ভজন সরকার : যে কথাটা আমি ছোটবেলায় পড়েছি ও অদ্যাবধি ধারণ করে আছি তার রচয়িতা মোতাহার হোসেন চৌধুরী। ‘সংস্কৃতি কথা’ বই-খ্যাত মোতাহার হোসেন চৌধুরী। ইস্কুলের লাইব্রেরি থেকে ভাগ্যিস এক শিক্ষক জোর করেই দিয়েছিলেন বইটা। সেই থেকে অদ্যাবধি অসংখ্য বই পড়েছি, ভালোও লেগেছে অনেক বই। কিন্তু যে বইটা আমাকে বদলে দিতে সাহায্য করেছে সেটা ‘সংস্কৃতি কথা’।

‘সংস্কৃতি কথা’ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধের নামই ‘সংস্কৃতি কথা’। ১৬ পৃষ্ঠার এ প্রবন্ধটা সকলের আবশ্যিকভাবেই পাঠ করা উচিত। ধর্ম, কালচার, জীবনের নীতি-আদর্শ নিয়ে মূল্যবান কথা আছে এ প্রবন্ধে। বর্তমান বাস্তবতায় হয়ত কথাগুলো বলা সম্ভব ছিল না মোতাহার হোসেন চৌধুরীর পক্ষে। ধর্মীয় মৌলবাদের “আনকালচারড” মানুষের হাতে বেঘরে নির্যাতিত এমনকি প্রাণনাশের হুমকির মধ্যেও পড়তেন তিনি। অথচ মোতাহার হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। সময় গড়িয়ে গেছে আরো ৬ দশক। সমাজ এবং সমাজের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এই দীর্ঘ সময়ে একটুও বাড়ে নি বরং ঘটেছে উল্টোটি।
যাক, সে অন্যকথা। ওই প্রবন্ধেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা আছে, যা তাঁকে বলেছিলেন এক পাদ্রী ভদ্রলোক, নাম ওয়াটসন। মোতাহার হোসেন চৌধুরী একবার মিলিটারি কন্ট্রাক্টারের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। সেকথা জেনে পাদ্রী ওয়াটসন সাহেব তাঁকে বলেছিলেন,
“কবিত্বের প্রতিভাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে কন্ট্রাক্টার, বিশেষ করে মিলিটারি কন্ট্রাকটার হওয়া অপরাধ, মহাঅপরাধ। নিজের প্রতিভাকে মরতে দেওয়া আর নিজের আত্মাকে মরতে দেওয়া এক কথা”।

মোতাহার হোসেন চৌধুরী কিছু বলতে চেয়েছিলেন, সেটা বুঝে তিনি আরও বলেছিলেন,
“তুমি বলবে তোমার সামান্য প্রতিভা আর ষরঃঃষব মবহরঁং রং ধ মৎবধঃ নড়হফধমব (সামান্য প্রতিভা কঠিন বন্ধন)। কিন্তু সামান্য হলেও তা মূল্যবান। আর যা মূল্যবান তার যত্ন না নেওয়া মহাপাপ”।

মোতাহার হোসেন চৌধুরীকে পাদ্রী ওয়াটসন সাহেব যা বলেছিলেন, আমি নিজে অসংখ্যবার তা থেকে বিচ্যুত হয়েছি। কিন্তু এ কথাটা আমি ধারণ করার ও প্রমোট করার চেষ্টা করি; বিশেষত যাঁরা সংগীত ও শিল্প-সাহিত্যচর্চা করেন তাঁদের উদ্দেশ্যে।
লেখালেখি বা কবিত্ব যতটুকু প্রতিভা, সংগীত শেখা ও সংগীতকে কন্ঠে ধারণ করে তার চর্চা করাও প্রতিভার কাজ। এ প্রতিভাকে অবহেলা করা তাই মহাপাপ।

পাপ-পূণ্য ব্যাপারটা আপেক্ষিক এবং আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলো ও ধার্মিকেরা এ বিষয়টিকে পারলৌকিকতার মতো অজানা সংশয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু পাপ ও পূণ্য এ ব্যাপার দু্টাে ইহলৌকিক ন্যায়-নীতি এবং অপচয়-অবক্ষয়ের সাথে জড়িত বলেই মনে হয়।
আর যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই, পরম শক্তিধর কেউ মানুষের ভিতরের প্রতিভা বা সৃজনশীলতার মতো ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন, তবে এ পরম শক্তিধরের দেয়া এ প্রতিভাকে চর্চা না করা কিন্তু ওই পরম শক্তিধরেরই অবমানন; যা ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকেও মহাপাপ।

প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই ভিন্ন বা স্বতন্ত্র মাপে ও মাত্রায় নানান রকমের গুনাবলী প্রচ্ছন্ন আছে, তার বিকাশে যতœবান না হওয়া তো অন্যায় এবং অপচয়ই।
রবীন্দ্রনাথের গানের কথায়
“অনন্ত এ দেশকালে, অগণ্য এ দীপ্ত লোকে,
তুমি আছ মোরে চাহি, আমি চাহি তোমা পানে।
স্তব্ধ সর্ব কোলাহল, শান্তিমগ্ন চরাচর
এক তুমি, তোমা মাঝে আমি একা নির্ভয়ে।”
নির্ভয়ে নিজের সামান্য প্রতিভার সযত্ন অধ্যায়ণের নামই পূজা বা উপাসনা। কিন্তু এই পূজা বলতে রবীন্দ্রনাথ কা’র পূজার কথা বলছেন? আমাদের ভারতবর্ষের ধর্মগ্রন্থগুলোতেও পূজা শব্দটির অর্থ ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হয়েছে। দেবতা গৌণ হয়ে মানুষের প্রতিভা এবং জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চা মূখ্য হয়েছে।

প্রাচীন ভারতে বেদপরবর্তী যতগুলো দর্শন এসেছে যেমন,উপনিষদ, গীতা, বৌদ্ধ কিংবা জৈন, সব ক্ষেত্রেই ক্রমে ক্রমে দেবতা গৌণ হয়েছে,মানুষ হয়েছে মুখ্য।
বেদের যাগযজ্ঞে ব্রাহ্মণদের অধিকার ছিল একচেটিয়া। উপনিষদে এসে সেটা খানিকটা হলেও খর্ব হয়েছে; এমনকি দেবতার বিশ্বাসে সংশয় ও প্রশ্ন করার দুঃসাহসও দেখা যায়, যেমন গার্গী কিংবা মৈত্রেয়ী চরিত্রের কথা বলা যায়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন কিন্তু মানব, দেবতা নয়। এমনকি প্রশ্ন করে করে উত্তর খুঁজতেও দেখি গীতায়। গীতায় দেখা যায় বেদের যাগযজ্ঞের স্থান দখল করে নিয়েছে জ্ঞান ও ভক্তিতে।
বেদ পরবর্তী রামায়ণ ও মহাভারতে দেখা যায় একেশ্বর বাদ থেকে বহু ঈশ্বরবাদের উদ্ভব; যেটা ঈশ্বর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে গনতান্ত্রিক ধারণার সূত্রপাত, যা আবার ঈশ্বর অবিশ্বাসেরও সূচনা বটে। এভাবেই বৌদ্ধ কিংবা জৈন দর্শনের বিভিন্ন শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও দেখা যায় দেবতারাই মহামানবদেরকে সমীহ করে চলেন।

প্রথম বেদ থেকে বৌদ্ধ কিংবা জৈন দর্শনের সময় ব্যবধান মেরেকেটে হিসেব করলেও প্রায় হাজার-বারো শত বছর তো হবেই। এই হাজার বছরে দেবতা বিশ্বাসে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু পরের দুই-আড়াই হাজার বছরে তবে কি দেবতারা আবার মানুষের চেয়ে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে?

অনেকেই একেশ্বরবাদকে বড় করে দেখিয়ে জ্ঞানী সাজার চেষ্টা করে। অনেকে আবার বিভিন্ন ধর্মের বহু ঈশ্বরবাদের সমালোচনা করেন; সেটা একদিকে যেমন বিশ্বাসের চরমপন্থা অন্যদিকে তেমনি আধুনিক ধ্যান ধারণারও পরিপন্থী। অলৌকিক ঈশ্বর বিশ্বাসের চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে একেশ্বরবাদ থেকে বহু ঈশ্বরবাদ এবং বহু ঈশ্বরবাদ থেকে অ-ঈশ্বরবাদ বা ঈশ্বরহীন সংশয়বাদ এ পর্যায়ের মধ্যে দিয়েই হয়ত যেতে হবে।

আধুনিক সময়েও দেখা যায়, প্রচলিত যে সমস্ত ধর্মে বিশ্বাসের বহুবিধ ধারা প্রবাহমান, সে সমস্ত ধর্ম একেশ্বরে বিশ্বাসী ধর্মগুলো থেকে বেশী সহনশীল। যেমন হিন্দু এবং বৌদ্ধ ধর্মে সহনশীলতার কথা বেশী বেশী ক’রে বলা আছে। যদিও এই সহনশীলতা প্রাচীন ভারতে তাদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধেই গিয়েছে এবং এ সুযোগে বাইরে থেকে এসে একেশ্বরবাদী “আব্রাহামিক রিলিজিয়ন” ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার করেছে।

খৃষ্টপূর্ব হাজার বছরের পুরানো ভারতীয় দর্শনে সংশয়, দ্বন্ধ কিংবা তর্কবাদের দেখা মেলে। অথচ সে সময় থেকে দেড় হাজার বছর পরের একটি ধর্মীয় মতবাদে কিন্তু প্রথমেই “প্রশ্ন করার অধিকার”-কেই খর্ব করা হয়।

তাই আজ যাঁরা পরিবর্তনের কথা ব’লে ব’লে মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, তাঁদেরকে এ সহজ সত্যটি অনুধাবন করতে হবে। যেখানে প্রশ্ন করবার অধিকারই নেই, সেখানে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের চিন্তা করা বোকার স্বর্গবাসেরই নামান্তর মাত্র। ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা নিয়ে প্রশ্ন না করলে নিজের ভিতরের প্রতিভাকে জানা যাবে কীভাবে?
(ভজন সরকার: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রকৌশলী। হ্যামিল্টন, কানাডা)