পতন পাপ থেকে রক্ষা নয়। গোলাপের সঙ্গে যদি দু একটা কাঁটা এসেই যায় তো আসুক না, তাতে ক্ষতি নেই, দেখতে হবে শুধু ফুল ফুটল কিনা – এ-ই কালচারের অভিমত।’
ধর্মের স্থূলতা এবং সংস্কৃতির সূ²তার আলোচনা করতে গিয়ে নারী, প্রেম এবং কামকে তুলে এনেছেন মোতাহের হোসেন চৌধুরী। বেশিরভাগ ধর্মগুলোই নারীকে দেখেছে বিষ নজরে। সঙ্গীত, নৃত্য কিংবা শিল্পকলায় নারীর শিল্পিত চিত্রায়নে ঘোর আপত্তি জানিয়েছে ধর্ম। নারীকে নিষিদ্ধ করেছে তারা সমস্ত সুকুমার বৃত্তি থেকে। যে কোনো নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই মানুষের প্রবল আকর্ষণ থাকে। এখানেও তাই ঘটেছে। ধর্মানুসারীরা ধর্মে নারী নিষিদ্ধ বলে নারীকে বর্জন করেনি, বরং অতিরিক্ত আগ্রহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের কাছে নারী মানেই কাম, নারী মানেই স্থূল কিছু, সমস্ত আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সংস্কৃতিবানদের কাছেও নারীর প্রতি আকর্ষণ কেন্দ্রবিন্দুতেই। সেখানেও কাম রয়েছে। তবে, সেই কামের আগে প্রেম জড়িত রয়েছে। শুধু কামে তৃপ্তি নেই তাদের। কারণ তা পরিণামে ডেকে আনে ক্লান্তি ও অবসাদ। প্রেমের সঙ্গে কামকে যুক্ত করে স্নিগ্ধ, সুস্বাদু এবং তৃপ্তিকর করার দিকেই থাকে তাদের লক্ষ্য। সমাজের আচরণ এ ক্ষেত্র উলটো। বিবাহিত জীবনের স্থূল যৌনসম্ভোগে তার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু, অবিবাহিত প্রেমিক প্রেমিকা ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে, এমনকি সামান্য হাতে হাত রাখলেও প্রবল আপত্তি নিয়ে এগিয়ে আসে। মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ভাষায়, ‘কামকে দমাতে গিয়ে ধর্ম্ম ও ধর্ম্ম-সৃষ্ট সমাজ প্রেমকেই দমায়। প্রেম মরে যায়, কাম গোপনতার আশ্রয় গ্রহণ করে টিকে থাকে – মুখ নীচু করে চোরের মতো চলে। সমাজ তাতেই খুশী। কেননা, সে ভীরুতাই পছন্দ করে, সাহস নয়। প্রেম অন্যায়কারী বলে নয়, সাহসী বলেই সমাজের যত ক্রোধ তার উপরে গিয়ে পড়ে। প্রেমিকের আচরণে একটা চ্যালেঞ্জ দেখতে পায় বলে সে তাকে সহ্য করতে পারে না।’
মোতাহের হোসেন চৌধুরীর লেখাটা শুধু সাহসী লেখাই নয়, যথেষ্ট চিন্তা-জাগানিয়া একটা লেখাও। যে সময়ে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান তৈরি হয়েছে, একদল মুসলিম সাহিত্যিক নতুন উদোমে ইসলামি সাহিত্য রচনার জন্য প্রবলভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন, সেই রকম একটা সময়ে স্রোতের বিপরীত দিকে হেঁটেছেন তিনি। ধর্মচিন্তা যে সমাজ প্রগতির অন্তরায়, এ দিয়ে যে কোনো মহৎ কিছু সৃষ্টি হতে পারে না, সেটা বুঝেছিলেন তিনি। তিনি এর বিকল্প হিসাবে বিজ্ঞানচর্চার কথা বলেছেন তিনি, বলেছেন মানবিকতা চর্চার কথা। যে চর্চা মানুষকে প্রকৃতভাবে সংস্কৃত করে তোলে। আর এই সংস্কৃতিই দখিন হাওয়ার মতো জীবনের সমস্ত ফুল ফুটিয়ে তোলে।